চিরঞ্জীব নাসিমুল গণি

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী | বুধবার , ১৯ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:২৮ পূর্বাহ্ণ

মৃত্যু যদি জীবনের অন্ত হয়, তাহলে ১৭ এপ্রিল নাসিমুল গণির জীবনান্ত হয়ে গেছে। কিছু সত্যিই কী মৃত্যুতে জীবন নিঃশেষ হয়ে যায়? নাসিমুল গণির জীবনের ক্যানভাস এত বিরাট ও বিপুল কলেবরে বিস্তৃত যে, মৃত্যু তার যবনিকাপাত হতে পারে না।

বাংলাদেশে কর্মীপুরুষের একান্ত আকালের সময়ে নাসিম ছিলেন একজন বিরাট কর্মবীর। যে রাতে নাসিম জীবন মরণের সীমানা পারায়ে চলে গেছেন অনন্ত লোকে; ভয়ংকর দীর্ঘ সে রাত্রে চেতন অবচেতনে নাসিমকে নিয়ে আমি শুধু অব্যক্ত বেদনার বিরহভার অতিক্রমের প্রাণান্তকর প্রয়াসে নিমজ্জিত ছিলাম।

নাসিমুল গণি ছাত্রজীবনে রাজনীতির একজন উৎসাহী কর্মী ছিলেন। তখন থেকেই সংগঠন, আন্দোলন, বিতর্ক, ক্লাব ইত্যাদিতে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছিলেন তিনি। অসাধারণ একজন সংগঠক ছিলেন তিনি। তাঁর সঙ্গে সমকালে বেড়ে ওঠা তরুণদের মধ্যে নাসিমের সঙ্গে তুলিত হতে পারেন, এমন কোন দক্ষ সংগঠককে আমি দেখিনি। জীবনকে অনেক রকম কাজের মধ্যে তিনি ছড়িয়ে রেখেছিলেন যে, সে প্রয়োজনে তিনি তাঁর সহাধ্যায়ী, বন্ধুদের নিয়ে ‘সতীর্থ আপনজন সম্মিলিন’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর সমস্ত উদ্যোগ, আয়োজনের সৃষ্টিশীলতার স্বাক্ষর প্রতিফলিত হতো। ব্যাংকার আমানউদ্দিন, অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা জামাল নাসের, এমএ আজিজের পুত্র শামসুদ্দিন খালেদ সেলিম, শরীফ শমসির, সরওয়ার আজিজ ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এদেরকে নিয়ে তিনি একটি ব্যবসায়িক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন এবং তাও ছিলো ব্যতিক্রমী, যার নাম দিয়েছিলেন তিনি-‘সাম্পান বাণিজ্য উদ্যোগ’। তবে তাঁরা বাণিজ্যের আগে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চায় নিয়োজিত হয়েছিলেন। সেজন্য ‘সমাজ অধ্যয়ন কেন্দ্র’ নামে একটি পাঠচক্র প্রতিষ্ঠান করেছিলেন। এই পাঠচক্রেরই প্রকাশনা ‘এক দফার প্রবক্তা এমএ আজিজ স্মারকগ্রন্থ’।

সতীর্থ আপনজন সম্মিলন থেকে তিনি বেশ বড় একাধিক সাংগঠনিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি সৃষ্টিশীল মানুষ ছিলেন। বন্ধুদের নিয়ে বই, ম্যাগাজিন প্রকাশ করা, বন্ধুদের লেখা প্রকাশ করা ইত্যাদি কাজে তিনি অক্লান্ত উৎসাহী কর্মী ছিলেন। তাঁর উপাস্য ছিলেন চারজন. অনুপম সেন, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, আহমদ ছফা এবং সলিমউল্লাহ খান। সাহিত্যিক অভীক ওসমানেরও অনুরাগী ছিলেন তিনি। তাঁকে খুব মান্য করতেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে আরো বেশ বড় বড় কাজের প্রবর্তনা পেয়েছিলেন তিনি। সলিমউল্লাহ খান প্রাক্সিস অধ্যয়ন সমিতি নামে একটি পাঠচক্র প্রতিষ্ঠা করলে নাসিম তার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়েছিলেন। সমিতির প্রকাশনা প্রাক্সিস জার্নাল তিনি চট্টগ্রামে এনে ছাত্রদের মধ্যে বিতরণ করতেন। নাসিম যখন এসব কাজ করছেন, তখন তিনি বয়সে ছিলেন তরুণ; কিন্তু জটিল রাজনৈতিক ও দার্শনিক চিন্তায় বুদ হয়ে থাকতেন। ড. ইউনূস, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর চিন্তাচর্চার সঙ্গেও তিনি যোগাযোগ রাখতেন।

রাজনৈতিক জীবনে প্রথম দিকে তিনি জাসদ পন্থী ছাত্রলীগ, পরে ওয়ার্কাস পার্টির সক্রিয় কর্মী ছিলেন। রনোমেনন ভাইদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো। দেশে এফএফ রেডিও প্রবর্তনের গোড়ার দিকে ‘রেডিও টুডে’ চালু হলে নাসিমই চট্টগ্রামে তার স্টুডিও স্থাপন করে প্রচারের ব্যবস্থা করেছিলেন। নাসিমের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।

লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক সংগঠক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধচমেক হাসপাতালের বিশেষত্ব ও শীর্ষত্ব : প্রতিষ্ঠাকাল থেকে অদ্যাবধি