মাত্র ১০ বেডের একটি আউট ডোর চিকিৎসা কেন্দ্র হিসেবে যাত্রা শুরু। কথা ছিল স্থানীয় মায়েরা তাদের বিভিন্ন সমস্যার চিকিৎসা পাবেন এখানে। মায়েদের সাথে সন্তানেরাও পাবেন বিশেষ যত্নের চিকিৎসা। নাম দেয়া হয় আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতাল। জনাকয়েক সমাজদরদী মানুষ চিকিৎসাকেন্দ্রটি চালু করেন। স্থানীয়রা সকালে এসেই দুপুরের মধ্যে চিকিৎসা নিয়ে ঘরে ফিরে যেতেন। দিনে দিনে যতটুকু চিকিৎসা দেয়া যায় ঠিক ততটুকুই নিয়ে শুরু হয়েছিল যাত্রা। কিন্তু কালক্রমে সেই চিকিৎসাকেন্দ্রটিই চট্টগ্রামসহ সন্নিহিত অঞ্চলের প্রায় দুই কোটি মানুষের ভরসার জায়গা হয়ে উঠে। ১০ বেডের চিকিৎসা কেন্দ্রটি হয়ে উঠে ৮০০ বেডের পুর্ণাঙ্গ হাসপাতাল। দুইশ’ বর্গফুটেরও কম আয়তনের মাত্র ১ রুমে শুরু হওয়া চিকিৎসাকেন্দ্রটি ৪৩ বছরের মাথায় এসে হয়ে উঠে প্রায় ১২ লাখ বর্গফুটের বিশাল এক হাসপাতাল। প্রায় ৬ একর জায়গার উপর নতুন ১৩ তলা ভবনে রয়েছে সাড়ে ৬ লাখ বর্গফুট জায়গা। সাড়ে ৪ লাখ বর্গফুটের পুরাতন ভবনটিতেও চলে চিকিৎসা কার্যক্রম। অবশ্য এই ভবনটি ভেঙ্গে নতুন করে ১৩ তলা ভবন নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে। যাতে অন্তত ৭ লাখ বর্গফুটের অবকাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হবে। হাসপাতালের নতুন ভবনের পাশেই স্বতন্ত্র ক্যান্সার হাসপাতালের জন্য ১১ তলা বিশিষ্ট আলাদা ভবনের নির্মাণ কাজ একেবারে শেষ পর্যায়ে। এই ভবনটিতে ৮৮ হাজার বর্গফুট জায়গা রয়েছে।
১৯৭৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর নগরীর আগ্রাবাদে ছোট্ট একটি রুমে শুরু হয়েছিল মা ও শিশু হাসপাতালের যাত্রা। প্রথম দিকে দিনে ২/৩ জন করে রোগী আসতেন। পরবর্তীতে যা ১০ জনে উন্নীত হয়েছিল। মাত্র জনা দশেক মা ও শিশুর চিকিৎসা সুবিধা নিয়ে শুরু হওয়া হাসপাতালে বর্তমানে প্রতিদিন আউট ডোর চিকিৎসা নেন দুই থেকে আড়াই হাজার রোগী। হাসপাতালে ভর্তি থাকেন আট শতাধিক। ৮০০ বেডের পূর্ণাঙ্গ একটি হাসপাতালের সব সুযোগ সুবিধাই এই হাসপাতালটিতে রয়েছে। মাত্র একজন ডাক্তার দিয়ে যাত্রা করা হাসপাতালটিতে বর্তমানে ৪শতাধিক ডাক্তার রয়েছেন। রয়েছে ৪৩টি বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা। ডাক্তার নার্স এবং কর্মকর্তা কর্মচারী মিলে প্রায় আড়াই হাজার মানুষের বিশাল এক পরিবারে পরিণত হয়েছে মা ও শিশু হাসপাতাল। যা বৃহত্তর চট্টগ্রামের দুই কোটিরও বেশি মানুষের আস্থা , ভালোবাসা ও ভরসার জায়গায় পরিণত হয়ে নিরন্তর চিকিৎসাসেবা প্রদান করছে। মা ও শিশু হাসপাতালের করোনাকালের ভূমিকা এতদঞ্চলের মানুষ আরো বহুদিন মনে রাখবে। চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের সাথে অচিরেই যুক্ত হচ্ছে ১৫০ বেডের ক্যান্সার হাসপাতাল। এটি চট্টগ্রামের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার হাসপাতাল। যেখানে কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপিসহ ক্যান্সার চিকিৎসার সর্বাধুনিক সব ধরণের চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হবে।
মাত্র জনাকয়েক মানুষের হাত ধরে যাত্রা করা মা ও শিশু হাসপাতাল এক পর্যায়ে লাইফ মেম্বার ও ডোনার মেম্বার নেয়া শুরু করে। জনাকয়েক লাইফ মেম্বার নিয়ে শুরু করা সেই হাসপাতালের বর্তমানে লাইফ মেম্বারের সংখ্যা ১০ হাজারের কাছাকাছি। ডোনার মেম্বার রয়েছেন ৪শ’ জন। এই ১০৪০০ জন মানুষের দান অনুদানের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবান কিছু মানুষের সার্বিক সহায়তায় বিকশিত হয়েছে মা ও শিশু হাসপাতাল। জনগনের হাসপাতাল খ্যাত চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের পুরো কার্যক্রমই চলে জনগনের টাকায়। হাজারো মানুষের সহায়তায় পরিচালিত এই হাসপাতাল ইতোমধ্যে দেশের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি হাসপাতাল হিসেবে মানুষের ভরসার জায়গায় পরিণত হয়েছে। লাইফ এবং ডোনার মেম্বারদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত একটি পরিচালনা কমিটিই এই হাসপাতালের সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। এই কমিটিই মুলত বিশাল এই কর্মযজ্ঞ নিয়ন্ত্রন করে হাসপাতালটিকে অভীষ্ট লক্ষ্য পৌঁছানোর উদ্যোগ নেয়।
চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম আজাদ দৈনিক আজাদীকে বলেন, মা ও শিশু হাসপাতাল আসলে জনগণের হাসপাতাল। জনগণের দানে জনগণের এই হাসপাতালে জনগনের চিকিৎসা চলে। খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে শুরু হওয়া এই হাসপাতাল জনগণের ভালোবাসায় আজ বিশাল এক হাসপাতালে পরিণত হয়েছে। এই হাসপাতাল কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, কারো মালিকানা নেই। সমাজের নিবেদিতপ্রাণ কিছু মানুষ যারা লাইফ এবং ডোনার মেম্বার হিসেবে হাসপাতালের জন্য দান অনুদান দিয়েছেন তারাই মুলতঃ হাসপাতালটি পরিচালনা করে। জনগণের ভালোবাসায় ধন্য এই হাসপাতাল জনগণের অন্তরে জায়গা করে নিতে পেরেছে–এটিই এই হাসপাতাল যারা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই মহৎপ্রাণ মানুষগুলোর বড় প্রাপ্তি বলেও রেজাউল করিম আজাদ মন্তব্য করেন।
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী