চ্যালেঞ্জের বাজেট : আশায় বসতি

অভীক ওসমান | বৃহস্পতিবার , ১৬ জুন, ২০২২ at ৮:৫১ পূর্বাহ্ণ

‘বাজেটে মুড়ি ও হেলিকপ্টারের দাম কমেছে’। কোনটা কিনবো? এরকম একটা সচিত্র ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখলাম। একাত্তরের মুজিব নগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ একটা অন্তর্বর্তীকালীন বাজেট দিয়েছিলেন। পরে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় ১৯৭১-৭২-৭৩ এর জন্য প্রায় ৫০০ কোটি টাকার বাজেট দিয়েছিলেন। সুখের বিষয় আমাদের সুপ্রিমো শেখ হাসিনার সময় ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট করা হলো। এবার বাজেটের থিম ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’। অথচ স্বাস্থ্য খাতে বাজেট তেমন বাড়েনি। সমপ্রতি শেখ হাসিনা আক্ষেপ করেছেন, ‘ভ্যাক্সিন দিয়ে জান বাঁচালাম ওরাই মোনাফেকী করছে’। জনগণ মনে করেন, কোভিড, মাঙ্কি পক্স এ ধরনের আগামীর সম্ভাব্য সংক্রামক ব্যাধির চিকিৎসা ও গবেষণার জন্য বাজেটে একটা বিশেষ বরাদ্দ রাখা উচিত ছিলো।
টিপিক্যালী বলতে গেলে করোনা পরবর্তী অভিঘাত-রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, শ্রীলংকার এক্সপেরিয়েন্স একটা বৈশ্বিক শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ তার বাইরে নয়, তাই মূল্যস্ফীতি প্রধান শঙ্কাসহ ৬ চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এর পর কালো মুদ্রা সাদা করার ঘোষণা সম্পর্কে থিংক ট্যাংকগুলো ছাড়াও আমরা বলি এটি অনৈতিক, অযৌক্তিক। বিদেশে পাচারকৃত অর্থ সম্পদ ৭% রিটার্নে ফেরত আসবে। তাহলে রুলিং পার্টি স্বীকার করে নিচ্ছে পাচার হয়েছে। এফবিসিসিআই বলছে- এই টাকা ফেরত আনা এত সহজ নয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, পাচার করলো কারা? বঙ্গবন্ধু যেমন বলেছিলেন, ‘আমার কম্বল কই?’ আপনি যেমন বলেন, ‘কাফনের কাপড় বিতরণ করলে, অল্প কেটে রেখে দেবে। ‘বলা হচ্ছে ব্যবসাবান্ধব বাজেট। এই ব্যবসায়ী কারা? আপনি যেমন দল ও অংগসংগঠনসমূহ সম্পর্কে বলেছেন, ‘পদ পদবী দেয়ার সময় তাদের পরিবারের চৌদ্দ গোষ্ঠির খবর নিয়ে দেবেন’। এতো কর সুবিধা, প্রণোদনা যাদের দিচ্ছেন। কারা কর প্রণোদনা পাচ্ছে, তার তালিকা ট্রেডবডি প্রধানদের দিতে বলুন। আমাদের জানা মতে বেনিফিশিয়ারীদের গরিষ্ঠসংখ্যক লোক ৭১, বঙ্গবন্ধু ও আপনার আদর্শের বিরোধী। বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে বেশি প্রশ্ন করা হয়েছে অর্থ পাচার নিয়ে। (১০ জুন, ২০২২)
ষাটোর্ধদের জন্য ১৮-৫০ বছরের জন্য সামাজিক পেনশন প্রস্তাব বেশ আলোচিত হচ্ছে। শেখ হাসিনার আমলে আশ্রয়ণ, বিধবা ভাতা, স্বামী পরিত্যক্ত, একটি বাড়ি একটি খামার এ ধরনের প্রকল্প প্রশংসনীয়। জনকল্যাণ বিষয়ক অর্থনীতি একটা ভালো ধারণা। (এ. সি পিগো ১৯১২, অমর্ত্য সেন ১৯৯৯) কিন্তু আমলা ও রুলিং পার্টির সিস্টেম লসের এই সুবিধা ৩০% পায় না।
ঢাকা চেম্বার সহ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই বাজেট সরকারকে ব্যাংকের উপর নির্ভরশীল করে তুলবে। এটা ভালো দিক নয় এমনিতেই প্রচুর প্রাইভেট ব্যাংক ও লিজিং অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এটা ব্যাংকের স্থায়ী আমানতের উপর আঘাত হানবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটি একটি আনহেলদি ব্যাংক ব্যবস্থা গড়ে তুলবে।
শিক্ষাখাতে তেমন ব্যয় বাড়েনি। সংস্কৃতি ক্ষেত্রে ১% বাজেট দেয়ার দাবী উঠেছে। অতীতে রেলের জন্য আলাদা বাজেট দেয়া হতো। কিন্তু এবার রেলে বেশ বড়ো বাজেট দেয়া হয়েছে। এই বাজেটে ৮৭ হাজার ২৩০ গ্রামে কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রকল্প রয়েছে। কর্মসংস্থান অধিদপ্তর নামে একটি অধিদপ্তর খোলা হয়েছে। পোল্ট্রি, গো খাদ্য পাওয়ার ট্রিলার কর ছাড়, ফার্টিলাইজারে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি, চাল ও গম সংগ্রহের লক্ষ্য মাত্রা বাড়ানো পজিটিভ দিক। তবে বড়ো কর্পোরেট হাউজগুলো চাল প্যাকেটজাতকরণ নিরুৎসাহিত করা উচিত।
ব্যক্তিখাতে ইনকাম ট্যাক্স ৩ লাখ টাকা রয়ে গেছে। এটা বাড়ানো উচিত ছিলো। তৈরি পোশাক খাতের মতো অন্যান্য খাতের এক্সপোর্ট সমান সুবিধা পাবে। এটা এক্সপোর্ট বাস্কেটে নতুন মাত্রা যুক্ত হবে। বিশেষ করে ইস্পাত খাতে প্রণোদনা বাড়ানো উচিত। দেশীয় সমুদ্রগামী জাহাজ নির্মাণের সুবিধাকে স্বাগত জানাই। কর পরিধি অবশ্যই বাড়াতে হবে। পেশাজীবীসহ, প্রাইভেট শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে করারোপ করা যেতে পারে। তবে নিম্নবিত্ত, দেশীয় কটেজ ক্ষুদ্র মাঝারী নারী উদ্যোক্তাদের স্বস্তি ও প্রণোদনা দিতে হবে।
এরকম প্রবাদ আছে যে, চট্টগ্রাম চেম্বারের বাজেট প্রস্তাবনা না পেলে করাচী বাজেট প্রণয়নে হাত দিতো না। আমার পেশাগত জীবনে আমি ২৯ টি বাজেট কম্পাইল করেছি (১৯৮৫-২০১৪) । সকল সদস্যদের কাছে সার্কুলার দিয়ে সাজেশন নেয়া, স্ট্যাডিং সাব কমিটির বৈঠক, বোর্ডে পাস করে বাজেট পাঠানো বেশ ঝক্কিঝামেলার ব্যাপার ছিলো। মূল্য সংযোজন কর ঘোষণার পর (১৯৯১) তা আরও কঠিন হয়ে উঠলো। বাজেট ঘোষণার দিন ইমারজেন্সি মিটিং কল করা হতো। সাদাকালো টিভিতে বোর্ড মেম্বাররা দেখতেন, বিকল্প হিসেবে রেডিওতে রেকর্ডিং করে শোনা হতো। বিকেল থেকে রিয়েকশানের জন্য সাংবাদিকদের কল আসতো। রাত বারটা পর্যন্ত আমরা রেসপন্স করতাম। বেশ একটা স্ট্রেসফুল ও উৎসবমুখর দিন। আমার ফ্যামিলি জানতো আমি গভীর রাতে বাড়ি ফিরবো। ১৯৯৩ সালের দিকে আমি ইনডেপথ না গিয়ে, প্রেস রিলিজে চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রাথমিক ও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া শব্দগুলো সংযুক্ত করি। তা এখনও চলছে। (চেম্বার সচিবালয়ে তিন দশক বইয়ের লেখকের পাণ্ডুলিপি)। এই বাজেটে চট্টগ্রাম চেম্বার আড়াই পার্সেন্ট কর্পোরেট কর হ্রাস করায় সন্তোষ প্রকশ করেছে।
শংকা ও চ্যালেঞ্জের মাঝে অর্থমন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ দিয়ে শেষ করেছেন, ‘আপনা মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়’। সংযুক্ত করেছেন গালিবের গজল, ‘রাতদিন গর্দিশ ম্যা হ্যায় সাত আসমা/ হো রহেগা কুছ না কুছ ঘাবড়ায়ে ক্যায়া’। প্রিয় পাঠক, আসুন আমরা আশায় বসত বাধি।
লেখক : সাবেক সচিব, চট্টগ্রাম চেম্বার ও উন্নয়ন বিষয়ক গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাল আজ কাল
পরবর্তী নিবন্ধবিভিন্ন স্কুলে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বিদায় সংবর্ধনা