বিশ্ব স্ট্রোক দিবস আজ। প্রতিবছর ২৯ অক্টোবর বিশ্ব স্ট্রোক দিবস উদযাপিত হয়। মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ কোনো কারণে বিঘ্নিত হলে স্ট্রোক সংঘটিত হয়। চট্টগ্রামে বাড়ছে স্ট্রোক রোগীর সংখ্যা। তবে স্ট্রোক রোগের চিকিৎসায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের নিউরোলজি ওয়ার্ডের সক্ষমতা আগের তুলনায় বাড়লেও এখনো তা পর্র্যাপ্ত নয়। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে শতাধিক রোগী ওয়ার্ডে ভর্তি থাকে। এছাড়া চিকিৎসক সংকটের কারণে ওয়ার্ডে ২৪ ঘণ্টা ভর্তি নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। সকাল ৮টা থেকে আড়াইটার মধ্যে আসা রোগীরাই কেবল নিউরোলজি ওয়ার্ডে সরাসরি ভর্তির সুবিধা পাচ্ছে। অন্যথায় স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীদের মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি দিতে হয় এবং পরবর্তীতে মেডিসিন ওয়ার্ডের চিকিৎসকরা নিউরোলজি ওয়ার্ডে প্রেরণ করেন।
নিউরোলজি ওয়ার্ডের চিকিৎসকরা বলছেন, বর্তমানে নিউরোলজি ওয়ার্ডে স্ট্রোক আক্রান্ত হওয়ার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আসা রোগীদের থ্রম্বোলাইটিক থেরাপি দেয়া হচ্ছে। ওয়ার্ডে এখন পর্যন্ত ৮ জন রোগীকে রক্ত জমাট বাঁধাজনিত স্ট্রোকের থ্রম্বোলাইসিস দেওয়া হয়েছে। এছাড়া মায়াসথেনিয়া গ্রেভিস রোগীর থাইমাস অপারেশনে কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের সাথে সমন্বয় করে কাজ করছেন চিকিৎসকরা। এখন পর্যন্ত বেশ ক’জন রোগীকে এই সেবা দেয়া হয়েছে। থাইমাস অপারেশনের ফলে রোগীর শারীরিক অবস্থা উন্নতি হয়। একইসাথে ওষুধের উপর নির্ভরশীলতা কমে আসে। অন্যদিকে গুলিয়ান বারি সিন্ড্রোমে (জিবিএস) আক্রান্ত দুই রোগীকে প্লাজমা ফেরিসিস করা হয়েছে। অন্যদিকে ওয়ার্ডে প্রতি সপ্তাহে এপিলেপসি ক্লিনিকে খিঁচুনি রোগী এবং হেডেক ক্লিনিকে মাথাব্যথার রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া স্ট্রোক ক্লিনিকে স্ট্রোকে আক্রান্ত ভর্তিকৃত রোগীদের পরবর্তী ফলোআপে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের নিউরোলজি বিভাগের তথ্য মতে, গত ২০২২ সালে ওয়ার্ডে স্ট্রোকে আক্রান্ত ভর্তি রোগী ছিলেন ৪ হাজার ৪১৭ জন, চলতি ২০২৩ সালের ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ হাজার ১০৭ জন।
ওয়ার্ডের চিকিৎসকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দুই ধরনের স্ট্রোক রয়েছে। একটি হলো ইসকেমিক স্ট্রোক। এর ফলে মস্তিষ্কের রক্তনালিতে রক্ত জমাট বেঁধে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে মস্তিষ্কে অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দেয়। এছাড়া আরেকটি হলো হেমোরেজিক স্ট্রোক। এই স্ট্রোকে মস্তিষ্কের রক্তনালি ফেটে রক্তক্ষরণ হয়।
জানতে চাইলে চমেক হাসপাতালের নিউরোলজি বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. পীযুষ মজুমদার বলেন, বয়স বাড়ার সাথে স্ট্রোকের ঝুঁকিও বাড়ে। নারীদের তুলনায় পুরুষেরা স্ট্রোক বেশি আক্রান্ত হন। আফ্রিকান ও এশিয়ানদের স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি। এছাড়া পুরনো হার্টের রোগীদের স্ট্রোকে আক্রান্তের ঝুঁকি বেশি। অন্যদিকে বংশগত কারণেও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। স্ট্রোক থেকে রক্ষা পেতে হলে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, ধুমপান বর্জন, কোলেস্টেরলমুক্ত খাবার, নিয়মিত ব্যায়াম, হার্টের অসুখের চিকিৎসাসহ দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনযাপন করতে হবে।
চমেক হাসপাতাল নিউরোলজি বিভাগের কনসালটেন্ট ডা. সীমান্ত ওয়াদ্দাদার দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমাদের দেশে স্ট্রোকে আক্রান্তদের মধ্যে শতকরা ৬০–৭০ ভাগ রোগী অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপের জটিলতা থেকে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে থাকে। যদিও স্ট্রোকের সঠিক কারণ নির্ণয় করা এখনো সম্ভব হয়নি। তবে বেশকিছু শারীরিক অবস্থা স্ট্রোকের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উচ্চ রক্তচাপ ছাড়ও অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস এবং বংশগত কারণেও স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
নিউরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জামান আহম্মদ বলেন, কিছু কিছু খাদ্য স্ট্রোকের জন্য পরোক্ষভাবে দায়ী। এরমধ্যে রয়েছে চিংড়ি, মাখন, দুধের স্বর, পান, সিগারেট ও তামাকজাতীয় যেকোনো পণ্য। অপরদিকে আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় আঁশযুক্ত শাক–সবজির রাখার পাশাপাশি মৌসুমী ফলমূল খেতে হবে। গরু ও খাসির মাংস খাওয়ার পরিমাণ কমাতে হবে। এছাড়া সপ্তাহে অন্তত পাঁচদিন ২০ মিনিট করে ব্যায়াম করতে হবে। অলস জীবনযাপন ও ফাস্টফুড জাতীয় খাবার অবশ্যই বর্জন করতে হবে।
চমেক হাসপাতাল নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. মো. হাসানুজ্জামান দৈনিক আজাদীকে বলেন, চট্টগ্রামে স্ট্রোক রোগের প্রকোপ বাড়ার পাশাপাশি চট্টগ্রাম মেডিকেলের নিউরোলজি ওয়ার্ডে সেবার মানও বেড়েছে। রোগীরা অনেক নতুন নতুন সেবা পাচ্ছে। এটি ঠিক আমাদের এখানে রোগীর চাপও বেশি। বৃহত্তর চট্টগ্রামের নোয়াখালী, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, কুমিল্লা, কক্সবাজার এবং তিন পার্বত্য জেলার স্ট্রোক আক্রান্ত রোগীদের জন্য একমাত্র ভরসা এই চট্টগ্রাম মেডিকেল। আমাদের সম্পদ সীমিত। এই সীমিত সম্পদের মধ্যেও আমরা রোগীদের সর্বোচ্চ দিয়ে আসছি। ফলে মৃত্যুহারও কমেছে। তবে চট্টগ্রামে যদি স্ট্রোকের চিকিৎসায় একটি মানসম্মত বিশেষায়িত হাসপাতাল গড়ে তোলা সম্ভব হয়, এক্ষেত্রে চমেক হাসপাতালের ওপর চাপটাও কমে যাবে।