ছাত্রাবাস শব্দটির সাথে জড়িয়ে আছে স্নেহ মায়া মমতা ভালোবাসা আদর অহংকার সংগ্রাম প্রতিবাদ ইত্যাদি ইত্যাদি শব্দ। আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক ছাত্রাবাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনে ও সময়ের তাগিদে ছাত্রাবাসগুলো গড়ে উঠেছে। এক সময় বড় বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজগুলো ঘিরে ছাত্রাবাসগুলো গড়ে উঠত। কিন্তু সময়ের ও শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনে বর্তমানে শহর ও উপশহরের বিভিন্ন অঞ্চলে ছাত্রাবাস গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে গ্রাম অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীরা যাতে শহরে এসে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারে সেই উদ্দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঘিরেই ছাত্রাবাসগুলো গড়ে উঠেছে। আমাদের চট্টগ্রাম শহরের প্রধান প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেমন চট্টগ্রাম কলেজ; মহসিন কলেজ; চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ; মহিলা কলেজ ইত্যাদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। জামাল খান; চকবাজার; নাসিরাবাদ ইত্যাদি অঞ্চলগুলোতে অনেক ছাত্রাবাস গড়ে উঠেছে। এই ছাত্রাবাসগুলোতে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অনেক বেশি। বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা যখন আবাসিক হলে সিট বরাদ্দ থেকে বঞ্চিত হয় তখন প্রাইভেট ছাত্রাবাসগুলোতে অবস্থান করে। আবার অনেকেই আপন জনের কাছে থাকার উপযুক্ত জায়গা না থাকাতে ছাত্রাবাসে অবস্থান করে। একটি বিশেষ সময় পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা ছাত্রাবাসগুলো অবস্থান করে। বিশেষ করে নবম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ছাত্রাবাসে থাকে। এই বছরগুলোতে তারা নিজেদেরকে তৈরি করার জন্য ছাত্রাবাসে থেকে লেখাপড়া চালিয়ে যায়। পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে যে যার জায়গায় চলে যায়। এরপর উচ্চ শিক্ষার জন্য আবার নতুন করে ছাত্রাবাসের সন্ধান নেয়। অনেকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর আশেপাশে ভাড়া বাসায় নিজেদের পছন্দ মত আবাস গড়ে তোলে। তারা তাদের নিজস্ব পছন্দ মত খাবারদাবার ও অন্যান্য বিষয়গুলো উপভোগ করতে পারে। এক্ষেত্রে তার পারিবারিক সমর্থন ও আর্থিক সামর্থ্য বিশেষভাবে প্রয়োজন। কিন্তু যারা আবাসিক হলগুলোতে থেকে লেখাপড়া চালিয়ে যায় তাদেরকে কিছু কিছু নিয়ম কানুন মেনে চলতে হয়। আসা যাওয়ার ব্যাপারটা খুব বেশি মেনে চলতে হয়। বিশেষ করে একটা নির্দিষ্ট সময়ে ছাত্রাবাস থেকে বের হওয়া এবং রাতের একটি নির্ধারিত সময়ে ছাত্রাবাসে প্রবেশ করা। শিক্ষার্থীরা ছাত্রাবাসের নিয়ম নীতি নিয়ে সব সময় চিন্তায় থাকেন। ঠিক তেমনি ছাত্রাবাস পরিচালনা পরিষদের সদস্যরা সতর্ক থাকেন। ছাত্রাবাসে থাকাকালীন সময়ে তারাই যেন তাদের একান্ত আপনজন। তাই সকলে সকলের ভালো মন্দ সুবিধা অসুবিধা বিবেচনা করে তাদের প্রয়োজনীয় কাজগুলো শেষ করে থাকে। তবুও কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনিয়ম থেকে যায়। কারণ সবার মাঝে কয়েক জন থেকে যায় যারা কোনও নিয়মের তোয়াক্কা করে না অথবা মেনে চলতে পারে না। যারা এই নিয়মের তোয়াক্কা করে না তারা শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়। কখনো কখনো নিজেকে শুধরানোর চেষ্টা করে আবার কখনো কখনো নিজস্ব নিয়মে নিয়ম ভাঙ্গে। জীবন ও জীবিকার তাগিদে কেউ কেউ আবার নিয়ম মেনে চলতে পারে না অর্থাৎ তাকে বাইরের কিছু বিশেষ প্রয়োজনীয় কাজ করতে হয়। লেখাপড়ার বিষয়ে অথবা বাইরে টিউশনি করে কেউ কেউ নিজের লেখাপড়া চালিয়ে যায়। শিক্ষার্থীদের পক্ষে ছাত্রাবাসের সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদের সময়গুলো মানাতে অনেক কষ্টকর হয়ে যায়। তবুও সবার ভালো মন্দ চিন্তা করে ছাত্রাবাসের নিয়ম কানুন মেনে চলার চেষ্টা করে। যেখানে নিয়ম শৃঙ্খলা মানা হয় না সেখানে অনিয়মের ফলে সুন্দর পরিবেশ থাকে না। যারা ছাত্রাবাসে থাকে তাদেরকে অন্যের লেখাপড়ার পরিবেশ সৃষ্টির দিকে লক্ষ্য রাখা উচিত। কারণ একমাত্র লেখাপড়ার কারণেই পরিবারের পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ নতুন একটি পরিবেশে তাদের শিক্ষা জীবন শুরু করে।
এই ছাত্রাবাসগুলোতে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের অনেক ধরনের অভিযোগ থাকে। বিশেষ করে খাওয়া দাওয়া নিয়ে শিক্ষার্থীদের অভিযোগগুলো লক্ষণীয়। অনেক সময় বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ও প্রচার মাধ্যমে ছাত্রাবাসগুলোর খাবার দাবার নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়। বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে ছাত্রাবাসগুলো আছে সেগুলোর ব্যবস্থা খুবই শোচনীয়। খুবই নিম্নমানের খাওয়ার পরিবেশন করা হয়। যে ডাল পরিবেশন করা হয় সেখানে এক গামলা পানির নিচের তলানিতে সামান্য ডাল দেখা যায়। ডালের সাথে প্রতিদিন সবজি থাকে। আর কখনো মাছ অথবা মাংস থাকে। বেশির ভাগ সময়ে মুরগির মাংস থাকে। যেহেতু ওখানে বিভিন্ন ধর্মের ছেলেমেয়েরা অবস্থান করে তাই তাদের সকলের জন্য প্রযোজ্য খাদ্যটাই নির্বাচন করা হয়। যেদিন মাংস থাকে সেদিন শিক্ষার্থীদের মধ্যে খুব আনন্দ দেখা যায়। একটা উৎসব উৎসব পরিবেশ বজায় থাকে। কিন্তু টেবিলে এসে মনটা খারাপ হয়ে যায়। বাটিতে একটা ছোট টুকরা মাংস ও হাড্ডির সাথে আলু থাকে। অনেকে ছাত্রাবাসে নিজেরাই রান্না করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজেদের পছন্দমত বাজার করে কয়েকজন মিলে রান্না করে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা ছাত্রাবাসগুলোতে অবস্থান করে। পরিবারে অবস্থানকালীন সময়ে এই আদরের সন্তানেরা ভালো–মন্দ অনেক কিছু খেয়ে থাকে। প্রতিদিন কিছু না কিছু মজাদার ও ব্যতিক্রমী খাবার খেয়ে থাকে। তাছাড়া মাঝেমাঝে নিজের পছন্দ অপছন্দ মত মা বাবাকে আবদার করে থাকে।কিন্তু ছাত্রাবাসগুলোতে নিজের পছন্দ বলতে কিছুই নেই। প্রতিদিন গড়পরতা সেই নিয়মে খাওয়া–দাওয়া হয়। একটি নির্দিষ্ট সময়ে সবাইকে একসাথে পরিবেশন করা হয়। বর্তমান বাজার দরের সাথে তাল মিলিয়ে ছাত্রাবাস গুলোর ডাইনিং এর প্রতিদিনের খাওয়ার তালিকার মান বজায় রাখা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে। কারণ দ্রব্যমূল্য উর্ধগতির কারণে প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। তাই আগে যে পরিমাণ বাজার সদাই করার জন্য একটা নির্দিষ্ট অংকের টাকা প্রয়োজন হতো সে একই নির্দিষ্ট অংকের টাকা দিয়ে বর্তমানে সমপরিমাণ বাজার সদাই করা যায় না। তাই খাওয়ার মান বজায় রাখাটা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পূর্ণ শিক্ষার্থীদের দেওয়া টাকার উপরেই চলে। ওখানে কারো কোন পৃষ্ঠপোষকতা থাকে না। তাই দ্রব্যমূল্য ও অন্যান্য ব্যয়ের কারণে খাবার–দাবারের পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষেত্রেও খরচ বেড়ে যায়। বিদ্যুৎ বিল ও পানির বিলের সাথে সাথে আনুষঙ্গিক বিষয়গুলোর খরচ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে তাদের খাদ্যাভ্যাস একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে পড়াশোনার জন্য তাদের যেই হারে কঠোর পরিশ্রম করতে হয় সেই পরিশ্রমের সাথে সাথে তাদের পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করা অপরিহার্য। কারণ খাদ্যাবাসে কোন ধরনের ঘাটতি থাকলে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশেও চরম প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু আমরা সব সময় দেখে এসেছি আমাদের ছাত্রাবাস গুলোতে খুবই নিম্নমানের খাদ্য পরিবেশন করা হয়। আমাদের আদরের সন্তানরা লেখাপড়ার জন্য পারিবারিক পরিবেশ ছেড়ে যখন ছাত্রাবাসে অবস্থান করে তখন তাদের খাদ্য তালিকা মেনু দেখে অবাক হয়ে যায়। অভিভাবকরা সাধ্য ও সামর্থ্য অনুযায়ী মজাদার খাদ্য দেওয়া চেষ্টা করেন। তাছাড়া শিক্ষার্থীরাও ঘরে থাকা অবস্থায় নিজেদের প্রচেষ্টায় কিছু কিছু ভালোমন্দ তৈরি করে খেয়ে থাকে। কিন্তু ছাত্রাবাসের অবস্থা সম্পূর্ণ বিপরীত। একজন শিক্ষার্থী তার শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রমের জন্য যতটুকু শ্রম ব্যয় করেন ছাত্রাবাসে থাকাকালীন সময় সে পরিমাণ পুষ্টিকর খাওয়া হয়ে থাকে না। কারণ নিজের থেকে তৈরি করার যেমন সমস্যা থাকে ঠিক তেমনি আর্থিক বিষয়টিও থেকে যায়। বিশেষ করে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদেরকেই এই সমস্যার বেশি সম্মুখীন হতে হয়। বৈশ্বিক মন্দার কবলে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলো ক্রয় করা অনেক কষ্টকর হয়ে পড়েছে। ছাত্রাবাসের খরচ মিটিয়ে একটু উন্নত মানের খাওয়া কিনতে গেলে সারা মাসের নির্ধারিত টাকার বেশ বড় অংশ শেষ হয়ে যায়। তাছাড়া শিক্ষার সাথে জড়িত অন্যান্য জিনিসগুলো ক্রয় করতে গেলেও তাদেরকে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। শিক্ষা উপকরণের মূল্য দিন দিন যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে সে ক্ষেত্রে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর জন্য অনেক বেশি কষ্টকর হয়ে পড়েছে। নিজেদের প্রয়োজনে তারা একজন আরেকজনের সাহায্যে এগিয়ে আসে। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষার্থীদের যাতায়াত খরচের পরিমাণ অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বাসে টেম্পু করে যাতায়াত করে। কিন্তু বর্তমানে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদেরকে অধিক হারে ভাড়া গুনতে হচ্ছে। তাছাড়া অধিকাংশ তাদেরকে নাস্তা পানির জন্য অধিকার হারে অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। বেশ কিছুদিন আগেও একজন শিক্ষার্থী প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ টাকার তার সারাদিনের খরচ মিটিয়ে ফেলতে পারতো। কিন্তু বর্তমানে সেই টাকার পরিমান খুবই নগণ্য। বর্তমানে দেড়শ থেকে ২০০ টাকা ছাড়া সারাদিনের খরচ মেটানো অনেক কষ্টকর। এমতাবস্থায় শিক্ষা গ্রহণ যেন শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক; অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ,
ডা. ফজলুল–হাজেরা ডিগ্রি কলেজ।