বাংলাদেশ–ভারত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চলছে চোরাই মোবাইলের রমরমা ব্যবসা। ভারতে ছিনতাই বা চুরি হওয়া মোবাইল আসছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ থেকে একই কায়দায় মোবাইল সেট যাচ্ছে ভারতে। বাংলাদেশ–ভারত সীমান্ত এলাকার উভয় পাশে একের পর এক চোরাই মোবাইল উদ্ধারের ঘটনার তদন্তে নামার পরই পুলিশের হাতে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। কলকাতা পুলিশ ও বাংলাদেশ পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করছে। সর্বশেষ গত ২৪ এপ্রিল কলকাতার সরকারপুল এলাকা থেকে চুরি হওয়া একটি আইফোন নগরীর জলসা মার্কেট থেকে উদ্ধার করেছে সিএমপির ডিবি পুলিশ। ৬ জুলাই ফোনটি মালিক দিপান্বিতা সরকারকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।
উদ্ধার অভিযান পরিচালনাকারী সিএমপি ডিবির (বন্দর ও পশ্চিম) এসআই রবিউল ইসলাম আজাদীকে জানান, দিপান্বিতার হারানো ফোনটি উদ্ধার করতে গিয়ে এই চক্রের নেটওয়ার্ক সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছি। চট্টগ্রামের চারজন মোবাইল ব্যবসায়ী পুরো সিন্ডিকেটটির নেতৃত্ব দেন। প্রতি সপ্তাহে এদের একেকজন ২০০/৩০০ চোরাই মোবাইল ফোন কলকাতা হয়ে বাংলাদেশে পাচার করেন। একইভাবে বাংলাদেশ থেকে চোরাই মোবাইল চলে যায় ভারত, নেপাল, ভূটান ও মালদ্বীপে। আমরা পুরো চক্রটিকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালাচ্ছি।
ভারত থেকে যেভাবে ও যে কারণে আসছে মোবাইল : নগর গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, বাংলাদেশের বাজারে ভারতীয় চোরাই মোবাইলের খুব চাহিদা। সেখানে চড়া দামে এ দেশের চোরাই মোবাইলগুলো বিক্রি হয়ে যায়। তাছাড়া পাচার করতেও তেমন কাঠখড় পোড়াতে হয় না কারবারিদের। চুরি করা সেলফোনের ছবি ও বিশদ বিবরণ একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে আপলোড করে চোরাচালানকারীরা। এই গ্রুপে বাংলাদেশি ও কয়েকজন নেপালিও রয়েছে। চুরি হওয়া ফোনগুলো কেউ পছন্দ করেলে সেগুলো প্যাকেট করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়। এখানেই শেষ নয়। ভারতীয় চোরাই মোবাইল ফোন বাংলাদেশে পাচারের মূল কারণটিও জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তাগণ জানিয়েছেন, অপরাধীরা সেলফোনগুলো ভারতের বাইরে বিক্রি করে। এর ফলে চোরাই সেলফোনের আইএমইআই নম্বর মুছে ফেলার জন্য অর্থ ব্যয় করতে হয় না, যার ভিত্তিতে পুলিশ তাদের শনাক্ত করতে পারে না। একবার ফোন অন্য দেশে চলে গেলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আইএমইআই নম্বর দিয়ে বেশি কিছু করতে পারে না। বাংলাদেশের মতো ভারতেও অবৈধভাবে আইএমইআই নম্বর মুছে ফেলে এমন সব সেবাদাতার বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক পুলিশি অভিযানের ফলে অপরাধীরা সীমান্তের এপারে সেলফোন পাঠানো শুরু করেছে। এসব চোরাই মোবাইল কিনে কেউ ভারতসহ যেকোনো দেশে ভ্রমণে গেলে সেই দেশের আইনশৃক্সখলা বাহিনীর হাতে সহজে ধরা পড়তে পারেন।
একই কায়দায় যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকেও : চট্টগ্রামসহ সারা দেশে চুরি–ছিনতাই হওয়া মোবাইল সেট কেনাবেচায় ‘ভালো দাম’ পেতে পাচার হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। ইদানীং নেপাল, ভূটান ও মালদ্বীপেও যাচ্ছে চোরাই ফোন। সেখানে এসব চোরাই পণ্যের রমরমা বাণিজ্য গড়ে উঠেছে। বর্তমানে এমন ধরনের ঘটনা প্রায় ঘটছে বলে জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চোরাই বা ছিনতাই হওয়া নামিদামি ব্র্যান্ডের মোবাইল ফোন এজেন্ট বা চক্রের সহায়তায় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, নেপালসহ বিভিন্ন দেশে নিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। এসব কেনাবেচা এবং বিদেশে পাচারের ক্ষেত্রে মাধ্যম বা এজেন্ট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছেন এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী।
জানা গেছে, চোরাই মোবাইল কেনাবেচার সময় চার্জার দেওয়া হয় না। এমনকি পুরাতন চোরাই মোবাইলের ব্যাটারি ও ক্যাচিং বদলে দেওয়া হয়। এতে করে ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছেন।
যেভাবে উদ্ধার হলো দিপান্বিতার মোবাইল : কলকাতার বাসিন্দা দিপান্বিতা সরকার গত ২৫ এপ্রিল স্থানীয় মহেশতলা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন, তার আইফোনটি হারানো গেছে। মোবাইল হারানোর কিছুদিন পরে তার কাছে একটি ইমেইল যায়, হারানো মোবাইলটি চট্টগ্রাম শহরে চালু হয়েছে। তখন তিনি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ফেসবুক অফিশিয়াল পেজে যোগাযোগ করে তার জিডি ও মোবাইলটি চালু করার লোকেশন পাঠান। ডিবি বন্দর–পশ্চিমের এসআই রবিউল বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করেন। আইএমইআই নম্বর দিয়ে ফোনটি পাওয়া না যাওয়ায় শুরু থেকে টেকনোলজি ব্যবহার ও ম্যানুয়ালি নানা কৌশলে কাজ করে ৪ জনকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়, যারা ভারত থেকে চোরাই মোবাইল চট্টগ্রামে এনে রেয়াজউদ্দিন বাজারের তামাকুমন্ডি লেনে খুচরা দোকানদারদের কাছে পৌঁছে দেন। তারা একেকজন সপ্তাহে ২০০–৩০০ চোরাই ফোন নিয়ে আসেন এবং মোবাইল মার্কেটগুলোতে সাপ্লাই দেন। তাদের একজন আবার জলসা মার্কেটের ব্যবসায়ী। ফোনটির লোকেশনও দেখাচ্ছিল জলসা মার্কেট। তাকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালানোর আগেই তিনি ফোনটি লোক মারফত পাঠিয়ে দিয়ে দোকান বন্ধ করে পালিয়ে গেছেন। তাকেসহ সিন্ডিকেটের বাকি তিনজনকে ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে বলে জানান এসআই রবিউল।