বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়েছে মালয়েশিয়া ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি–ইউকেএম। বাসস জানায়, বুধবার কুয়ালালামপুরে ইউকেএম বিশ্ববিদ্যালয় অডিটোরিয়ামে আয়োজিত এক আনন্দঘন পরিবেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য এবং নেগেরি সেমবিলান রাজা তুয়াংকু মুহরিয ইবনি আলমারহুম তুয়াংকু মুনাওয়ির কাছ থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রির সনদ নেন অধ্যাপক ইউনূস।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সামাজিক ব্যবসার প্রসারে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অধ্যাপক ইউনূসকে এ সম্মাননা দিয়েছে তারা। এ উপলক্ষে ইউকেএম বিশ্ববিদ্যালয় অডিটোরিয়ামে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন ইউনূস। এদিন সকালে তিনি অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছালে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য তাকে স্বাগত জানান। এসময় শান্তিতে নোবেলজয়ী ইউনূসকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়। মালয়েশিয়ার শিক্ষাবিদ, নীতি–নির্ধারক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক–শিক্ষার্থী এবং প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গীরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। খবর বিডিনিউজের।
সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি নেওয়ার পর দেওয়া বক্তৃতায় ড. ইউনূস বলেছেন, এই স্বীকৃতি আমাকে তরুণ প্রজন্মের স্বপ্ন পূরণে আমার দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। গত বছর বাংলাদেশের বহু তরুণ সাহসিকতার সঙ্গে একটি ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। শত শত ছাত্র–যুবক একটি উন্নত ভবিষ্যতের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছে, যেখানে প্রত্যেকে মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে পারবে এবং ভয়, বৈষম্য ও অবিচার থেকে মুক্ত থাকবে। তিনি বলেন, তার নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন আয়োজনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করছে, যাতে জনগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়। আমরা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে এবং ক্ষমতার প্রকৃত মালিক জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, বলেন তিনি।
অন্তর্বর্তী সরকার সেই নতুন বাংলাদেশ গড়তে কাজ করছে মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্ট মাসে তরুণদের নেতৃত্বে সংঘটিত অভ্যুত্থান আমাদের জাতীয় পরিচয় ও ভবিষ্যত আশার নতুন অর্থ তৈরি করেছে। আজ আমরা এক নতুন বাংলাদেশ গড়তে কাজ করছি, যেখানে শাসনব্যবস্থা হবে ন্যায়সঙ্গত, অর্থনীতি হবে সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং প্রত্যেকে সমান সুযোগ পাবে সফল হওয়ার জন্য। আমাদের সরকার শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার দিকে মনোযোগী রয়েছে।
সরকার নির্বাচনের আগে সংস্কারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে জানিয়ে ইউনূস তার বক্তৃতায় বলেন, একটি শক্তিশালী ও টেকসই বাংলাদেশ গড়তে আমাদের অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে উদ্যোক্তাদের সহায়তা, শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে বেশি বিনিয়োগ এবং আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক অংশীদারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, তোমরা আগামী দিনের নির্মাতা। তোমাদের ভাবনা, সৃজনশীলতা এবং দায়িত্ববোধ শুধু মালয়েশিয়ার নয়, সমগ্র বিশ্বের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে। স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যেতে গিয়ে সবসময় মনে রেখ, প্রকৃত সাফল্য শুধু নিজের জন্য অর্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং কীভাবে তুমি অন্যদেরও তোমার সঙ্গে উন্নতির পথে নিয়ে যাচ্ছ, সেটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যে সেরা উত্তরাধিকার রেখে যেতে পারি তা হলো এমন এক পৃথিবী, যেখানে কাউকে পেছনে ফেলে রাখা হবে না।
ইউনূস বলেন, তোমাদের সিদ্ধান্ত, কাজ এবং মূল্যবোধই নির্ধারণ করবে আমরা কোথায় যাব। তাই আমি তোমাদের অনুরোধ করছি, বড় স্বপ্ন দেখ, সাহসীভাবে চিন্তা কর, এবং সে অনুযায়ী কাজ করো। ভয় পেও না, প্রত্যেক ব্যর্থতাই সাফল্যের পথে একটি ধাপ মাত্র। তার ভাষায়, পৃথিবীকে বদলে দেওয়ার জন্য প্রয়োজন প্রকৃত নেতার, প্রয়োজন সমস্যা–সমাধানকারীর। তোমাদের প্রত্যেকের ক্ষমতা রয়েছে অসাধারণ কিছু করার, মানুষের সেবায় ব্যবসা গড়ে তোলার, জীবন বদলে দেওয়ার মত নতুন ধারণা সৃষ্টির, অথবা এমন নীতি প্রণয়নের, যা গোটা একটি সম্প্রদায়কে উন্নতির পথে নিয়ে যাবে।
শান্তিতে নোবেলজয়ী ইউনূস বলেন, আজকের অন্যতম বড় বিপদ হল– সম্পদ ক্রমশ কয়েকজন মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। এর ফলে বৈষম্য ও অবিচার সৃষ্টি হয়। আমাদের যা দরকার, তা হল একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি যেখানে সম্পদ ন্যায্যভাবে ভাগ হবে এবং প্রত্যেক মানুষ মর্যাদা ও লক্ষ্য নিয়ে বাঁচার সুযোগ পাবে।
নিজের কর্মময় জীবনের প্রসঙ্গ তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, অর্থনীতিবিদ হিসেবে কাজ করা থেকে শুরু করে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা, ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চালু করা থেকে সামাজিক ব্যবসার প্রচার একটি বিশ্বাস সবসময় আমাকে দিকনির্দেশনা দিয়েছে, মানুষ প্রতিভা বা স্বপ্নের অভাবে দরিদ্র হয় না, তারা দরিদ্র হয় কারণ সমাজ তাদের ন্যায্য সুযোগ দেয়নি। আমাদের আর্থিক ব্যবস্থা ধনীদের সেবা করার জন্য গড়ে উঠেছে, গরিবদের জন্য নয়। এই সহজ সত্যই আমাকে ভিন্ন কিছুর চেষ্টা করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। আমি এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করেছি, যেখানে সবচেয়ে দরিদ্র মানুষও ক্ষুদ্রঋণ পেতে পারে, ব্যবসা শুরু করতে পারে এবং নিজের জীবন বদলে দিতে পারে।
বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্বের কথা স্মরণ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, দুই দেশ সবসময়ই মজবুত সম্পর্ক উপভোগ করেছে, যা গড়ে উঠেছে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং উন্নতির যৌথ স্বপ্নের ওপর ভিত্তি করে। বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া অনেক পথ একসঙ্গে হেঁটেছে। আমরা পরস্পরের সমৃদ্ধির পথে সহযোগিতা করেছি। মানবসম্পদ উন্নয়ন ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে মালয়েশিয়া আমাদের বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে পাশে থেকেছে। বছরের পর বছর ধরে আমাদের অংশীদারত্ব বাণিজ্য, শিক্ষা, উদ্ভাবন ও জনগণের মধ্যে সম্পর্কসহ বিস্তৃত হয়েছে নানা ক্ষেত্রে। এটা প্রমাণ করে, আমরা যখন একটি যৌথ উদ্দেশ্যে একসঙ্গে কাজ করি, তখন কত কিছু অর্জন করা সম্ভব।
মালয়েশিয়ার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও গভীর করার প্রত্যয় জানিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ এখন এক নতুন যুগে প্রবেশ করছে, আমরা মালয়েশিয়ার সঙ্গে সহযোগিতা আরও গভীর করতে চাই। সম্ভাবনাময় অনেক ক্ষেত্র রয়েছে যেমন সেমিকন্ডাক্টর শিল্প, হালাল অর্থনীতি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং উদ্যোক্তা উন্নয়ন। একসঙ্গে আমরা এমন এক ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারি, যা হবে সমৃদ্ধ, উদ্ভাবনী, স্থিতিশীল এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক।