চাকরিতে সন্তুষ্টির জন্য প্রয়োজন সঠিক লক্ষ্য ও পরিকল্পনা

প্রফেসর সরওয়ার জাহান | রবিবার , ২৭ জুন, ২০২১ at ৬:২৬ পূর্বাহ্ণ

জীবন-জীবিকার তাগিদে মানুষকে কোনো না কোনো পেশায় নিয়োজিত থাকতে হয়। পেশা হিসেবে অনেকে চাকরিকে বেছে নিলেও কর্মক্ষেত্রে সবাই যে আত্মসন্তুষ্টিতে থাকেন এমন কিন্তু নয়। দেশে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত অনেকেই তাদের চাকরিতে বিবিধ কারণে সন্তুষ্ট নন। আর এই অসন্তোষের পেছনে প্রতিষ্ঠানের ধরন অনুযায়ী কাজের পরিধি, প্রত্যাশিত বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা, কর্মপরিবেশকে দায়ী করছেন তারা। তবে মানব সম্পদ উন্নয়ন গবেষকদের মতে চাকরিতে সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির বিষয়টি নির্ভর করে প্রত্যেকের লক্ষ্য ও পরিকল্পনার উপর।
দেশে ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সের জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিকভাবে সক্রিয়, তারা মোট জনগোষ্ঠীর শতকরা ৬৮ ভাগ বাংলাদেশে প্রতিবছর নতুন করে ২২ লাখ কর্মক্ষম লোক চাকরির বাজারে প্রবেশ করে৷ কিন্তু কাজ পায় মাত্র সাত লাখ কর্মক্ষম মানুষ। কর্মক্ষম মানুষ যদি লক্ষ্য এবং সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে কর্মক্ষেত্রে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা আরো বাড়ানো সম্ভব বলেও মনে করেন মানব সম্পদ উন্নয়ন গবেষকরা।
কর্মক্ষেত্রে অসন্তুষ্টির অন্যতম কারণ হলো কর্মজীবী মানুষ এবং প্রতিষ্ঠানগুলোতে পেশাদারিত্ব গড়ে না ওঠা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট কর্মজীবী প্রায় ৫ কোটি ৬৮ লাখ। এর মধ্যে সরকারি কর্মজীবীর সংখ্যা প্রায় ২১লাখ ও বেসরকারি খাতে রয়েছেন প্রায় ৫ কোটি ২০লাখ মানুষ। এই জনসংখ্যার কত জন সন্তুষ্টি নিয়ে বা খুশি মনে চাকরি করেন তা হয়তো জানা যাবেনা। তবে সন্তুষ্টি নিয়ে কিভাবে চাকরিতে মনোনিবেশ করা যায় তা জানা জরুরি।
জীবনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা যদি সঠিক না হয় তাহলে চলার পথে অনেক সময়েই হোঁচট খেতে হবে নয়তো কাজের প্রতি আগ্রহ থাকবেনা। অনাগ্রহ থেকে শুরু হয় কাজের প্রতি অনীহা। আর অনীহা থেকেই সৃষ্টি হয় নেতিবাচক আচরণ। আবার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে সম্পর্কের টানা পোড়েন থাকলেতো কথাই নেই। অনিহার কারণে একসময় নিজেকে ব্যর্থ মনে হবে। নিজের অবস্থার জন্য অন্যের উপর দোষ চাপানোর নেতিবাচক মানসিকতা তৈরি হবে। সবচেয়ে বড় কথা শরীর মন ধীরে ধীরে অবনতির দিকে যাবে।
কাজে সন্তুষ্টি দৃষ্টিভঙ্গি বা ব্যক্তিগত চাহিদার উপর নির্ভর করে।কাজের সন্তুষ্টির কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। যেমন কাজের পরিবেশ। আবার অনেকের ক্ষেত্রে কাজের সন্তুষ্টি মাপা হয় কাজের ফলাফল কতটা ভাল-মন্দ তার ওপর। পারিশ্রমিক ও পুরস্কারের ব্যবস্থা সন্তুষ্টির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অধিকাংশ কর্মীরা প্রায়শই জানেন না বা উপলব্ধি করতে পারেন না তাদের চাওয়া কি? অনেকে পদবী এবং যোগ্যতার ভারসাম্য বুঝতে অক্ষম। বিবেচনায় আনেন কেবল প্রতিষ্ঠানের সুযোগ সুবিধা ও বেতন-স্তরের বিষয়টি এবং কর্তৃপক্ষ কিভাবে তাদের অবদানকে মূল্যায়ন করে তার উপর।
তবে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের তার নিজস্ব পদোন্নতির ব্যবস্থা থাকে যা কাজের সন্তুষ্টিতে বিভিন্নভাবে প্রভাব ফেলে। যেমন, কেউ জ্যেষ্ঠতার জন্য পদোন্নতি পেয়ে কাজের সন্তুষ্টি উপভোগ করেন। আবার কেউ কাজের মূল্যায়নের উপর পদোন্নতি পান । এই পদোন্নতি কাজের সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টিতে বেশ ভাল ভাবে প্রভাব বিস্তার করে। আমাদের দেশের চাকরীজীবীদের বদ্ধমূল ধারণা হলো প্রতি বছরই বেতন বৃদ্ধি বা পদোন্নতি তাদের একটি অধিকার। অথচ প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নিয়মের সাথে কেবল জ্যেষ্ঠতা নয় বরং আর্থিক সম্পর্ক, কর্মদক্ষতা, কাজের প্রতি আন্তরিকতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত যা কর্মীরা বুঝতে চান না। অনেক সময় দেখা যায়-একজন ভালো কর্মী প্রতিষ্ঠানে টানা এক বছর ভালো কাজ করার পর হঠাৎ অমনযোগী হয়ে আগের মতো দক্ষতা দেখাতে পারছেন না। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো কাজের প্রতি অনিহা বা অসন্তুষ্টি। একজন কর্মী যখন তার লক্ষ্য অর্জনে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হন তখন কাজের ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি অসন্তুষ্টি সৃষ্টি হবেই । অসন্তুষ্টি শুধু অর্থেই সীমাবদ্ধ নয়, এর সঙ্গে জড়িত কর্মক্ষেত্র, ব্যক্তিগত সমস্যা ও পারিবারিকসহ নানা বিষয়।
প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে যারা কাজ করেন, তাদের ভালো রাখাও প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের ইতিবাচক মনোভাব, সদিচ্ছা জরুরি। প্রতিষ্ঠান বলতে শুধু কোনো বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানই নয়, হতে পারে তা যেকোন অফিস। নিয়োগকর্তাকে বিবেচনায় নিতে হবে কর্মীদের চাহিদা কি এবং তা কতটুকু ন্যায্য । সন্তোষজনক পর্যায়ে থাকলেই প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা সন্তুষ্ট থাকবেন। যদি বেতন বা সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে প্রশ্ন আসে, কর্মীকে জানানো উচিত প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা বা কর্মীর যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার নিরিখে বেতন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয় । উচ্চবিলাসী বা অলসরাই কেবল ভুল বুঝবে অন্যরা নয়। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আর কর্মীদের মাঝে কোন দূরত্ব সৃষ্টি হওয়া উচিত নয়। এই দূরত্বও অনেক সময় কাজে অসন্তোষের কারণ হয়ে থাকে।
মনে রাখতে হবে চাকরিতে গতকালের কোন স্থান নেই, এখানে সব সময় ভাবতে হবে আজ এবং আগামী নিয়ে। ক্যারিয়ার পরিকল্পনায় প্রতিষ্ঠান কি চায়, প্রতিষ্ঠানের আয়ের স্তর, কাজের স্থিতিশীলতা এবং অগ্রগতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা নিয়েই চাকরি করা উচিত। কর্মক্ষেত্রে যদি কেউ মনে করেন তার গুরুত্ব নেই বা জ্যৈষ্ঠতার কারণে সময় কম দিবেন অথবা কাজে আগের মত পরিবেশ নেই তাহলে মন খারাপ না করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ করা উচিৎ। ফলপ্রসূ আলাপ না হলে বিকল্প হিসেবে নতুন কর্মক্ষেত্র খোঁজা যেখানে খুশিমনে কাজ করা যায়।
চিকিৎসাবিদ ও গবেষকরা বলছেন, চাকরিতে অসন্তুষ্টি স্বাস্থ্য ও মানসিক সমস্যার কারণ হতে পারে। একজন মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য অনেকটাই নির্ভর করে চাকরির প্রতি তার অনুভূতির উপর। কর্ম জীবনের চাকরি নিয়ে যাদের সন্তুষ্টি কম, তারা হতাশা এবং দুশ্চিন্তায় ভুগেন বেশি। এতে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়েবেটিকসহ বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি হতে পারে, যা বয়স বাড়ার সঙ্গে জটিলতায় রুপ নেয়। কর্মক্ষেত্রে অসন্তোষের কারণে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি কারো কাম্য নয়। সন্তুষ্টির প্রধান উৎস অবশ্যই কাজ। কাজের স্বাধীনতা, সফলতা এবং দায়িত্ববোধ কর্মীকে প্রতিষ্ঠানে আকর্ষণীয় করে তুলে।
কোনো প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ দিন কাজ করার পরেও অনেকের পদোন্নতি হয়না কিংবা বেতন বাড়েনা। এনিয়ে মানসিক চাপে থাকেন অনেকে। যার প্রভাব পড়ে পারিবারিক জীবনেও। চাকরিতে পদোন্নতি বা বেতন বৃদ্ধি নিয়ে কর্মীর নিজের প্রচেষ্টা না থাকলে প্রতিষ্ঠানেরও আগ্রহ থাকে না। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ মনে করতে পারে পদোন্নতি প্রয়োজন নেই। তবে নিষ্ঠাবান কর্মী যেকোন প্রতিষ্ঠানের সম্পদ। পদোন্নতি বা বেতন বৃদ্ধির বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে আনতে হবে। কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট কিনা সেটি জানা দরকার। কর্মীর কাজে প্রতিষ্ঠান সন্তুষ্ট থাকলে কোনভাবেই পদোন্নতি বা বেতন বৃদ্ধিতে কর্তৃপক্ষ সাধারণত কার্পণ্য করে না। কর্মীদের কাজের প্রতি আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধ দেখে কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট হয় ।
জীবনের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি সময় ব্যয় হয় কর্মক্ষেত্রের নানা কাজে। অধিকাংশ চাকরিজীবীর চাহিদা থাকে কাজের শর্ত, বেতন-সুযোগ সুবিধার প্রতি। এটি অবশ্যই গুরত্বর্পূণ। তবে কাজের প্রতি আন্তরিকতা, করণীয় কাজের দায়বদ্ধতাও গুরত্বর্পূণ যা অনেকে অবহেলা করেন। চাকরিতে মূলত সন্তুষ্টি অসন্তুষ্টির কারণ হলো:- কাজের সঠিক পরিবেশ, ব্যবস্থাপনা, কর্তৃপক্ষের আচরণ, পারিশ্রমিকসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা, দলগত কর্মীবাহিনী, কাজের স্বীকৃতি, বৈষম্য, কাজের চাপ ইত্যাদি। সুখ মনের একটি অবস্থা আর সন্তুষ্টি হ’ল ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা। উভয়ই একে অপরের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত। অনেকেই চাকুরির পর কাজকে বা প্রতিষ্ঠানকে অবহেলা করে, অথচ প্রবাসীরা যেকোন কাজ আন্তরিকভাবে ঝুঁকি নিয়েই করেন। সঠিক পেশাদারত্ব নিয়ে দেশের মানুষ যদি দেশে আন্তরিকতার ও দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতো তাহলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হতো।
প্রতিটা প্রতিষ্ঠানে ভালমন্দ নিয়ে চলে, কর্তৃপক্ষ কোন অবস্থাতেই চায় না তার কর্মীবাহিনী অসন্তুষ্টি নিয়ে কাজ করুক। দায়িত্ব এড়িয়ে চলার অভ্যাস, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সমালোচনায় জড়ানোর কারণে কর্মীদের কাজের উপর প্রভাব পড়ে। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও পরিকল্পনা না থাকায় কিছুদিন কাজ করার পর অনেকের কাজে একঘেঁয়েমি চলে আসে, ফলে দায়িত্বে অবহেলা বিভিন্ন ধরনের অপেশাদারী অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন। কর্মী যদি মনে করে এই কাজ বা প্রতিষ্ঠান বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাকে যথাযত মূল্যায়ন করছে না তাহলে মন খারাপ না করে অন্যত্র কাজ করাই ভাল । এতে মানসিক ও শারীরিক শান্তি আসবে এবং সবার সাথে সুসম্পর্ক বজায় থাকবে।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সাদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ ও টেকসই উন্নয়নকর্মী

পূর্ববর্তী নিবন্ধশেরে মিল্লাত মুফতি ওবাইদুল হক নঈমী (রহ.)
পরবর্তী নিবন্ধযুক্তরাজ্যে দেখা দিতে পারে ‘খাদ্য সংকট’