একটা সময় নিজে ছিল ছিঁচকে চোর। গত ১৮ বছর ধরে (মাঝখানে তিন বছর বাদে) তিল তিল করে নিজেকে পরিণত করেছেন পণ্য লোপাট চক্রের ‘ডন’ হিসেবে। হালিশহরে রয়েছে তার দোতলা বাড়ি। আরও একটা নির্মাণাধীন। ঢাকায় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় রয়েছে দুটি প্লট। আছে একাধিক ট্রাক, কাভার্ডভ্যান। দুই স্ত্রীর ঘরে তার আট সন্তান। তিনি এসব কিছু গড়েছেন গার্মেন্টস পণ্য চুরির অর্থে। তার পরিকল্পনায় ও যোগসাজশে একটি–দুটি নয়, বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৫ হাজারেরও বেশি ট্রাক বা কাভার্ডভ্যান থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকার পণ্য চুরি হয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তথ্য রয়েছে। একাধিক বার জেল খেটেছেন। মামলার সংখ্যা অন্তত ৬০টি। নাম তার মাসুদ ওরফে পিচ্চি মাসুদ ওরফে ডন মাসুদ। ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়ক নিয়ন্ত্রণ করে মাসুদের মতো ২৫ জন। একেকজনের গ্রুপে সদস্য সংখ্যা ২৫ থেকে ৩০ জন। ছয়টি উপগ্রুপে বিভক্ত হয়ে একেকটি গ্রুপ কাজ করে। ছিনতাইয়ের নির্ধারিত স্থান চিল মীরসরাই থেকে সীতাকুন্ড। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই জোনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর হয়ে ওঠায় তারা ঘাঁটি গেড়েছে নোয়াখালীতে।
তিনদিন আগে পোশাক কারখানা থেকে চুরি হওয়া ১০১ রোল কাপড় উদ্ধারের পাশাপাশি পিচ্চি মাসুদসহ তার গ্রুপের দশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), চট্টগ্রাম মেট্রো। চুরির ঘটনায় ব্যবহৃত একটি প্রাইভেটকার জব্দ করা হয়। গ্রেপ্তার ১০ জন হলেন মো. মাসুদ আলম প্রকাশ পিচ্চি মাসুদ ওরফে ডন মাসুদ (৪৭), মো. আবুল বশর প্রধান (৪৫), মোহাম্মদ ফারুক (৪০), মোহাম্মদ হৃদয় (২০), মোহাম্মদ মুজিবুল হক (৪৫), মো. পারভেজ (২৬), মো. ইউসুফ প্রকাশ ইউসুফ ভান্ডারি প্রকাশ কালু (৫২), মো. আলমগীর (৩৮), মো. সামছুল আলম (৫৩) ও মো. আরিফুর রহমান চৌধুরী (৪০)। আসামিদের মধ্যে প্রথম ৫ জনকে বৃহস্পতিবার গ্রেপ্তার করা হয়। বাকিদের শুক্রবার রাতে নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদেরকে গতকাল আদালতে পাঠানো হয়েছে।
কী ঘটেছিল? : পিবিআই, চট্টগ্রাম মেট্রো পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা জানান, চোরেরা গত ১৮, ২৩ এবং ২৬ আগস্ট পটিয়ায় পাচুরিয়া হুলাইন এলাকার দি নীড অ্যাপারেলস (প্রা.) লিমিটেড নামের একটি পোশাক কারখানার ওয়্যারহাউস থেকে ১৪৮ রোল কাপড় চুরি করে। যেগুলো ঢাকায় যাওয়ার কথা ছিল। নগরীর টেরিবাজার কাটা পাহাড় এলাকায় চুরি যাওয়া কাপড়ের ১০১টি রোল পাওয়া যায়। একটি মিনি ট্রাকের মধ্যে পরিত্যক্ত অবস্থায় কাপড়গুলো পায় পুলিশ। গত ২৬ আগস্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাগণ ওয়্যার হাউজে প্রবেশ করলে চুরির ঘটনা জানতে পারে। তিনি আরও জানান, চুরির ঘটনায় থানায় এবং বিজিএমইএ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীদের অবহিত করে। এ ঘটনায় কোতোয়ালী থানায় মামলা করা হয়। উদ্ধারকৃত ১০১ রোল কাপড় বা ১১৯৫৯ গজ কাপড়ের মূল্য আনুমানিক ১ কোটি টাকা।
যেভাবে গ্রেপ্তার : মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক মো. ইলিয়াস খান আজাদীকে বলেন, সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায় ১৮ আগস্ট থেকে ২৬ আগস্টের মধ্যে ৩ দিন রাত ১টা থেকে ৩টার মধ্যে আসামিরা মুখোশ পরে জানালার গ্রিল কেটে দি নীড অ্যাপারেলসের ওয়্যারহাউস থেকে কাপড়গুলো চুরি করে। চুরি করা কাপড় পিকআপ ট্রাকে করে নিয়ে যায় তারা। ঘটনার সময় একটি সাদা রংয়ের পুরাতন মডেলের প্রাইভেটকার ও একটি সিএনজি গাড়ি পাহারা দিয়ে নিয়ে যেতে দেখা যায়। এই ফুটেজের সূত্র ধরে নগরীর কাটাপাহাড় এলাকা থেকে কাপড়গুলো উদ্ধার করা হয়।
এরপর টানা দুই দিন নগরের বিভিন্ন স্থান ও সীতাকুণ্ড, মীরসরাই ও ফেনী জেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী পিচ্চি মাসুদসহ জড়িত আসামিদের মধ্যে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আসামিদের দেওয়া তথ্য মতে ঘটনায় ব্যবহৃত চট্টমেট্রো চ–১১–৫৩৩৬ নম্বরের প্রাইভেটকারটি সীতাকুণ্ড থানার শীতলপুর এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়।
কে এই পিচ্চি মাসুদ? : একসময় বন্দর থেকে মালামাল চুরি করতো ছিঁচকে চোর পিচ্চি মাসুদ। ধীরে ধীরে হাত পাকিয়ে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কে পন্য লোপাট চক্রে যোগ দেয় সে। বছর দুয়েকের মধ্যেই অন্তঃকোন্দলে নিজে পৃথক গ্রুপ গড়ে তুলে সে। ধীরে ধীরে হয়ে উঠে দেশের লাইফ লাইন খ্যাত এ মহাসড়কে অঘোষিত ডন। অন্যরা চুরি করলেও তাকে কমিশন দিতে হতো। বর্তমানে নিজে কাজে অংশ নেয় না। তার নির্দেশে কাজ করে অন্যরা। অভিযানে নেতৃত্বদানকারী পিবিআই সহকারী পুলিশ সুপার এ কে এম মহিউদ্দিন সেলিম আজাদীকে বলেন, গার্মেন্টস থেকে কাপড় চুরির ঘটনায় আন্তঃজেলা চোর চক্রের ২৫ থেকে ৩০ জনের একটি দলের সন্ধান পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে কয়েকজন সরাসরি কাপড় চুরি করেন; কেউ মধ্যস্থতা করেন; অন্যরা চুরি করা কাপড় কম দামে কেনা বেচা করেন। পুরো চক্রটিকে গ্রেপ্তারে আমরা কাজ করছি। এরা ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কে কাপড় চুরির বড় সিন্ডিকেট। যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন তাদের মধ্যে ৫ জন মধ্যস্থতাকারী। নেতৃত্ব দানকারী পিচ্চি মাসুদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা অন্তত ৬০টি। তবে আমরা ২০ ট মামলার খোঁজ পেয়েছি।
৩৪ জনের নিয়ন্ত্রণে পণ্যবাহী গাড়ি ছিনতাই : জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা জানিয়েছে, পণ্যবাহী গাড়ি ছিনতাই চক্রের ৩৪ জন লিডার রয়েছে। তারা হলো, নগরীর নিমতলার সাইফুদ্দিন ওরফে সাইদ, বরিশালের আমির হোসেন, ছোট পোল এলাকার পিচ্চি মাসুদ ওরফে ডন মাসুদ, চাঁদপুরের জসিম উদ্দিন প্রকাশ লোহা জসিম, হালিশহর নতুন পাড়ার রাশেদ, কদমতলীর রাজীব প্রকাশ ডায়মন্ড রাজীব, জসিম প্রকাশ লেংরা জসিম, কুমিল্লার নবী সোহাগ প্রওকাশ নবী নেওয়াজ প্রকাশ নবী, কুমিল্লা লাঙ্গলকোটের বিপ্লব, সন্দ্বীপের আনোয়ার হোসেন প্রকাশ বাবুল, সবুজবাগ, হালিশহরের জসিম, নিমতলা খালপাড়ের জাহাঙ্গীর আলম, বাচ্চু প্রকাশ ঢাকাইয়া বাচ্চু প্রকাশ বরিশাইল্যা বাচ্চু, বহদ্দারহাটের নূর মোহম্মদ, নোয়াখালীর কামাল হোসেন, সীতাকুন্ডের ইসমাইল, ফেনীর মীর হোসেন প্রকাশ সুমন মিয়া, পিচ্চি মাসুদের ভাই জাহাঙ্গির, হালিশহরের জামাল হোসেন, হালিশহরের আজাদ হোসেন, ফেনীর মোহাম্মদ আলী প্রকাশ মীর সবুজ, বড়পুল সাইটপাড়ার ইরফান, নোয়াখালী সোনাইমুরির সাইফুল ইসলাম প্রকাশ চশমা জামাল, হালিশহর ছোটপুলের আজাদ, কাপ্তাই রাস্তার মাথার তৈয়ব, লেদু মাঝি, শাহ আলম, খান সাহেব, কলি ম্যাডাম, নিমতলার তুলা জসিম, টেরিবাজারের ইব্রাহিম সওদাগর, টেরিবাজারের টিটু, নিকসন মার্কেটের সাহাবুদ্দিন ও বড়পোল মইন্যাপাড়ার বরিশাইল্যা নাছির।
পিচ্চি মাসুদের থেকে জানা যায়, কাভার্ডভ্যান কুমিল্লা, মীরসরাই, সীতাকুন্ড বা চট্টগ্রাম শহরে ঢোকা কিংবা বেরুনোর সময় সুযোগ বুঝে পুরো চুরির কাজ শেষ করা হয়। এসব জায়গায় তাদের নির্ধারিত ডিপোতে কাভার্ডভ্যান ঢুকিয়ে ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টার মধ্যেই চুরির কাজ শেষ করে। কাভার্ডভ্যানের সিলগালা করা তালা না ভেঙে তারা দরজার নাট খুলে ফেলে। তারপর ভেতরে থাকা কার্টন থেকে অর্ধেক পণ্য সরিয়ে নিয়ে পুনরায় স্কচটেপ লাগিয়ে দেয়। কোনো কার্টন থেকেই সব পণ্য সরানো হয় না। তিন ভাগের এক ভাগ বা অর্ধেক এভাবে পণ্য সরানো হয়। পরে আবার এসব পণ্য ঢাকা ও চট্টগ্রামের বড় বড় শপিংমলগুলোতে বিক্রি করা হয়। কিছু কিছু রফতানিও করে তারা। আবার কাপড়ের রোলের ক্ষেত্রে তাদের বড় মার্কেট হলো টেরিবাজার ও রিয়াজউদ্দিন বাজার।