চসিকের তিনটি উপ-আইন চূড়ান্ত করল মন্ত্রণালয়

সৌন্দর্যবর্ধন ও দোকান বরাদ্দে আসবে স্বচ্ছতা পার্টনারশিপে করা যাবে অবকাঠামো উন্নয়ন ও আয়বর্ধক প্রকল্প

মোরশেদ তালুকদার | শনিবার , ১১ মে, ২০২৪ at ৬:০৬ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্প ও জায়গা বরাদ্দ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সংস্থাটির অভ্যন্তরীণ তদন্তেও এর সত্যতা মিলে। অস্বচ্ছতার অভিযোগ আছে সংস্থাটির মালিকানাধীন বিভিন্ন মার্কেটে দোকান বরাদ্দ ও ব্যবস্থাপনায়ও। এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও আইন না থাকায় অস্বচ্ছতার সুযোগ তৈরি হয়।

অবশ্য কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠার ১৬১ বছর পর এসে বন্ধ হচ্ছে এসব অনিয়মের পথ। কারণ সৌন্দর্যবর্ধন নীতিমালাসহ তিনটি উপআইন হচ্ছে সংস্থাটির জন্য। চসিকের প্রস্তাবিত উপআইনগুলো দীর্ঘ প্রায় দুই বছর ধরে যাচাইবাছাই শেষে গত বৃহস্পতিবার চূড়ান্ত করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের গঠিত একটি কমিটি। খুব শীঘ্র তা মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত অনুমোদন দেবে। উপআইনগুলো হচ্ছে ‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সৌন্দর্যবর্ধন নীতিমালা, ২০২২’, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন মার্কেট উপআইন, ২০২২’ এবং ‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন বিশেষ চুক্তি (বিল্ড, ওন, অপারেট অ্যান্ড ট্রান্সফারবিওওটি) বিধিমালা, ২০২২’। এর মধ্যে সৌন্দর্যবর্ধন নীতিমালাটি দেশের সিটি কর্পোরেশনগুলোর মধ্যে এ সংক্রান্ত প্রথম নীতিমালা।

চসিক সূত্রে জানা গেছে, স্বচ্ছতা নিশ্চিতে চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী উপআইনগুলো প্রণয়নে উদ্যোগ নেন। উপআইনের খসড়া তৈরির পর তা চসিকের বর্তমান পর্ষদের ১০ম সাধারণ সভায় অনুমোদনের পর তা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। এরপর তা যাচাইবাছাইয়ে একটি কমিটি করে দেয় মন্ত্রণালয়। কমিটি তা বৃহস্পতিবার চূড়ান্ত করে।

সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী আজাদীকে বলেন, নীতিমালা ও উপআইনগুলো কর্পোরেশনের জন্য খুব দরকার ছিল। এগুলো আরো বহু আগে প্রণয়ন করা উচিত ছিল। আমি উদ্যোগ নেয়ার পর মন্ত্রণালয়ও ইতিবাচকভাবে নিয়েছে। তিনি বলেন, নীতিমালা হলে সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পে যেমন খুশি করা যাবে না। নিয়মের মধ্যে আসবে। নীতিমালা যথাযথ অনুসরণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে নগরের সৌন্দর্যবর্ধনে নতুন মাত্রা যুক্ত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন মেয়র। তিনি বলেন, মার্কেট উপআইনটিও যুগোপযোগী। প্রণীত নীতিমালা অনুসরণের মাধ্যমে চসিকের মার্কেটগুলোতে দোকান বরাদ্দের প্রক্রিয়া সুশৃঙ্খল হবে। বিশেষ চুক্তি বিধিমালাটিও কর্পোরেশনের জন্য অনেক বেশি ফলপ্রসূ হবে।

এদিকে গত বৃহস্পতিবার স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত যাচাইবাছাই কমিটির সভায় উপস্থিত ছিলেন চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। চূড়ান্তকরণের বিষয়টি নিশ্চিত করে আজাদীকে তিনি বলেন, উপআইনগুলো কার্যকর হলে কর্পোরেশনের কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে। যেমন সৌন্দর্যবর্ধনসহ কিছু আয়বর্ধক কাজ বর্তমানে কোনো আইন ছাড়াই নিজস্ব উদ্যোগে সার্কুলারের মাধ্যমে করা হয়। বৈধ ফ্রেম ওয়ার্ক হলে আয়বর্ধক আরো বহু প্রকল্প আমরা নিতে পারব। কর্পোরেশনের অনেকগুলো খালি জায়গা পড়ে আছে, সেখানে কারো সঙ্গে পার্টনারশিপে মাল্টি স্টোরেজ বিল্ডিং করা যাবে। কোনো সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে আয়বর্ধক করা যাবে। সৌন্দর্যবর্ধনেও পার্টনার নেয়া যাবে।

সৌন্দর্যবর্ধন নীতিমালা : সৌন্দর্যবর্ধন নীতিমালায় ২৩টি অনুচ্ছেদ আছে। এসব অনুচ্ছেদের আলোকে প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রসমূহ, প্রকল্প বরাদ্দের পদ্ধতি, সৌন্দর্যবর্ধন সংক্রান্ত কমিটি, প্রকল্পের আবেদন প্রক্রিয়া, প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়সমূহ, প্রকল্প যাচাই বাছাই অনুমোদন, প্রকল্পের মেয়াদ, সালামিভাড়া ও ইজারা মূল্য পরিষদ, চুক্তির খসড়া অনুমোদন, ইজারা চুক্তি নবায়ন, ইজারা চুক্তি বাতিল, মেয়াদ পূর্তির পূর্বে চুক্তি বাতিল, প্রযোজ্য আইন ও নীতিমালা অনুসরণ, ইজারাকৃত ভূমির স্বার্থ হস্তান্তর বা সাবলিজ প্রদান, সৌন্দর্যবর্ধন সংক্রান্ত বিষয়ে নগর পরিকল্পনা শাখার দায়িত্ব স্পষ্ট করা হয়েছে।

এ নীতিমালার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়, সিটি কর্পোরেশনের সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পের প্রথম মূখ্য উদ্দেশ্য হবে নগরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে নান্দনিক ও সবুজ শহর হিসেবে গড়ে তোলা। এছাড়া কর্পোরেশনের মালিকানাধীন খালি জায়গাসহ রাস্তাঘাট, স্থাপনার উপর কর্পোরেশনের নিরঙ্কুশ দখল প্রতিষ্ঠা করা।

নীতিমালার আলোকে সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পের অনুমোদনের আগে যাচাইবাছাই করা হবে। এক্ষেত্রে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি কমিটি থাকবে। যাচাইবাছাই শেষে তারা প্রকল্প অনুমোদনের জন্য মেয়রের কাছে উপস্থাপন করবেন। সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্প লাভজনক হলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর এবং অলাভজনক হলে সর্বোচ্চ তিন বছরের জন্য বরাদ্দ দেয়া যাবে।

চসিক সূত্রে জানা গেছে, নগরে সৌন্দর্যবর্ধনে ২০১৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪২টি চুক্তি করে চসিক। এছাড়া ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২৮ জানুয়ারি ১০টি জায়গা সেলামি ও মাসিক ভাড়ার বিনিময়ে ব্যবহারের অনুমতি ও বরাদ্দ দেয়। এর বাইরেও বিভিন্ন সময়ে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে ফুটপাত বরাদ্দ দিয়েছে সংস্থাটি। এর মধ্যে সৌন্দর্যবর্ধন চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে এস্টেট (ভূসম্পত্তি) শাখা হতে কোনো নথি খোলা হয়নি। নগর পরিকল্পনা শাখার মাধ্যমে চুক্তি সম্পাদিত হলেও তাদেরকে এ সংক্রান্ত প্রশাসনিক দায়িত্ব অর্পণ করার কোনো রেজুলেশনও সংরক্ষিত নাই সংস্থাটির কাছে। আবার জায়গা বরাদ্দের ক্ষেত্রেও ন্যায্য মূল্যে না দেয়ার অভিযোগ আছে।

মার্কেট উপআইন : মার্কেট উপআইনে ২৯টি অনুচ্ছেদ আছে। নীতিমালাটি স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯ সালের ধারা ১২২এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকারের নির্দেশক্রমে উপআইনটি প্রণয়ন করা হয়।

এ উপআইনের আলোকে মার্কেটে দোকান বরাদ্দের জন্য প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি দোকান বরাদ্দ কমিটি থাকবে। কমিটি দোকান বরাদ্দের সুপারিশ প্রণয়ন ও অনুমোদনের জন্য মেয়রের নিকট উপস্থাপন করবে। উপবিধি৬ ধারায় দোকান বরাদ্দের অনুপাতের ক্ষেত্রে মার্কেট বা ভবন নির্মাণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে অগ্রাধিকার ভিত্তি দোকান বরাদ্দ প্রদানের বিধান রয়েছে। মার্কেটের অবশিষ্ট দোকানগুলোর ৭০ভাগ সাধারণ প্রার্থীদের দেওয়া হবে যার মধ্যে ১০ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। বাকি ৩০ শতাংশ মেয়র বা প্রশাসক বরাদ্দ দেবেন। তন্মধ্যে পাঁচ ভাগ দোকান সনদপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা বা তার পরিবারের সদস্য বা জাতীয় পর্যায়ে অবদান রেখেছেন এরূপ কোনো ব্যক্তি বা তার পরিবারের কোনো সদস্যের জন্য, তিন ভাগ কর্পোরেশন বা স্থানীয় সরকার বিভাগে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য এবং দুই ভাগ দোকান প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দ দেয়া হবে।

বিশেষ চুক্তি বিধিমালা : ‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন বিশেষ চুক্তি (বিল্ড, ওন, অপারেট অ্যান্ড ট্রান্সফারবিওওটি) বিধিমালা, ২০২২’এ ১৯টি অনুচ্ছেদ আছে। চুক্তির আওতায় চসিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কর্পোরেশনের আওতাধীন রাস্তা বা সড়কে অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং কর্পোরেশনের মালিকানাধীন ভূমিতে বাণিজ্যিক বা আবাসিক অথবা বাণিজ্যিক কাম আবাসিক ভবন নির্মাণ করতে পারবে। এছাড়া কর্পোরেশনের জন্য আর্থিকভাবে লাভজনক বা জনস্বার্থে প্রয়োজনীয় প্রতীয়মান হলে কর্পোরেশন সময়ে সময়ে এরূপ যৌথ অংশীদারিত্বমূলক প্রকল্প গ্রহণ করতে পারবে। এক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথ অংশীদারিত্বমূলক প্রকল্পে কর্পোরেশন জমি দিবে এবং বেসকারি প্রতিষ্ঠান অর্থ বিনিয়োগ করে চুক্তির আওতায় যৌথ অংশীদারিত্বের মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে।

এছাড়া একই পদ্ধতিতে ফ্লাইওভার, আন্ডারপাস, বাইপাস, বিশেষভাবে প্রয়োজনীয় কোনো সড়ক বা অবকাঠামো উন্নয়ন করতে পারবে চসিক। এছাড়া বহুতল বিভিন্ন মার্কেট বা কমার্শিয়াল কমপ্লেঙ, আবাসিক কাম বাণিজ্যিক ভবন, পেপার্কিং বা বহুতলবিশষ্টি পার্কিং, কমিউনিটি হল বা মাল্টিপারপাস হল, নার্সিং ইনস্টিটিউট, হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ, শিশু পার্ক, বিনোদন কেন্দ্র, সাফারি পার্ক, নভোথিয়েটর নির্মাণ করতে পারবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমানিকগঞ্জে শায়িত হলেন স্কোয়াড্রন লিডার আসিম জাওয়াদ
পরবর্তী নিবন্ধউপজেলা নির্বাচন নিয়েও আওয়ামী লীগের তৃণমূলে দ্বন্দ্ব বাড়ছে