১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ শনিবার। আমেরিকায় সাপ্তাহিক ছুটি টার্গেট করে মামুন ওয়াশিংটন যাত্রার শিডিউল করে রেখেছিল। সকাল ৯ টায় ল্যান্ড ক্রুজারের চাকা ঘুরতে শুরু করল। ড্রাইভিং সীটে মামুন নিজে, পাশের সীটে আমি। পেছনের সীটে রুনু, মামুনের স্ত্রী ডাঃ স্মৃতি ও মামুনের স্কুল পড়ুয়া একমাত্র মেয়ে। স্মৃতি ভাবী পায়ের ব্যথা নিয়ে আমাদের সঙ্গ দিতে দুরপাল্লার এই জার্নিতে যাচ্ছেন দেখে অভিভূত হলাম।
নিউইয়র্ক এমনিতে ট্রাফিক জ্যামের শহর। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় মোটামুটি মিনিট ১৫ ব্যবধানে উঠে গেলাম হাইওয়েতে। সামনে দিগন্ত বিস্তৃত গ্রামীণ জনপদ, পাঁচ দশ মাইল পর এক একটি গ্রামের দেখা মেলে। মামুন বলছিল, যে হারে জন্মহার বাড়ছে, আগামী একশ বছর পরও আমেরিকায় অভিবাসন চাহিদা থেকেই যাবে। ৯৮,৩৩,৫১৬ বর্গ কি:মি: এর বিশাল দেশটির জনসংখ্যা মাত্র ৩৪ কোটি। ৩ দিন নিউইয়র্ক ঘুরে বুঝলাম, এ এক বিচিত্র দেশ। বহু ভাষা, বহু ধর্ম, বহু সংস্কৃতির মিলন ক্ষেত্র হলো আমেরিকা।
ঘন্টা খানেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের রাজ্য ডেলওয়ারে। পেনসিভানিয়ায় জন্ম হলেও বাইডেনের বাবা ব্যবসায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন শ্বশুরবাড়ী ডেলওয়ারে। বাইডেনের শিক্ষা, আইন পেশা ও রাজনৈতিক জীবন গড়ে উঠেছে এই ডেলওয়ার রাজ্যে। এখান থেকেই তিনি ১৯৭৩ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত বারবার সিনেটর নির্বাচিত হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েই ট্রাম্প সম্পাদিত দুবাই চুক্তি অনুযায়ী আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারে একমুহূর্তও দেরী করেন নি। মার্কিনিরা এভাবে পালিয়ে এসেছিল ভিয়েতনাম থেকে ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত নৌবাহিনীর বাধার মুখে মার্কিন সপ্তম নৌবহর লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন আজ শুধুই ইতিহাস। আমরা সর্বশেষ সাক্ষী। একাত্তরে সোভিয়েত খাদ্য, ওষুধ, ডাক্তার, কুটনীতি ও সামরিক সহায়তা না পেলে আমাদের স্বাধীনতা আসতে আরো বহু সময় লেগে যেতো। মাত্র আড়াই হাজার বর্গমাইলের ছোটরাজ্য ডেলওয়ার ফেলে পা রাখলাম মেরীল্যান্ডে।
মেরীল্যান্ডে ঢুকতেই পড়ে বাল্টিমোর ব্রীজ। পাতাপস্কো নদীর উপর আমেরিকান বিখ্যাত কবির নামে করা হয়েছে “ফ্রান্সিস স্কট কি” ব্রিজ। কে জানতো নান্দনিক এই ব্রীজটি সিঙ্গাপুরের মালবাহী এক জাহাজের ধাক্কায় দুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়বে ২৬ মার্চ ২০২৪।
মোটামুটি বিকেল ৩ টার দিকে মামুন হাইওয়ে থেকে ডান দিকে টার্ন নিয়ে একটি শহরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল রোড ইন্ডিকেশন ‘বাল্টিমোর’। চারিদিকে জাহাজের ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড দেখে বুঝলাম, চেস্পিক উপসাগর ও পাতাপস্কো নদীর সংযোগস্থলে গড়ে উঠেছে এই ঝকঝকে সমুদ্রবন্দর। ঠিক যেন বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। সময়ের প্রেক্ষাপটে বাল্টিমোর পোতাশ্রয়ে সাজানো আছে মার্কিন নৌবাহিনীর, বাণিজ্যিক ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত বহু পুরনো সারি সারি কয়েকডজন জাহাজ। আমরা মুখোমুখি একটি জাহাজের সাথে ছবি তুললাম। এটি মার্কিন কর্তৃত্বাধীন হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত পার্ল হারবার মার্কিন ঘাটিতে ছিল। ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর সাম্রাজ্যবাদী জাপান পার্লহারবারে আক্রমণ করলে জাহাজটি বিধ্বস্ত হয়। বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে এটিকে উদ্ধার করে এনে ইতিহাসের প্রয়োজনে বিমূর্ত করে রাখা হয়েছে। জাপান যদি পার্লহারবার আক্রমণ না করতো তবে যুদ্ধে জাপানের এই মর্মান্তিক ও লজ্জাকর পরিণতি হতো না।
শহরে ঢোকার সময় মামুন বললো, চেয়ে দেখো বিশ্বখ্যাত জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়। অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। বলা হয়ে থাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বিশ্ববিদ্যালয়। এ পর্যন্ত ৩৯ জন গবেষক শিক্ষার্থী এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নোবেল বিজয়ী হয়েছেন। ১৮৭৩ সালে মৃত্যুর আগে হপকিনস একটি উইলে পৃথকভাবে ৭ মিলিয়ন ডলার দান করে গেছেন একটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য।
হপকিনস ভালোবেসেছিলেন আপন চাচাত বোন এলিজাবেথকে। সমাজের রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির কারণে চাচাত বোনকে বিয়ে করতে পারেননি। এই দুঃখবোধ থেকে দু’জনের কেউ বিয়ে করেন নি। চিরকুমার হপকিনসের কর্মজীবন শুরু কাকার মুদি দোকান থেকে। খুব দ্রুতই তাঁর ব্যবসায়িক মেধার বিকাশ ঘটে। যৌবনে বাল্টিমোর থেকে ওহাইও রেললাইন স্থাপনের ঠিকাদারী পেয়ে কয়েক বছরের মধ্যে পরিণত হয়েছেন আমেরিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিত্তবান ও হৃদয়বান ব্যক্তিত্বে। হার্ভার্ড প্রতিষ্ঠা করে গেছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়। হপকিনসের ৭ মিলিয়ন ডলার দিয়ে ১৮৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জন হপকিনস মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। ক্যাম্পাসে তাঁর সমাধিতে স্থাপিত মনুমেন্ট হাজার বছর ধরে সাক্ষ্য দেবে মার্কিন জনপদে এতো মহৎপ্রাণ ব্যক্তির জন্ম হয়েছিল।
হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় স্বনামধন্য বিভাগ হলো ফলিত পদার্থবিদ্যা। এই বিভাগটিতে নাসার সবচে বেশি শিক্ষার্থী গবেষণায় লিপ্ত আছেন। মহাকাশ বিজ্ঞান তথা পদার্থবিদ্যায় সবচে বেশি স্কলারশীপ দিয়ে থাকে নাসা। ২০২৩ সালে এর পরিমাণ ছিল ৩.১ বিলিয়ন ডলার। পৃথিবীর কক্ষপথে মহাকাশ স্টেশন, স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন ও পর্যবেক্ষণ, চন্দ্রে চন্দ্রযান প্রেরণ, মঙ্গলে মঙ্গলযান প্রেরণ, মঙ্গলে পারসিভিয়ারেন্স প্রেরণ, পারসিভিয়ান্স, হাবল টেলিস্কোপ, জেমস ওয়েভ টেলিস্কোপ এবং ভয়েজার সহ বহু মহাকাশ মিশন মনিটরিং করা হয় যৌথভাবে নাসার সাথে হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের কন্ট্রোল রুম থেকে। যতদূর জানা যায় এমআইটি’র পর মহাকাশ মনিটরিং এর দ্বিতীয় আতুরঘর হলো জন হপকিনসের পদার্থবিদ্যা বিভাগ।
প্রতিদিন মেডিসিনে নিত্য নতুন আবিষ্কার হচ্ছে। সিনথেটিক ওষুধ আবিষ্কারের মান দিন দিন উন্নত হচ্ছে। নতুন নতুন আবিষ্কৃত ওষুধের ক্লিনিকাল ট্রায়ালের সবচে নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হলো এই বিশ্ববিদ্যালয়। কয়েক ধরনের ক্যান্সার এখন মানুষের নিয়ন্ত্রণে। বেশ কয়েকটি ক্যান্সার নিয়েও মানুষ দীর্ঘজীবী হচ্ছেন। পুরাতন ম্যানুয়াল সার্জারীর পরিবর্তে পেকো, রোবোটিকসহ নিত্য নতুন সার্জিকাল ইন্সট্রুমেন্ট আবিষ্কৃত হচ্ছে। কৃত্রিম রক্ত তৈরীতে হপকিনস এখন সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে। জার্মান ক্যারিকুলাম দিয়ে গড়ে উঠেছে শ্রেষ্ঠ এই বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়। পশ্চিমে অস্তাচল সূর্য। মামুন তার ল্যান্ড ক্রুজার স্ট্যার্ট দিলো। গন্তব্য ৪০ মাইল দুরবর্তী ওয়াশিংটন অথচ জ্যামের কারণে সময় লেগে গেল ৪ ঘন্টা। এই চারঘন্টা ধরে আচ্ছন্ন ছিলাম, হপকিনসের মহত্ব, কৃতিত্ব ও দানশীলতায়।
লেখক : কলামিস্ট; আইনজীবী, আপীল বিভাগ।