বান্দরবানে পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রভাবে রূপ হারাচ্ছে পাহাড়ের খরস্রোতা নদী সাঙ্গু। ইতিমধ্যে কমে গেছে নদীর পানির প্রবাহ। জেগে উঠেছে নদীর মাঝখানে মাঝখানে অসংখ্য ছোট-বড় চর। সদর, রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি জেলার চারটি উপজেলা এবং বান্দরবান পৌরসভার মানুষের পানির প্রধান উৎস হচ্ছে সাঙ্গু নদী। কিন্তু পরিবেশ দূষণের ফলে বদলে যাচ্ছে নদীমাতৃক বাংলাদেশের মানচিত্র। শুকিয়ে যাচ্ছে দেশের অভ্যন্তরীণ অন্যতম পাহাড়ি খরস্রোতা নদী সাঙ্গু। নির্বিচারে পাহাড় কাটা, বনাঞ্চল উজাড়, পাথর উত্তোলনের ফলে বৃষ্টিতে পাহাড়ের মাটি ধুয়ে পলি জমে ভরাট হতে বসেছে নদীটি। দেখা দিয়েছে নাব্যতা সংকটও। ক্রমশ দূষিত হয়ে পড়ছে সাঙ্গু নদীর পানি। বিলুপ্ত হওয়ার পথে সাঙ্গু নদীর দুর্লভ মৎস্য সম্পদও।
বিভিন্ন সূত্রমতে, দেশের সবচেয়ে পশ্চাদপদ জেলা বান্দরবান। এখানে ১১টি ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠিসহ চৌদ্দটি সম্প্রদায়ের বসবাস রয়েছে। পার্বত্য এই জেলার আয়তন ৪ হাজার ৪৭৯ কিলোমিটার। পশ্চাৎপদ এই জনপদের সুখ-দুঃখের সাথী হচ্ছে খরস্রোতা সাঙ্গু। এ সাঙ্গুকে ঘিরেই সদর, রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি চারটি উপজেলা এবং বান্দরবান পৌরসভার কয়েক লক্ষাধিক মানুষের জীবনধারণ। একটা সময় সাঙ্গু নদীপথ ছিল এই অঞ্চলের পাহাড়ি জনপদের একমাত্র যাতায়াতের মাধ্যম। কিন্তু দিন বদলে গড়ে উঠেছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। তবে আজও রুমা, থানচি, রোয়াংছড়ি এবং সদর উপজেলার অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলের দুর্গম গ্রামগুলোতে যেতে নৌকা লাগে। তবে কালের বিবর্তনে পলিতে ভরাট হতে বসেছে সাঙ্গু। শুষ্ক মৌসুমে নৌ চলাচল খুবই কষ্টের। নদীর মাঝপথে জেগে উঠেছে অসংখ্য ছোট-বড় চর। কোথাও কোথাও একদম সরু হয়ে গেছে নদীটি। দেশের অভ্যন্তরে উৎপত্তি নদীগুলোর মধ্যে সাঙ্গু অন্যতম। জেলার দুর্গম মিয়ানমার সীমান্তবর্তী আরাকান পাহাড়ের অংশ বিশেষ থেকে উৎপত্তি হয়ে সরাসরি বঙ্গোপসাগরের মোহনায় গিয়ে মিলিত হয়েছে খরস্রোতা নদী সাঙ্গু। তবে নদীটির সঠিক কোনো পরিসংখ্যান ও পরিমাপ নেই। পাওয়া যায়নি এ সংক্রান্ত সঠিক কোনো তথ্যও। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের জরিপ মতে; পার্বত্যাঞ্চলে প্রতিবছর হেক্টরে ১০০ থেকে ১২০ টন মাটির ক্ষয় হচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইইসিএন সংস্থার মতে দুর্গমাঞ্চলে ১৯৬৪ হতে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত মৃত্তিকা সম্পদ শতকরা ১৮ ভাগ ক্ষতি সাধিত হয়েছে। ভূমি অবক্ষয় সম্পর্কিত এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে মোট পাহাড়ি ভূমির প্রায় ১৭ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূমি বর্তমানে ক্ষয়ের মুখে। প্রচলিত আদি চাষাবাদ পদ্ধতি জুম চাষকেই এ জন্য প্রধানত দায়ী করা হয়েছে। ১৯৯২ সালের জরিপ অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি ক্ষয়ের মাত্রা অত্যন্ত বিপদজনক।
জেলা নদী পরিব্রাজক সংগঠনের সভাপতি বাবুমনি কর্মকার ও যুগ্ম সম্পাদক ইয়াছিন আরাফাত বলেন, দেশের অন্যতম পাহাড়ি নদী হচ্ছে সাঙ্গু। খরস্রোতা নদীটি শুকিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে পানির প্রবাহও। পলি জমে ভরাট হয়ে নাব্যতা সংকট দেখা দিয়েছে জেলাবাসীর পানির অন্যতম উৎসস্থল নদীটি। আস্তে আস্তে দখল হয়ে যাচ্ছে নদীর দু’পাড়। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে রূপ হারাতে বসেছে খরস্রোতা নদী সাঙ্গু। তারমধ্যে অন্যতম কারণগুলো হচ্ছে, পাহাড় কাটা, বনাঞ্চল উজাড়, ঝিরি-ঝর্ণা, পাথর খোদাই করে পাথর উত্তোলন এবং অপরিকল্পিত চাষাবাদ পদ্ধতি। বিপর্যয় ঠেকাতে কারণগুলো চিহ্নিত করে নদী রক্ষায় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে একটা সময় সাঙ্গু নামের নদীটি হারিয়ে যাবে। পানির উৎস্য স্থল না থাকলে পাহাড়ি এলাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে মানুষের জন্য।
বান্দরবান মৃত্তিকা সংরক্ষণ গবেষণা ও পানি সংরক্ষণ কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মাহাবুবুল ইসলাম বলেন, পার্বত্য এ জনপদে শুষ্ক মৌসুমে পানি পাওয়া যায় না। তার উপর পাহাড়ের ঝিরি, ঝর্ণা ও ছড়া-খাল ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বিশেষত সাঙ্গু নদী ক্রমশ ভরাট হয়ে নাব্যতা হারাচ্ছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের অনেকগুলো কারণ রয়েছে। তারমধ্যে অন্যতম চারটি কারণ হচ্ছে, নির্বিচারে পাহাড় কাটা, বনাঞ্চল উজাড়, পানির উৎস্য স্থল পাহাড়ের ঝিরি-ঝর্ণা, ছড়া-খালের পাথর উত্তোলন এবং অপরিকল্পিত চাষাবাদ পদ্ধতি। এগুলোর কারণে পানির উৎস্য স্থলগুলো নষ্ট হচ্ছে, ক্রমশ নদী, ঝিরিগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। দূষিত হয়ে পড়ছে সাঙ্গু নদীর পানিও। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে আরও কঠিন পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে জেলাবাসী।
এ বিষয়ে বান্দরবান জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি বলেন, জেলার সাঙ্গু, মাতামুহুরী এবং বাকখালী নদী নিয়ে একটা সার্ভে করা হচ্ছে। নদী রক্ষার বিষয়টি একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প। সরকার পানির উৎস্য স্থল নদীগুলো দখল ও দূষণমুক্ত করতে কাজ করছে। স্থানীয় প্রশাসনও বিষয়টিতে কড়া নজর রাখছে।