অবাধ ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে না পারায় আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত তিন জাতীয় নির্বাচনে জনগণের আস্থা ধ্বংস করা হয়েছে বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে হাই কোর্ট। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আংশিক বাতিলের রায় ঘোষণা করে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর বেঞ্চ গতকাল এই পর্যবেক্ষণ দেয়।
রায়ে ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সংসদে পাস করা পঞ্চদশ সংশোধনীর পাঁচটি অনুচ্ছেদকে অবৈধ ঘোষণা করেছে আদালত, যার মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাদ দিয়ে করা সংশোধনীও রয়েছে। রায়ে আদালত বলেছে, বিগত তিন জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ক্ষেত্রে জনগণের আস্থাকে ধ্বংস করেছে। খবর বিডিনিউজের।
২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধান থেকে বাদ দিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান যুক্ত করা হয়েছিল। এরপর ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা হয় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়। এর মধ্যে দশম ও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের নির্দলীয় সরকারের দাবি পূরণ না হওয়ায় নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপিসহ বেশিরভাগ বিরোধী রাজনৈতিক দল। তাদের বর্জনের ফলে দশম নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হয়ে যান। সেই সংসদকে বিনা ভোটের সংসদ আখ্যা দেয় ভোট বর্জন করা বিএনপি।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক দেখাতে শরিক ও বিরোধী দল জাতীয় পার্টির জন্য আসন ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের সঙ্গে দলের বিদ্রোহীদের। এ নির্বাচনের নাম হয় ‘আমি আর ডামি’ নির্বাচন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হওয়ার কারণে জুলাই–আগস্টের গণআন্দোলন গড়ে ওঠার কথা বলেন বিচারপতি ফারাহ মাহবুব। তিনি বলেন, নির্বাচনের প্রতি মানুষের আস্থা হারানোর প্রেক্ষাপটে হাজারো মানুষ প্রাণ দিয়েছে। হাজার হাজার মানুষ আজীবনের জন্য শারীরিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য অপরিহার্য বিবেচনা করে রায়ের পর্যবেক্ষণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত বলা হয়েছে।
পঞ্চদশ সংশোধনীর পর যুক্ত করা ৭(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, কোনো ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোনো অসাংবিধানিক পন্থায়, এই সংবিধান বা এর কোনো অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করলে কিংবা তা করার জন্য উদ্যোগ নিলে বা ষড়যন্ত্র করলে; কিংবা, এই সংবিধান বা এর কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করলে কিংবা তা করার জন্য উদ্যোগ নিলে বা ষড়যন্ত্র করলে, তা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ হবে।
রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধের জন্য এই অনুচ্ছেদে যে কারণগুলো উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলোকে ভেইক টার্ম (অস্পষ্ট পরিভাষা) হিসাবে বর্ণনা করে ফারাহ মাহবুব বলেন, এরূপ বিধান মানুষের বেঁচে থাকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতার নীতির পরিপন্থি।
তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। সেই সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত রায় এবং পূর্ণাঙ্গ রায়ের মধ্যে বৈপরীত্য (কনট্রাডিকশন) থাকার কথাও রায়ের পর্যবেক্ষণে তুলে ধরেন বিচারক। তিনি বলেন, সংক্ষিপ্ত রায়ে আরও দুইবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলা হলেও পূর্ণাঙ্গ রায়ে তা ছিল না।
রায় ঘোষণার পর বিচারপতি ফারাহ মাহবুব বলেন, জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনকে সবকিছুর মূলে রেখেছে আমাদের সংবিধান। জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোকে কেন্দ্রে রেখে আজকের রায় দিয়েছি। আপিল বিভাগে ত্রয়োদশ সংশোধনীর রিভিউ আবেদনের বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সাংঘর্ষিক যাতে না হয়, সেদিকেও নজর দেওয়ার কথা বলেন তিনি।