চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন্ন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) ও হল সংসদের নির্বাচন ঘিরে ক্যাম্পাসে এখন উৎসবমুখর পরিবেশ। ৩৫ বছর পর ভোট আয়োজনকে ঘিরে প্রার্থীদের প্রচারণা, শিক্ষার্থীদের আলোচনায় নির্বাচনি উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। প্যানেল ঘোষণা থেকে শুরু করে প্রার্থীদের প্রচারণার খবর এখন সর্বত্র। বলা যায়, সবখানে এখন নির্বাচনের রঙ। তবে এই ডামাডোলে আড়ালে চলে যাচ্ছে কয়েক সপ্তাহ আগের ভয়াবহ সংঘর্ষে আহত শিক্ষার্থীদের খবর। গত ৩০ আগস্ট রাত সোয়া ১২টা থেকে ৩১ আগস্ট দুপুর পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের কয়েক দফা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে সহ–উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দিন, প্রক্টর অধ্যাপক তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফসহ অন্তত সাড়ে ৪শ শিক্ষার্থী আহত হন। এর মধ্যে গুরুতর আহত তিনজন কিছুটা সুস্থ হলেও এখনও ফিরতে পারেননি স্বাভাবিক জীবনে।
মাথার খুলি সংরক্ষণ, দীর্ঘ চিকিৎসায় মামুন : সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ মামুনও সংঘর্ষে গুরুতর আহত হন। মাথায় ভয়াবহ আঘাত পাওয়ায় তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়েছিল। ১ সেপ্টেম্বর বিকেলে অবস্থার উন্নতি হলে লাইফ সাপোর্ট খুলে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, পুরোপুরি সুস্থ হতে তার অন্তত দুই–তিন মাস সময় লাগবে। তার মাথার খুলি ফ্রিজে সংরক্ষণ করা হয়েছে, কয়েক মাস পর অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আবার সেটি লাগানো হবে।
হাসপাতালে থাকা মামুনের মামা জানান, মামুন মোটামুটি সুস্থ আছেন। তার চিকিৎসা চলছে। যেহেতু তার মাথার চিকিৎসা জটিল এই জন্য আরও কিছুটা সময় লাগবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে যথেষ্ট পরিমাণ সাপোর্ট করা হচ্ছে।
আইসিইউ থেকে কেবিনে সায়েম : গ্রামবাসীর সঙ্গে সংঘর্ষে গুরুতর আহত হয়েছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ আহমেদ সায়েম। ৩১ আগস্ট রাতে তাকে পার্কভিউ হাসপাতালের আইসিইউতে নেওয়া হয়। দুই সপ্তাহ পর গত ১৬ সেপ্টেম্বর তাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়েছে। শারীরিক অবস্থা মোটামুটি উন্নতির দিকে বলে জানিয়েছেন তার বাবা। তবে শরীরের বাম দিক অচল হয়ে যাওয়ার কারণে এখম নিয়মিত থেরাপি দেওয়া হচ্ছে। সায়েমের বাড়ি কুমিল্লায় হলেও তার পরিবার বগুড়ায় থাকেন। আহত হওয়ার খবর পেয়ে বাবা আমির হোসেন ও মা শাহনাজ আমিন চট্টগ্রামে এসে ছেলের পাশে রয়েছেন।
তারা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ঠিকমতো খোঁজ খবর নিচ্ছেন। ভালো মানের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। যার কারণে তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিকট কৃতজ্ঞ। সায়েমের জন্য সবার কাছে দোয়াও চেয়েছেন তারা।
ভালো করে হাঁটতে পারছেন না নাইম : নাইমুল ইসলাম রাফি নামের আরেক শিক্ষার্থী প্রথমে ন্যাশনাল হাসপাতালে ভর্তি হন। পরে অস্ত্রোপচারের পর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকার জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়। ১৩ সেপ্টেম্বর বাড়িতে ফিরলেও এখনও হাঁটার ক্ষমতা ফিরে পাননি। একটু হাঁটলেই কাটা পা ফুলে যায়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে তাকে ফিজিওথেরাপি নিতে হবে।
জানতে চাইলে নাইমের মা রেহানা আক্তার জানান, আমার ছেলে মোটামুটি সুস্থ আছে। তবে ডাক্তার বলছে সকাল–বিকাল দুইবার থেরাপি দিতে। এখন সামনে তার পরীক্ষা। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। কারণ সে ডান হাত দিয়ে ভালোভাবে খাইতেও পারে না। এবং পায়ের জন্য ভালো করে হাঁটতেও পারে না। শিক্ষকরা বলছেন, তাকে হলে সিট দেবে। কিন্তু তাকে নিয়ে চিন্তা হয় সে কীভাবে কি করবে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদেরকে আন্তরিকতার সাথে সহযোগিতা করছে।
সায়েম, মামুন ও ইমতিয়াজের চিকিৎসার বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, সিন্ডিকেট মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে আহত শিক্ষার্থীদের যাবতীয় চিকিৎসার খচর বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বহন করবে। যার কারণে আমরা তিনজনেরই চিকিৎসা খরচ চালিয়ে যাচ্ছি। তারা সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসার সব খরচ বহন করা হবে।
প্রসঙ্গত, ৩০ আগস্ট সংঘর্ষের পর ১ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ২টি তদন্ত কমিটি গঠনের সুপারিশসহ ১০টি সিদ্ধান্ত নেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে একটা তদন্ত কমিটি কঠন করা হয়। কমিটির সদস্যরা তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে যে কমিটি হওয়ার কথা তা এখনও হয়নি। এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানান, ২ সেপ্টেম্বর আইন মন্ত্রণালয়ে তদন্ত কমিটি গঠনের অনুরোধ পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এখনও কোনো আপডেট পাইনি। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কর্তৃক তদন্ত কমিটির কাজ চলমান আছে।
এর পাশাপাশি ৩ সেপ্টেম্বর প্রশাসন ১ হাজার ৯৫ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করে। এতে ৯৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়, বাকি সবাই অজ্ঞাত। প্রথম দিন রাতে পুলিশ আটজনকে গ্রেপ্তার করলেও বাকিরা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। এ ব্যাপারে রেজিস্ট্রার বলেন, অনেকে বলছেন, নিরপরাধদের আসামি করা হয়েছে। আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলেছি যেন নিরপরাধ কেউ হয়রানির শিকার না হয়। অপরাধী শনাক্ত করেই গ্রেপ্তার করা হবে।