চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের নবনির্মিত ভবনের কনফারেন্স কক্ষে ঢুকেই প্রথমে অভিভূত হয়ে গেলাম। এমন চমৎকার বৃহৎ সুসজ্জিত কনফারেন্স কক্ষ মনে হয় চট্টগ্রামে আর দ্বিতীয়টি নেই। কনফারেন্স কক্ষে প্রবেশের উদ্দেশ্য হলো– চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের উদ্যোগে ‘চিরন্তন চট্টগ্রাম’ স্থাপন উপলক্ষ্যে মতবিনিময় সভায় যোগ দেওয়া। বরেণ্য শিক্ষাবিদ ড. অনুপম সেনের সভাপতিত্বে সভায় দৈনিক আজাদীর সম্পাদক এম এ মালেক, অধ্যাপক আবুল মোমেন, সুফী মিজানুর রহমান, ড. মোঃ আবুল কাসেম, ড. মোহীত উল আলম, ড. মো. সেকান্দার চৌধুরী, নাট্যব্যক্তিত্ব আহমদ ইকবাল হায়দারসহ চট্টগ্রামে অবস্থানরত খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত থেকে গুরুত্বপূর্ণ মতামত তুলে ধরেছেন। ‘চিরন্তন চট্টগ্রাম’ স্থাপনের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও সামগ্রিক কর্মসূচি অবগত হয়ে অভিনন্দন জানাতে চাই চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জনাব এটিএম পেয়ারুল ইসলামকে। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাব্বির ইকবাল, নির্বাহী কর্মকর্তা মো. দিদারুল আলমসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যে পরিমাণ শ্রম সময় আর মেধা ব্যয় করছেন, তার জন্য তাঁরাও প্রশংসার দাবিদার।
জনাব এটিএম পেয়ারুল ইসলাম এমন এক মানুষ, যাঁর ভেতরে উদারতা আছে, আন্তরিকতা আছে, ভালো ভালো কাজ করার মানসিকতা আছে এবং সাংগঠনিক শক্তি আছে। তিনি তাঁর কাজে সবাইকে সম্পৃক্ত করাতে চান, দলীয় ও সংকীর্ণ মনোভাবের উর্ধ্বে উঠে কাজকে সর্বজনীন রূপ দিতে চান। তাঁর সম্পর্কে আমরা যতটুকু জানি, তিনি অত্যন্ত দক্ষ ও আন্তরিক। প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের (গাড়ি তৈরির কারখানা) পরিচালকের দায়িত্ব পালনকালে অবিস্মরণীয় কাজ দেখিয়েছেন। তিনি নিজেও বলেছেন, একটা লোকসানি ও দুর্বল প্রতিষ্ঠানটিকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করেছিলেন তিনি। এটিএম পেয়ারুল ইসলাম ছিলেন সফল শিল্প উদ্যোক্তা। ২০১৪ সালে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। রেড ক্রিসেন্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন দক্ষতার সঙ্গে। যেখানে লক্ষ লক্ষ টাকার অনিয়ম ছিল, সেখানে দৈনিক গড়ে তিন লক্ষ টাকা লাভের মুখ দেখছে এই প্রতিষ্ঠান। মানুষটার ক্যারিশমাটিক কর্মকাণ্ডে আমরা মুগ্ধ। চট্টগ্রামের মনীষীদের নিয়ে তিনি ভাবেন। তাঁদের স্মৃতি রক্ষায় কিছু কাজ করে যেতে তিনি বদ্ধপরিকর। আমি নিজেও প্রত্যক্ষ করছি তাঁর এসব কর্মকাণ্ড। অতি সম্প্রতি ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধির নেপথ্যনায়ক রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাকের স্মৃতি রক্ষায় আনোয়ারায় প্রয়াতের বাড়ি সংলগ্ন স্থানে গেইট স্থাপনের কাজের টেন্ডার হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, দৈনিক আজাদীর সাবেক সম্পাদক, স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত স্বাধীনতা সংগ্রামী অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের সমাধিটা নতুন করে সাজাবেন বলে ইতোমধ্যে এক সমাবেশে ঘোষণা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত তিনি ছুটে চলেছেন শহরের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। তিনি বরাবর সদম্ভে উচ্চারণ করে থাকেন, আমার পরিবারে এবং আমার আত্মীয়–স্বজনের মধ্যে কোনো রাজাকার নেই। আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক এই মানুষটা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। যখন শুনি তাঁর সাহস আর বীরত্বগাথা, গর্বে ভরে ওঠে বুক। আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে তিনি বেশ কয়েকবার কারাবরণ করেন এবং একাধিকবার মৃত্যুর মুখোমুখি হন। সৃষ্টিকর্তার কৃপা, তিনি প্রাণে বেঁচে যান। বলা যেতে পারে, মৃত্যু–ভয়কে উপেক্ষা করে জামাত–শিবিরের বিরুদ্ধে একাই লড়াই করেছেন সাহসিকতার সঙ্গে।
নাজিরহাট কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন তিনি। ছিলেন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এবং বাংলাদেশ ‘ল’ স্টুডেন্টস ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাচিত সভাপতি। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক, ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতির সাধারণ সম্পাদকসহ নানা সময়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তিনি পালন করেন। ছিলেন ফটিকছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ফটিকছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান।
পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ এটিএম পেয়ারুল ইসলাম চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের দায়িত্ব নিয়ে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের বাস্তবায়ন করেছেন এবং অনেকগুলো প্রকল্প হাতে নিয়েছেন।
ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি সংরক্ষণে জেলা পরিষদের অর্থায়নে চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১২০ টিরও অধিক শহিদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে ২৮টি, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সীতাকুণ্ডের মিত্রবাহিনীর সমাধিস্থলে চন্দ্রনাথ মন্দিরের পাদদেশে মৃত্যুঞ্জয়ী মিত্র ও ফটিকছড়ির নানুপুরের বিনাজুরীতে হত্যাযজ্ঞের স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ।
নির্বাহী কর্মকর্তা মো. দিদারুল আলমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ‘জেলা পরিষদের প্রধান কাজই মূলত গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন। গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের মধ্যে রয়েছে আরসিসি, সিসি, এইচবিবি, ব্রিক সলিং দ্বারা সড়ক উন্নয়ন, রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ, ড্রেন নির্মাণ, কবরস্থান ও শ্মশানের গেইট ও বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণসহ অংশ বিশেষ বা সম্পূর্ণ অংশের উন্নয়ন, স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় গেইট, বাউন্ডারি ওয়াল, ওয়াশ ব্লক, শহীদ মিনার নির্মাণসহ বিজ্ঞানাগার, ক্লাশ রুম, অডিটরিয়াম উন্নয়ন, মসজিদ, মন্দির, বিহার ইত্যাদির আংশিক বা সম্পূর্ণ অংশের উন্নয়ন, ঈদগাহ ও জানাজার মাঠ উন্নয়ন ইত্যাদি। জেলা পরিষদ সাধারণত নতুন কোনো রাস্তা নির্মাণ করে না বরং বিদ্যমান ছোট ছোট রাস্তাসমূহ উন্নয়ন করে। এ রাস্তাগুলো সাধারণত মানুষের বসতবাড়ির নিকট থেকেই শুরু হয় বলে এগুলোর সুফল একেবারে মানুষের বাড়ি গিয়ে পৌঁছে। তবে বর্তমানে জেলা পরিষদ চট্টগ্রামবাসীর নিকট হতে প্রতিবছর প্রায় ৩০ হাজারের মত প্রকল্পের আবেদন পেয়ে থাকে, সেখান থেকে মাত্র ২–৩ হাজারের মত প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে; পূর্বে সে সংখ্যাটি আরো অনেক কম ছিল।
বিগত ২০০৮–০৯ অর্থবছরে গৃহীত প্রকল্পের সংখ্যা ছিল ২১২টি এবং মোট ব্যয় ছিল ২৩৪.৬১ লক্ষ টাকা। ২০২১–২২ অর্থ বছরে গৃহীত প্রকল্পের সংখ্যা ছিল ২৫০৯টি এবং ব্যয় ছিল ৮৩৯৫.১৬ লক্ষ টাকা। এ ১৩ বছরে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের সক্ষমতা বেড়েছে ১০ গুনেরও বেশি। এত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও চট্টগ্রাম জেলার খুব কম এলাকাই পাওয়া যাবে যেখানে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের নাম ফলক তথা উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে নি। জেলা পরিষদ হতে গৃহীত প্রকল্পগুলোর সিংহভাগ বাস্তবায়িত হয় পরিষদের নিজস্ব রাজস্ব আয় হতে বাকি কিছু প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় স্থানীয় সরকার বিভাগের এডিপি এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রীর অভিপ্রায় হতে প্রাপ্ত বরাদ্দ হতে।’
চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের নবনির্মিত ভবনে এখন স্থাপন করা হচ্ছে ‘চিরন্তন চট্টগ্রাম’ কর্নার, যাতে থাকবে চট্টগ্রামের ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, ব্যবসা–বাণিজ্য, রাজনীতি, প্রকাশনা, ভাষা, সংগীত প্রভৃতি। থাকবে চট্টগ্রামের মনীষীদের ছবি সংবলিত জীবনপঞ্জি। এই ‘চিরন্তন চট্টগ্রাম’ স্থাপনের ক্ষেত্রে উৎকৃষ্ট নমুনা হিসেবে সামনে আছে দৈনিক আজাদী প্রকাশিত মূল্যবান সংকলন ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম’। এখান থেকে নানা বিষয়ে সহায়তা নেওয়া সম্ভব। আমরা মনে করি, ‘চিরন্তন চট্টগ্রাম’ চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জনাব এটিএম পেয়ারুল ইসলামের সুুচিন্তা ও সমৃদ্ধ মনোভাবের ফসল। তিনি এমন এক ব্যক্তিত্ব, যা স্বপ্ন দেখেন, তা বাস্তবায়ন করতে তৎপর। ‘চিরন্তন চট্টগ্রাম’ কর্নার স্থাপনে যাঁরা শ্রম ও মেধা দিয়ে যাচ্ছেন, আমি তাঁদের সার্বিক মঙ্গল কামনা করছি। ‘চিরন্তন চট্টগ্রাম’ হোক সামগ্রিক চট্টগ্রামের আয়না।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী;
ফেলো (নম্বর–৪২২), বাংলা একাডেমি।