অর্থ–ক্ষমতালিপ্সু নষ্ট চরিত্রের কথিত প্রভাবশালীদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিগত সময়ে দখল–চাঁদাবাজদের নিয়ন্ত্রণে ছিল পুরোদেশ। এমন কোন ক্ষেত্র ছিল না যাতে নৈরাজ্যের ছায়া পড়েনি। দুর্বৃত্তায়নের কবলে পড়ে দেশের সাধারণ মানুষের জীবনপ্রবাহ ছিল ওষ্ঠাগত। যন্ত্রণা–ক্ষোভের সমষ্টি গণরোষে রূপান্তরিত হওয়া সম্পর্কে বিজ্ঞজনদের সতর্ক পরামর্শ ছিল উচ্চকিত। স্বেচ্ছাচারিতা–দাম্ভিকতার বেপরোয়া আচরণে সকল শ্রেণির নাগরিক নির্দয় কাতরতায় দিনাতিপাত করেছে। সচেতন মহলের লেখনি–বক্তব্যে বিপুল প্রকাশ পেলেও সংশ্লিষ্ট মহল কিছুই আমলে নেয় নি। ফলশ্রুতিতে কোটা বৈষম্যের যৌক্তিক আন্দোলন ছাত্র–জনতার গণঅভ্যুত্থানের রূপ পরিগ্রহ করে। ইতিমধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেল জয়ী বরেণ্য অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সরকারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে। জাতিসংঘের সহযোগিতায় সত্যনিষ্ঠ বিচার কার্যক্রমে সকল প্রকার দমন–পীড়ন–মামলা–হামলা–হত্যা–গণহত্যার বিচারের দাবি জোরালোভাবে উত্থাপিত। আপামর জনগণের আশাজাগানিয়া এক নতুন ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণে অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতার অঙ্গীকার সুপ্রতিষ্ঠিত।
পৃথিবী নামক এই গ্রহে উন্নত–উন্নয়নশীল–অনুন্নত প্রায় প্রতিটি দেশই পরিবেশ বিপর্যয়ে প্রবল আক্রান্ত। ঘূর্ণিঝড়–বন্যা–খরা–জলোচ্ছ্বাস–দাবানলসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রধান কারণ হচ্ছে পরিবেশ দূষণের নির্দয় প্রতিক্রিয়া। ব্যক্তি–গোষ্ঠী স্বার্থে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন–নগরায়ণ কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। জনসংখ্যাবৃদ্ধি–অবাধ বৃক্ষরাজি নিধন–পাহাড় পর্বত ধ্বংস, আবাসন–বিনোদন–পর্যটন বা পশুতুল্য মানব–দানবদের অর্থলিপ্সুুতা চরম হিংস্র পর্যায়ে পৌঁছেছিল। জনঅধ্যুষিত বাংলাদেশ হয়েছে অনাধুনিক নগরায়ণ বা সীমিত শিল্পায়নের যাঁতাকলে প্রচন্ড বিপর্যস্ত। ভূ–প্রাকৃতিক অবস্থানে ‘বদ্বীপ’ হওয়ায় প্রতিবছর প্রায় অর্ধেক সময়ে ঘূর্ণিঝড়–অতিবৃষ্টি–অনাবৃষ্টি–বন্যা–জলোচ্ছ্বাস–নদীভাঙ্গন–জলাবদ্ধাতার নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যাগুলো দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির অর্জনকে মারাত্মক ব্যাহত করে চলছে। অতীতে জনদুর্ভোগ লাঘবে সাময়িক ব্যবস্থাপত্র গ্রহণ করা হলেও দুর্যোগ মোকাবেলায় টেকসই কর্মকৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন তেমন দৃশ্যমান ছিল না। পক্ষান্তরে ভূমি–জল–নদী–সমুদ্রের চর দখল এবং স্থাপনা নির্মাণে বিগত প্রায় সরকার–দলের হাতেগোনা কতিপয় দুর্বৃত্তের কারণে পরিস্থিতির উন্নয়ন পরিলক্ষিত হয়নি।
ছোটখাট ডোবা–পুকুর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অতিপ্রয়োজনে কিছুটা লোপাট হলেও বড় বড় দিঘী–জলাশয় ভরাট এবং সন্ত্রাসমূলক কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে আবাসন প্রকল্পসহ শিল্পকারখানা–বস্তি–বসতি–মার্কেট স্থাপন ইত্যাদি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পবিত্র সংবিধান সম্মত বিভিন্ন বিধিবদ্ধ আইন থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি–বেসরকারি সংস্থা–কর্মকর্তা–স্বঘোষিত সন্ত্রাসী রাজনীতিকদের বাহিনীভিত্তিক অবৈধ কর্মকান্ডে আইনের প্রয়োগ ছিল অত্যন্ত দুর্বল। দেশের স্ব স্ব অঞ্চলের শহর–নগর–প্রান্তিক জনপদে চিহ্নিত স্বল্প সংখ্যক অপরাধীদের বিরুদ্ধে শারীরিক নির্যাতন–প্রাণনাশ–ঘুষের বিনিময়ে নানাভাবে আইনি জটিলতায় ফাঁসিয়ে দেওয়া–সম্মান বা ভাবমূর্তি খোয়ানো–অবাঞ্চিত হয়রানির ভয়ে সচেতন মহল কিছুটা সোচ্চার হয়েও পরক্ষণে কুটিল এসব চক্রান্তে প্রায়ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়তে বাধ্য হয়। ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভূমিকা পালনের বিপরীতে সমাজে সৎ–যোগ্য ব্যক্তিবর্গের ইতিবাচক উদ্যোগগুলো বরাবরই পরাস্ত–পরাজিত হয়েছে।
নিকট অতীতে মসজিদ–মন্দির–প্যাগোডা–ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান–শতবর্ষী কবর–সমাধিস্থল–শ্মশানের জায়গাটুকু দখল ও ক্রয়–বিক্রয়ে সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্য জনগণের মধ্যে যারপরনাই আতঙ্ক তৈরি করেছিল যা এখনো বিপুল অনুভূত। মৌরুসী–পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত সামান্য বাড়িভিটে রক্ষা করা নিয়েও তারা ছিল চরম ভীতসন্ত্রস্ত। অসহায়–নিরীহ–নিঃস্ব–সম্মান ও সুনামের অধিকারী ব্যক্তিবর্গের কাতরতার করুণ আর্তনাদের দীর্ঘশ্বাসে গণপরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছে। সরকারের পক্ষ থেকে পরিবেশ দপ্তর–ইউনিয়ন–উপজেলা–সিটি কর্পোরেশন–সিডিএ বা রাজউকের মতো প্রতিষ্ঠান প্রত্যেক অঞ্চলে বিদ্যমান থাকলেও জনদুর্ভোগ লাঘবে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতান্তই দুর্বিষহ। কিছুক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুটিকয়েক অনৈতিক কর্মকর্তার কর্মযজ্ঞ অপরাধীদের পক্ষে অপাংক্তেয় পন্থা অবলম্বন করে বিষয়সমূহ আরো জটিল করে তোলার দৃষ্টান্তও কম নয়।
দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণ–পরিবেশ বিপর্যয় বিচেনায় নদ–নদী, জলাশয় রক্ষায় নাগরিক সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্যোগসহ এ ব্যাপারে বহু আইন ও দিকনির্দেশনা থাকার পরও অসুস্থ প্রতিযোগিতা–যথাযথ কর্তৃপক্ষের অবজ্ঞা–উদাসীনতা–নীরবতায় দেশের জলাশয়গুলো দখল–ভরাট বন্ধ করা যাচ্ছিল না। অবৈধ–হীন এসব ভরাট–দখলের বিরুদ্ধে পরিবেশবাদী–এলাকাবাসী সংশ্লিষ্ট দপ্তরসমূহে বারংবার আপত্তি–অভিযোগ করেও এর কোন প্রতিকার পায়নি। ফলশ্রুতিতে সরকারি গৃহীত পদক্ষেপগুলো দখলবাজদের দৌরাত্ম্যে নস্যাৎ হয়ে গেছে। প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০ অনুযায়ী, কোনো পুকুর–জলাশয়–নদী–খাল ইত্যাদি ভরাট করা বেআইনি। আইনের ৫ ধারায় বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন বা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার–ভাড়া–ইজারা বা হস্তান্তর বেআইনি। কোনো ব্যক্তি এ বিধান লঙ্ঘন করলে আইনের ৮ ও ১২ ধারা অনুযায়ী পাঁচ বছরের কারাদন্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবেন। ২০১০ সালে সংশোধিত আইন মতে, যেকোনো ধরনের জলাশয় ভরাট করা নিষিদ্ধ। এছাড়াও ২০০০ সালের ২২ মে জারি করা অফিস আদেশে বলা হয়েছে, কোনো অবস্থাতেই খাল–বিল, নদী–নালা, পুকুর ও প্রাকৃতিক জলাশয়ের স্বাভাবিক গতি–প্রকৃতি পরিবর্তন করা যাবে না। এমনকি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকালে খাল–বিল, পুকুর, নালাসহ প্রাকৃতিক জলাশয়/জলাধার বন্ধ করা যাবে না।
আমাদের সকলের জানা, দেশে জায়গা–জমির দাম ও চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একশ্রেণির মানুষ ভূমির প্রতি সীমাহীন লোভ–লালসার বশবর্তী হয়ে সরকারি খাস জমি থেকে শুরু করে ব্যক্তিমালিকানাধীন এবং বিভিন্ন সামাজিক–ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জায়গা–জমি জাল–জালিয়াতির মাধ্যমে নির্দ্বিধায় দখল করে নিয়েছে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, জলাশয়ের অপরিকল্পিত উন্নয়ন–অবৈধ দখল ও ভরাটে পরিবেশ বিপর্যয়–প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলাশয় ভরাটের ফলে দেশে বৃষ্টির পানি ধারণক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। বিশেষ করে হাওড় অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা ভরাট হয়ে যাওয়ায় অতিবৃষ্টিতে বন্যার প্রবণতা বহুলাংশে বেড়ে গেছে। এছাড়াও দেশে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস–অস্বাভাবিক তাপমাত্রা–তাপদাহ–খরা–অতিবৃষ্টি–অনাবৃষ্টি–মাটির আদ্রতা হ্রাস–পানি স্বল্পতার মতো নানামুখী সংকটে নিপতিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, গত ৩০ বছরে দেশের বড় বড় শহর–নগরে প্রতিবেশব্যবস্থা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। এখানে পুকুর–দিঘি ও অন্যান্য জলাশয় এবং সবুজ এলাকা কমে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়েছে। ফলে শহরগুলোতে তাপমাত্রা বাড়ছে এবং বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে যা দেশবাসীকে গভীর উদ্বেগ–উৎকণ্ঠায় নিপতিত করেছে। বিদ্যমান জলাশয় সংরক্ষণের পাশাপাশি নতুন করে পুকুর–দিঘি খননের উদ্যোগ ভবিষ্যতের জন্য বিপর্যয়মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক হবে বলেও তারা মতামত ব্যক্ত করেন।
এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, যেকোনো নগর–শহর–অঞ্চলের মানুষের জন্য পুকুর–দিঘি বা অন্যান্য জলাশয় অনেকটা আশীর্বাদ হিসেবে প্রতিভাত। এসব জলাশয়ের নান্দনিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি প্রাকৃতি–সামাজিক–অর্থনৈতিক–পরিবেশগত–শিশুর বেড়ে ওঠা–মানুষের জীবনমান সমুন্নত রাখাসহ বিভিন্ন বিবেচনায় আলাদা গুরুত্ব বহন করে। পুকুরের পানি অনেক ধরনের পরিবেশবান্ধব গাছপালা এবং জীবজন্তুর জীবনপ্রণালীতে সহায়কের ভূমিকা পালন করে থাকে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ছাড়াও অগ্নিকান্ডের সময় অগ্নিনির্বাপণের অতিপ্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ পানির সংস্থানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রেই পুকুর–দিঘির মতো জলাশয়ের অনন্য অবদান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ভূগর্ভে পানি ঢোকার অন্যতম প্রাকৃতিক পথও হচ্ছে পুকুর–দিঘি বা এ ধরনের জলাশয়সমূহ। এই পথের সচলতায় পানির স্তর একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থানে থেকে সকল প্রাণীকূলকে বেঁচে থাকতে সহায়তা করে। অধিকন্তু অনেক এলাকায় জলাশয়গুলো পানি ধরে রাখার ও পানি সরে যাওয়ার প্রাকৃতিক ব্যবস্থা হিসেবে অতিশয় কার্যকর। ফলশ্রুতিতে বৃষ্টির সময় বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কামুক্তসহ নানারকম ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হয়।
গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মতে, ৫ আগস্ট ২০২৪ ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতার পালাবদলের পর কয়েক দিন দেশব্যাপী জায়গা–জমি–জলাশয়–হাট–বাজার–পরিবহন–ব্যবসা প্রতিষ্ঠান–দোকানপাট–ফুটপাত–বস্তি ইত্যাদির দখল ও পাল্টা দখলে চরম অস্থিরতা বিরাজ করেছে। পুরোনোদের সরিয়ে নতুন করে গড়ে তোলা হয়েছে দখলদার–চাঁদাবাজি সিন্ডিকেট। পুলিশ প্রশাসন ও সরকারের শূন্যতার সুযোগে এক শ্রেণির দুর্বৃত্তদের বেপরোয়া দখলদারিত্বে দেশবাসী যারপরনাই আতঙ্কিত–আশঙ্কিত। সরকারি–বেসরকারি–আধা সরকারি–স্বায়ত্তশাসিত প্রায় সকল সংস্থা–প্রতিষ্ঠানে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। বিভিন্ন মহল থেকে দখলদারি, চাঁদাবাজি বন্ধের আহ্বান জানানো হলেও, মাঠ পর্যায়ে তার প্রতিপলন তেমন পরিলক্ষিত নয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে চাঁদা–দখলবাজির বিরুদ্ধে উচ্চারিত বক্তব্য সকলের গুরুত্ব দেওয়া উচিত। সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দিয়ে দ্রব্যমূল্যের দ্রুততম মূল্যহ্রাস জনগণের জীবনে প্রবল স্বস্তিদায়ক হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে দেশজুড়ে পরিপূর্ণ শৃঙ্খলার প্রত্যাশায় প্রহর গুনছে সাধারণ মানুষ। চিরতরে দখল–চাঁদাবাজি নির্মূলে প্রায়োগিক ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। বিরাজিত সকল অভিশপ্ত দুষ্টচক্র সংহার করে দেশ দখল–চাঁদাবাজ মুক্ত হোক, এটিই সময়ের উচ্ছসিত দাবি।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়