কী আশ্চর্য, ঢাকার আদালত এলাকায় পুলিশকে স্প্রে মেরে ছিনতাই করা হয়েছে জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন এবং লেখক অভিজিৎ রায় হত্যায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে। রোববার দুপুরে পুরান ঢাকার আদালত পাড়ায় এ ঘটনার পর রেড অ্যালার্ট জারি করে দুই আসামিকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। এদিকে দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়াদেরও তথ্য মিলেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। পালিয়ে যাওয়া দুই আসামি হলেন মইনুল হাসান শামীম ওরফে সামির ওরফে ইমরান এবং আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাব। মইনুল হাসান শামীমের বাড়ি সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার মাধবপুর গ্রামে। আবু ছিদ্দিক সোহেলের বাড়ি লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার ভেটেশ্বর গ্রামে। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের (আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) এ দুই সদস্য দীপন হত্যায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলাতেও আবু সিদ্দিক সোহেলের ফাঁসির রায় হয়েছে।
নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের অপতৎপরতা যে কত মারাত্মক, তা এই ঘটনা থেকে সহজেই অনুমেয়। এ ঘটনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, পলাতক জঙ্গিরা যাতে দেশ ছাড়তে না পারে সেজন্য রেড অ্যালার্ট জারি করে সীমান্ত এলাকায় সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। ঘটনাটি দুঃখজনক। যদি কারো অবহেলা থাকে, গাফিলতি থাকে, যদি কেউ ইচ্ছা করে এই কাজটি করে থাকেন, তার উপযুক্ত ব্যবস্থা আমরা গ্রহণ করব।
জঙ্গিরা যেমন ধর্মান্ধ, তেমনি ভয়ংকর। তারা তাদের ভুল আদর্শ বাস্তবায়নে চরমপন্থা বেছে নিচ্ছে। প্রশাসনের ভেতরে-বাইরে তাদের কোনো ছায়া আছে কিনা-সে বিষয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। তারা জিহাদের অপব্যখ্যা দিয়ে সহজ সরল মানুষ ও তরুণদের দলে ভেড়ানোর কৌশল নিয়েছে। তারা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারেও পারদর্শী। বিষয়টি অতি স্পর্শকাতর। তাই জঙ্গি দমনে চলমান কৌশলে পরিবর্তন এনে সর্ব সাধারণকে সচেতন করার বিষয়টি সংযুক্ত করতে হবে। বিচ্ছিন্নতাবাদও কাউকে কাউকে জঙ্গিবাদের দিকে নিয়ে যায়। সামপ্রদায়িক জঙ্গিবাদ একমাত্রিক সমস্যা নয়, এটি বহুমাত্রিক সমস্যা। ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে এর অপচেতনা উৎসারিত হচ্ছে। যদিও অন্যান্য দেশের জঙ্গিদের কর্ম তৎপরতার সঙ্গে আমাদের দেশের জঙ্গিদের আক্রমণের গতি-প্রকৃতির কিছু অমিল রয়েছে। সাধারণত ইসলামী জঙ্গিবাদের যে মতবাদ বিভিন্ন দেশে প্রচলিত রয়েছে সেখানে সরকার বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে তাদের মুখোমুখি অবস্থানের পিছনে কিছু মৌলিক দাবি থাকে।
তাদের দাবির প্রেক্ষিতে সরকারের দমন ও নিপীড়নের ফলাফল স্বরূপ তারা সহিংসতার পথ বেছে নেন। তারা প্রথমদিকে চোরাগুপ্তা হামলার পথ বেছে নেয়, যখন তারা সংখ্যায় খুবই কমে যায় এবং পরাজয় নিশ্চিত বুঝতে পারে শুধু তখনই তারা আত্মঘাতী হামলার মতো চরম পন্থা অবলম্বন করে। ৯০ শতাংশেরও বেশি মুসলমানের দেশ বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় বিধিনিষেধ পালন করতে যেমন কোথাও বাধা নেই, তেমনি আমাদের দেশের মতো মিলেমিশে শিয়া ও সুন্নিরাও বিশ্বের খুব কম দেশে শান্তিতে বসবাস করে। এ প্রেক্ষিতে, জঙ্গিদের উদ্দেশ্য ও কাজের মধ্যে কোনো মিল দেখতে পাই না আমরা, তাদের সুনির্দিষ্ট দাবি-দাওয়াও কোথাও পেশ করেননি তারা। তাই প্রগতিশীল চেতনা ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। জঙ্গিবাদ নিয়ে গণমাধ্যমে কাজ করার নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। কেন একটা ছেলে বা মেয়ের মধ্যে হঠাৎ পরিবর্তন আসে তা নিয়ে আরও অনুসন্ধান করা দরকার। গণমাধ্যম সাহসী ভূমিকা পালন না করলে জঙ্গিবাদ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করতো।
জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে সামগ্রিক জায়গটাও তুলে ধরতে হবে। এই চেতনাটা কারা ছড়ায়, কিভাবে ছড়ায়, বিচার হলে কারা বাধা দেয়; তা আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে বিশদ কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুত করতে হবে এবং তা এখনই করতে হবে। অন্যথায় সন্ত্রাসবাদের বিপদ থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করা কঠিন হবে। আজ সমগ্র দেশ ও জাতি কঠিন এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে ধর্ম, গণতন্ত্র ও সভ্যতাও।
এই অবস্থায় এ দেশের সকল প্রগতিশীল গণতন্ত্রকামী দেশপ্রেমিক জনগণের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সমগ্র দেশ ও জাতিকে একটি দিক-নির্দেশনা দেওয়া অত্যন্ত জরুরি ও আবশ্যিক কর্তব্য। সেই কর্তব্য পালনে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও শক্তিসমূহের পাশাপাশি সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিশ্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। এই উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে বাধাগ্রস্ত করতে, বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল ও ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে স্বাধীনতাবিরোধী জঙ্গিবাদী চক্র দেশকে নিয়ে গভীর চক্রান্ত দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে আসছে। এই উগ্র ধর্মান্ধ জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী বাংলাদেশের উন্নয়ন ও গণতন্ত্র চায় না। এই অপশক্তি বাংলাদেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের এ অপপ্রয়াস রুখে দিতে হবে।