একটি দেশের অদক্ষ, অশিক্ষিত, বেকার ও কর্মক্ষম বিহীন জনগণকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করে বহির্বিশ্বে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করার লক্ষ্যে প্রেরণ করা লোকেরা হলো দক্ষ জনশক্তি। দক্ষ জনশক্তি সৃজন একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া যা সংবিধিবদ্ধ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সুসম্পন্ন করা হয়। যেকোনো দেশের উন্নয়নের মূল ভিত্তি হচ্ছে দক্ষ জনশক্তি এবং দক্ষ জনশক্তিই পারে রাষ্ট্রের ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে অর্থনীতির চালিকাশক্তিকে সচল রাখতে। দক্ষ জনশক্তি প্রভূতভাবে রাষ্ট্রের উন্নয়ন কাজকে ত্বরান্বিত করতে যথেষ্ট সহায়তা করে। তাই একটি আদর্শ রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলতে দক্ষ জনশক্তির কোনো বিকল্প নেই। অদক্ষ জনগণের মাঝে কর্মক্ষম মনোবৃত্তি ও কর্ম স্পৃহা সৃষ্টি করে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সাধন করাই হচ্ছে দক্ষ জনশক্তি গঠন করার মুখ্য উদ্দেশ্য।
পোশাক খাতের পর বাংলাদেশের জিডিপি তে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে জনশক্তি রপ্তানি খাত। দেশের বর্ধিত সংখ্যক বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন আমাদের জনশক্তি রপ্তানির অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে সেসব দেশের তেজী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেশগুলোতে জনশক্তি প্রেরণের সুযোগ সৃষ্টিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছিল। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে জনশক্তি রপ্তানি করে দেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানির ফলে প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স আয় পর্যায়ক্রমে বাড়তে থাকে যা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অন্যতম সহায়ক শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। বিএমইটির তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায় ১৯৭৬ থেকে ২০২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশি অভিবাসীদের বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ ২৩২ মিলিয়ন ডলার। বৈশ্বিক মহামারি করোনার ভয়াল থাবায় বিশ্বজুড়ে শ্রমবাজার সংকুচিত হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান রেমিট্যান্স আয় নিরবচ্ছিন্নভাবে অব্যাহত ছিল। কাজেই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে রেমিট্যান্স আয়ের উৎসকে চলমান রাখার স্বার্থে আমাদের সমন্বিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। এরই প্রেক্ষাপটে প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির প্রয়াস অব্যাহত রাখা, নতুন শ্রমবাজারের সন্ধানে উদ্যোগ গ্রহণ করা ও জনশক্তি রপ্তানি খাতে দালাল বা মধ্যস্বত্ব ভোগীদের দুর্দমনীয় দৌরাত্ম্য হ্রাস করা। অন্যথায় আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারে আমাদের অবস্থান ধরে রাখা অনেকটা কঠিন হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে রেমিট্যান্স গুরুত্ব খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন গতিশীল রাখার ক্ষেত্রে রেমিট্যান্স প্রবাহ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। পাশাপাশি জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে দেশের বর্ধিত বেকারত্ব অনেকাংশে লাঘব হচ্ছে। বাংলাদেশ বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম জনশক্তি রপ্তানি দেশ। জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে রেমিট্যান্স আয় অর্জনকারী ১০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান নবম। বাংলাদেশের মোট জনশক্তি রপ্তানির ২০.১১ শতাংশই যায় সৌদি আরবে এবং দেশে প্রেরিত রেমিট্যান্সের ২০শতাংশের বেশি আসে সেদেশ থেকে। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ থেকে রেকর্ড সংখ্যক ১০লাখ ৮হাজার ৫২৫ জন প্রবাসী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে তা কমে দাঁড়ায় ৭লাখ ৩৪হাজার ১৮১জন এবং ২০১৯খ্রিষ্টাব্দে রপ্তানি হয় ৭লাখ ১৫৯জন। বাংলাদেশ থেকে যে সংখ্যক অভিবাসী বিদেশে যায় তারমধ্যে ১৫ শতাংশই নারী। ২০২০খ্রিষ্টাব্দে ৭লাখ নতুন কর্মী প্রেরণের লক্ষ্যমাত্রা স্থির থাকলেও বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে দেশ থেকে মাত্র ২লাখ ১৭হাজার ৬৬৯জন কর্মী বিভিন্ন দেশে প্রেরণ করা হয়। ফলে ৫ লাখেরও বেশি লোক বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ লাভ থেকে বঞ্চিত হয়। তাছাড়া করোনা ভাইরাসের কারণে চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরে আসে প্রায় সাড়ে তিন লাখ প্রবাসী।
২০২২–২৩ অর্থবছরে রেকর্ড সংখ্যক ১১.৩৭ লাখ কর্মী বিদেশে রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। দেশের ইতিহাসে এটি একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। বিগত ৪০বছরে প্রায় ১কোটি ২৫লাখ প্রবাসী বিদেশে গমন করেছেন এবং তা প্রায় প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন কারণে বিদেশে শ্রমবাজার ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। অদক্ষ জনশক্তির চাহিদা দ্রুত কমে আসছে। অনেক দেশ দক্ষ কর্মী ছাড়া অদক্ষ কর্মী সে–সব দেশে নিয়ে যেতে অনীহা প্রকাশ করে। অভিবাসী নিয়োগের ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষ ১০ নিয়োগকারী দেশের ৭৫ শতাংশের লক্ষ্য হলো উচ্চ দক্ষতা সম্পন্ন অভিবাসী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেসব পেশায় দক্ষ কর্মীর চাহিদা রয়েছে তার মধ্যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, কম্পিউটার সিস্টেম এনালিস্ট, রোবটিঙ, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, বিগ ডাটা এনালিস্ট, ক্লিনিয়ারী সার্ভিস এবং নির্মাণ শিল্প উল্লেখ্য। তাছাড়া জাপান, কোরিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে নার্সিং, বয়স্ক সেবা, ওয়েল্ডিং, কেয়ারগিভিং পাইপফিটিং, ইঞ্জিনিয়ারিং, প্লাম্বার, হোটেল ম্যানেজমেন্ট এন্ড ট্যুরিজম ইত্যাদি পেশার চাহিদা রয়েছে।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে দক্ষ জনশক্তির কোনো বিকল্প নেই। গত ২০ বছরে বিশ্বে দ্রুত প্রযুক্তিগত বিকাশ বিগত ১০০ বছরকে ছাড়িয়ে গেছে। পরবর্তী ৫ বছরে এ পরিবর্তনের ধারা গত ২০ বছরকেও ছাড়িয়ে যাবে। তবে মধ্যপ্রাচ্যের ৭৫ শতাংশ নিয়োগকারী দেশসমূহের বাংলাদেশি জনশক্তির কারিগরি দক্ষতার ওপর কোনো আস্থা নেই। যার কারণে বাংলাদেশিরা ভালো কাজে অগ্রাধিকার না পেয়ে অপেক্ষাকৃত নিম্নমান ও নিম্ন আয়ের কাজে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়। তাছাড়া সৌদি আরব সরকার ‘সৌদিকরণ কর্মসূচি’ (প্রতি কারখানায় ২০শতাংশ সৌদি নাগরিক থাকা বাধ্যতামূলক) করেছে যার ফলে প্রবাসীদের জন্য ১২ধরনের চাকরি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ভিশন ২০৩০ অনুযায়ী সৌদি সরকার তাদের শ্রমবাজারে ৭০ শতাংশ সৌদি নাগরিককে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা করেছে যার ফলে দেশটিতে ভবিষ্যৎ শ্রমবাজার সংকুচিত হতে যাচ্ছে। মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরাক ও লিবিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি দীর্ঘদিন যাবৎ প্রায় বন্ধ। কুয়েতে মানবপাচার সংক্রান্ত সামপ্রতিক ঘটনায় বাংলাদেশি জনশক্তি প্রেরণের বিষয়টি প্রায় হুমকির মুখোমুখি। কাতার, লেবানন ও আরও কিছু মধ্যপ্রাচ্যের দেশে নানান মুখি জটিলতার কারণে বাংলাদেশিদের জন্য শ্রমবাজার অনেকটা অনিশ্চিত। বাংলাদেশি অভিবাসীরা অনেক ক্ষেত্রেই প্রতারণার ফাঁদে আটকা পড়ে। নারী অভিবাসীরা প্রতারক চক্রের হাতে পড়ে যৌনদাসী হিসেবে স্থানীয়দের যৌন নির্যাতনের শিকারে পরিণত হয়। প্রতারিত অভিবাসীদের বেশিরভাগ দালাল নির্ভর হওয়ার কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া কোনো মহলের পক্ষে সম্ভব হয় না। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এসব অভিবাসীদের সঠিক পথে না নিয়ে নৌকা জাহাজে করে অবৈধ পথে নিয়ে বিদেশের মাটিতে তুলে দিয়ে অবর্ণনীয় দু:খ দুর্দশার মুখে ঠেলে দিচ্ছে। অসাধু দালালদের ফাঁদে পড়ে অভিবাসন প্রত্যাশী অনেক লোকের সলিলসমাধি ঘটে যা মানবতার ইতিহাসকে কালিমালিপ্ত করে। বিদেশের মাটিতে পৌঁছার পর জনশক্তির ভাগ্য বঞ্চিত অনেককেই চুক্তি মোতাবেক কাঙ্ক্ষিত কাজে নিয়োগ না দিয়ে অপেক্ষাকৃত নিম্নপর্যায়ে কাজ করতে বাধ্য করা হয়। দক্ষ অদক্ষ এসব অভিবাসন প্রত্যাশী মানুষগুলো সলিলসমাধি থেকে রক্ষা পেলেও মৃত্তিকার বুকে অনেকের সমাধি রচিত হয়।
করোনা মহামারির কারণে জনশক্তি রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেলে দেশে রেমিট্যান্স প্রেরণ ব্যবস্থায় কিছুটা বিঘ্ন সৃষ্টি করেছিল। তাছাড়া চাহিদাভিত্তিক দক্ষ জনশক্তির অভাবে শ্রমবাজার অনেকটা সংকুচিত হয়। বিষয়টি মাথায় রেখে সরকার ও সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো শ্রমবাজার ধরে রাখার লক্ষ্যে নতুন শ্রমবাজারে প্রবেশের জন্য দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির ওপর গুরুত্ব দিয়ে যাচ্ছে। কারিগরি প্রশিক্ষণ, বিদেশি ভাষা শিক্ষা কোর্স চালু, কারিকুলামে পরিবর্তন এনেছেন এবং সংখ্যার চেয়ে গুণগত মানসম্পন্ন অভিবাসনের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। তাই ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের আন্তর্জাতিক অভিবাসন দিবসে বাংলাদেশের স্লোগান ছিল ‘মুজিব বর্ষের আহবান দক্ষ হয়ে বিদেশে যান’।
শুধু দক্ষতা অর্জনের উপর বিশেষ জোর দিলে চলবে না। অভিবাসন প্রত্যাশী জনশক্তিকে দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি বিদেশের সংস্কৃতি ও পরিবেশের সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে নতুন নতুন ক্ষেত্রে কাজ করার জন্য নিজেদেরকে সক্ষম জনশক্তি হিসেবে প্রমাণ করতে হবে। প্রয়োজনে সুষ্ঠু ও নিরাপদ অভিবাসন সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার নির্দেশিত করণীয় বিষয়াবলী অনুসরণ করে বিদেশি নিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনে যথার্থ যত্নবান হতে হবে। সরকার এবং আমাদের দূতাবাসগুলোকে হারানো শ্রমবাজার উদ্ধারে এবং নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টিতে আরও বেশি আন্তরিক ও উদ্যোগী হতে হবে। জনশক্তি রপ্তানির পথে হয়রানি ও অন্তরায় সৃষ্টিকারীর বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রতারণা বন্ধে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে যথাযথ কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং ইমেজ সংকট কাটিয়ে উঠার লক্ষ্যে দালাল নির্ভরতা কমিয়ে যথাযথ নিয়োগ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জনশক্তি রপ্তানি করার জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্টদের সমন্বিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, প্রাক্তন অধ্যক্ষ, রাঙ্গুনিয়া সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম।