রহমতগঞ্জের একটু সামনে এক পথচারীকে ছুরিকাঘাত করে গত ১৬ নভেম্বর মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয় তিন তরুণ-তরুণী। এর আগে নগরীর জামালখান এলাকায় তারা মোবাইল ছিনতাই করে। পরদিন ১৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় নগরীর চকবাজার এলাকায় মোবাইল ছিনতাই করে। এরপর রাত ৮টার দিকে সার্সন রোডে সিজিএস স্কুলের পাশে আগের দিনের মতো ছুরিকাঘাত করে সেলিম নামে এক যুবকের মোবাইল ফোন নিয়ে চলে যায়। এসব ঘটনায় দুটি চক্রের আট সদস্যকে গ্রেপ্তার করে কোতোয়ালী থানা পুলিশ। কোতোয়ালী থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন আজাদীকে বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে একটি গ্রুপের দলনেত্রী নিপা জানিয়েছেন, ছিনতাই করে পাওয়া মোবাইল ফোনগুলো তারা পুরাতন রেল স্টেশন সংলগ্ন চোরাই মার্কেটে মোবাইল বিক্রেতা আলাউদ্দিনের কাছে বিক্রি করে। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে।
প্রাইভেট কার চালক আইয়ুব আলী ঢাকা থেকে বেড়াতে এসেছিলেন চট্টগ্রামে। ৪ সেপ্টেম্বর রাতে রিকশা করে যাওয়ার পথে আগ্রাবাদ চৌমুহনী এলাকায় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে তিনি মারা যান। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে ডবলমুরিং থানার ওসি সদীপ কুমার দাশ আজাদীকে জানান, ছিনতাইকারী চক্রটির সদস্যদের থেকে ছিনতাই করা মোবাইল কেনেন পুরাতন রেল স্টেশন এলাকার চোরাই মার্কেটের আলী আকবর নামে এক ব্যক্তি। পরে আলী আকবর এসব মোবাইলের আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করে বিক্রি করেন।
গত বছর ১ ডিসেম্বর ১৫ জন মোবাইল চোরকে গ্রেপ্তার করেছিল কোতোয়ালী থানা পুলিশ। সিএমপির উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) এস এম মেহেদী হাসান সে প্রসঙ্গে জানান, ১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পুরাতন রেল স্টেশন এলাকায় চুরিকৃত মোবাইল বিক্রির জন্য চোরচক্র জড়ো হয়েছিল খবর পেয়ে পুলিশ এদের গ্রেপ্তার করে। তিনি বলেন, এরা চলন্ত বাস বা মার্কেটে কৃত্রিম ভিড় তৈরি করে পকেট থেকে সেকেন্ডেই মোবাইল চুরি করতে ওস্তাদ। এছাড়া পথচারীদের কাছ থেকে ছোঁ মেরে মোবাইল বা ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়া ও ছুরি ধরে ছিনতাই করে। সারাদিনের ছিনতাই শেষে সন্ধ্যায় কোতোয়ালী থানার পুরাতন রেল স্টেশনে এসব মালামাল বিক্রি করতে আসে।
গত বছর ১২ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে চুরি ছিনতাইয়ের ১৮ টি মোবাইল ফোন নিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর পুরাতন রেলস্টেশন চোরাই মার্কেটের বাগদাদ হোটেলের গলিতে প্রবেশের সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সাইফুল ইসলাম সজীব (২৮) নামে এক যুবক।
উল্লিখিত ঘটনাগুলো প্রমাণ করে নগরীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্পট রেল স্টেশনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা চোরাই মার্কেটটি চোর, ছিনতাইকারী কিংবা মাদকাসক্তদের কাছে কতোটা জনপ্রিয়। অন্য কোনো নাম নেই মার্কেটটির, বলা হয় ‘চোরাই মার্কেট’। নগরীর কোতোয়ালী থানার নতুন ও পুরাতন রেল স্টেশনের মাঝামাঝি এলাকা এবং আশপাশের ফুটপাতজুড়ে গড়ে ওঠেছে এ মার্কেট। এখানকার দোকানিদের কাছে ঠিকানা জানতে চাইলেও তারা অকপটে জানায়, ‘চোরাই মার্কেট’। নগরীর অধিকাংশ মানুষ জানে, ঘর বা দোকান থেকে চুরি করা; যা-ই হোক না কেন, চোরাই মার্কেটে একবার ঢুঁ দিলে নগদের বিনিময়ে কিছু জিনিস ফেরত পাওয়া যেতে পারে। তবে জিনিসটা নিজের বাসা কিংবা দোকানের এমন দাবি করলে উল্টো গণপিটুনি খাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে নিশ্চিত। চোরাই মার্কেটে কারা ব্যবসা করেন এসব পণ্য কোথা হতে আসে কিছুই অজানা নয় পুলিশের। মাঝেমধ্যে অভিযান চালানো হয়। অভিযোগ রয়েছে, অভিযানগুলোর বেশির ভাগই লোকদেখানো। অভিযানের পর দিনকয়েক সাবধানে চলে ব্যবসা। তারপর আবার শুরু হয় পুরোদমে। যেমন গত ১৭ নভেম্বর কোতোয়ালী থানায় ছিনতাইকারী গ্রুপের আট সদস্য ধরা পড়েছে এবং সেখানে চোরাই মার্কেটের এক ব্যবসায়ী আলাউদ্দিনও আছে জানার পর গতকাল থেকে নিজেরা যুক্তি করে চার দিনের জন্য চোরাই মার্কেটের দোকান বন্ধ রেখেছে। চোরাই মার্কেটের সাধারণ দোকানিরাই জানিয়েছেন, আপনাদের লেখালেখির কারণে পুলিশ ডিস্টার্ব করে কয়েক দিন। পরে অবশ্য ঠিক হয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে কোতোয়ালী থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন আজাদীকে বলেন, প্রথম কথা হচ্ছে মানুষকে সচেতন হতে হবে। যে মার্কেটের নাম চোরাই মার্কেট, সে মার্কেট থেকে আমি জিনিস কিনবো কেন? আর আমি-আমরা না কিনলে মার্কেটটাতো এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি বলেন, নিউমার্কেট থেকে পুরাতন রেল স্টেশন পর্যন্ত ফুটপাতে গড়ে ওঠা দোকান উচ্ছেদ করার দায়িত্ব আমাদের নয়। তবে এই দোকান ঘিরে কোনো অপরাধ বা অবৈধ কিছু কেনাবেচা হলে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমাদের অভিযানে চোরাই মোবাইলসহ এখানকার অনেক দোকানদার ধরা পড়েছে। আমরা আলাউদ্দিনকে ধরেছি, এর আগে জানেআলম ধরা পড়েছে, কাইয়ূম ধরা পড়েছে, আরো অনেকেই ধরা পড়েছে। কিন্তু ধরা পড়ার পর জামিনে এসে আবার একই কায়দায় ব্যবসা করছে।
গতকাল থেকে পুলিশী অভিযানের মুখে দোকান বন্ধ রাখলেও ভিন্ন কায়দায় মোবাইল কেনাবেচার দৃশ্য দেখা গেছে। পথচারীদের কাছে গিয়ে একজন জানতে চাইছে, মোবাইল বিক্রি করবে কিনা। রাজি হলে দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়ছে গলির ভেতরে। অনেকে আবার এসে ফুটপাতে মোবাইলের দোকান না দেখে এদিক ওদিক দেখছিলেন। তা দেখে পথচারী বেশে একজন বা দু’জন এসে বন্ধুর মতো কথা বলতে বলতে চলে যাচ্ছেন একটু আড়ালে। দরদামে হলে কেনাবেচা হচ্ছে ঠিকই।
সরেজমিন গত ১৬ নভেম্বর সোমবার সন্ধ্যায় দেখা গেছে, চোরাই মার্কেটে দুই শতাধিক দোকানের পরিসর বড় নয়। ছোট ছোট কাঠের চৌকি কিংবা কাচের শোকেজ বানিয়ে সাজানো হয়েছে নানা পণ্যের পসরা। চোরাই পণ্যের এ মার্কেটে চুরি করে আনা ঘড়ি, মোবাইল, জুতা, ইলেকট্রনিঙ সামগ্রী থেকে কাপড়-চোপড় পাওয়া যায়। ছিনতাইকারী ও পকেটমাররা এই মার্কেটে মোবাইল ফোন বিক্রি করে। চোর-ডাকাতরাও লুণ্ঠিত পণ্য এই মার্কেটে বিক্রি করে বলে জানা গেছে।
১৬ নভেম্বর দুপুরে চোরাই মার্কেটে কলেজ ছাত্র শাওনের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি জানান, চার হাজার টাকায় স্যামসাং গ্যালাঙি জে ওয়ান স্মার্টফোন কিনলাম। শো-রুম থেকে এ মোবাইল কিনতে গেলে ৮ হাজার টাকা লাগত। সামান্য পুরনো হলেও অনেক সস্তায় পেয়েছি। তাই কিনে নিলাম। এভাবে দাম কম থাকায় চোরাই মার্কেটের প্রতি ঝোঁক বেশি নিম্ন আয়ের ক্রেতাদের।
সন্ধ্যার পর এ মার্কেটে ভিড় সামাল দিতে অনেক দোকানে একাধিক বিক্রেতাকেও কাজ করতে দেখা গেছে। ক্রেতা সেজে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চোরাই মোবাইল কেনার পর ‘পুলিশি ঝামেলা’ এড়ানোর জন্য ‘ব্যবস্থা’ও রেখেছেন তারা। এ ক্ষেত্রে দামি মোবাইলের ‘আইএমইআই’ (ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল স্টেশন ইক্যুইপমেন্ট আইডেনটিটি) নম্বর বদলে বিক্রি করা হয়। এতে প্রযুক্তির মাধ্যমে মুঠোফোন ট্র্যাকিং করে চোরাই মোবাইলের অবস্থান নিশ্চিত করতে পারে না পুলিশ। আইএমইআই নম্বর পাল্টে ফেলে বিক্রি করা এ ধরনের মোবাইলের দাম অন্য সেটগুলোর চেয়ে তিন-চার হাজার টাকা বেশি। শাহজাহান, শাহ আলম ও লোকমান নামে তিন ব্যক্তি প্রতিটি দোকান থেকে দৈনিক ৩০ টাকা আদায় করেন ‘পুলিশ ম্যানেজ’ করার জন্য।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নগর ও আশপাশের উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় চুরি-ছিনতাই হওয়া পণ্য জমা হয় চোরাই মার্কেটে। এখানকার ব্যবসায়ীরা অত্যন্ত কম দামে এসব পণ্য অপরাধীদের কাছ থেকে কিনে ফের বিক্রি করে দেন। দোকানগুলো সারা দিন খোলা থাকলেও দিনের আলো নিভে যাওয়ার পর জমে ওঠে। সন্ধ্যা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ক্রেতার ভিড় থাকে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চোরাই মার্কেটের ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত। চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার চোর, পকেটমার, ছিনতাইকারীদের সঙ্গে তাদের যোগসাজশ থাকে। মাঝে মধ্যে তারা অগ্রিমও দেন। এরপর চাহিদামতো পণ্য চুরি বা ছিনতাই শেষে ফোন করা হয় নির্দিষ্ট দোকানিকে। পুলিশি ঝামেলা এড়াতে স্টেশন রোড এলাকায় পণ্য ডেলিভারি না দিয়ে আশপাশের এলাকায় দেওয়া হয়।