চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ক্যাম্পাসে করোনাকালে বেড়েছে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য। বেড়েছে কিশোর অপরাধ। মাদক আদান প্রদানসহ নানা অপরাধকর্মে জড়াচ্ছে তারা। খেলাধুলা, ফেইসবুক পোস্ট কিংবা কথা কাটাকাটি থেকে হাতাহাতি। এরপর রূপ নেয় সংঘাতে। চবি ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজ, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি সার্ভিস (উস) উচ্চ বিদ্যালয় এবং স্থানীয় জোবরা স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা কলেজ এক্সপ্রেস (সিএক্স), চেতনা ৭১, মাইণ্ড অব সেভেন্টি ওয়ানসহ স্থানীয় কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত।
জানা যায়, মাইণ্ড অব সেভেন্টি ওয়ান গ্রুপটি প্রায় বিলুপ্ত। চেতনা ৭১ গ্রুপটি স্থানীয় কর্মচারিদের ছেলে এবং বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টের বাহিরে স্থানীয়দের দ্বারা পরিচালিত। চট্টগ্রামের বাহিরের কিন্তু চাকরির সুবাদে পরিবার এখানে থাকছে তারা রয়েছে সিএক্স গ্রুপে। এসব গ্রুপগুলোতে প্রায় তিন শতাধিক সদস্য রয়েছে। এ গ্রুপগুলো আবার বয়স, আবাসস্থল ও অঞ্চলবেধে বিভিন্ন সার্কেলে (গ্যাং) বিভক্ত। ক্যাম্পাসে এরকম ১৫টির বেশি সার্কেল রয়েছে। একেকটা সার্কেলে ১৫-২০ জন করে সদস্য রয়েছে। এদের সবার বয়স ১৪ থেকে ১৯ এর মধ্যে। তারা একসাথে চলাফেরা-আড্ডা এবং খেলাধুলা করে। ক্যাম্পাসের দুই নম্বর গেইট এলাকা, কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ, প্যাগোডা, স্লুইস গেইট, বোটানিক্যাল গার্ডেন এলাকা এবং উস উচ্চ বিদ্যালয়, চবি ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজে এদের আড্ডা বেশি। ক্যাম্পাসে উচ্চ গতিতে মোটরসাইকেল চালানো, এক রিক্সায় চার পাঁচজন উঠে উচ্চস্বরে গান গাওয়া, হৈ-হুল্লোড় করা, মেয়েদের বাজে অঙ্গভঙ্গি এবং বড়দের সাথে বেয়াদবিমূলক আচরণ করে বলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সচেতন মহলের। তাদের দাবি তথাকথিত বড়দের দ্বারা পরিচালিত এসব গ্রুপগুলো দিন দিন গ্যাংয়ে পরিণত হচ্ছে। যার পরিণাম খুব ভয়াবহ হবে। এছাড়া মাদকেও এদের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে এক সার্কেলের একজনকে মারলে বাকিরা বিষয়টি খতিয়ে না দেখে অপর পক্ষকে আক্রমণ করছে। এভাবে গ্রুপে গ্রুপে গড়ায় মারামারি। বিভিন্ন সময় এসব বিষয়কে কেন্দ্র করে বড়দেরও সংঘর্ষে লিপ্ত হতে দেখা যায়। আবার স্থানীয় কারো সাথে অস্থানীয় কারো ঝামেলা হলে তখন স্থানীয় ও অস্থানীয়রা জড়ায় বিরোধে। তবে বেশির ভাগ সময় সিএক্স এবং স্থানীয়দের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে দেখা যায়।
গত ৪ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র দুই নম্বর গেইট এলাকায় সিএক্স ও স্থানীয়দের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ঘটনার জেরে ৮ সেপ্টেম্বর দুই পক্ষের মধ্যে আবার সংঘর্ষ হয়। এতে মামুন নামে এক কলেজ ছাত্র আহত হয়। গত আট মাসে এরকম ১০টিরও বেশি সংঘর্ষের খবর মিলেছে। অভিযোগ উঠেছে এসব কিশোররা মাদক আদান প্রদানের সাথেও জড়িত। ক্যাম্পাসে রাতের বেলা প্রায় জায়গায় বসে গাঁজার আসর। স্লুইস গেইট, ল্যাবরেটরি স্কুলের ছাদে, পুরাতন আইন অনুষদ ও উস স্কুলের ছাদে বসে ইয়াবার আসর। উস স্কুল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়- প্রায়ই দরজার তালা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে কেউ কেউ মাদক সেবন করে। বড়রা এ কাজে কিশোরদের ব্যবহার করে বলেও জানা যায়। কর্মকর্তা-কর্মচারীর সন্তান ছাড়াও জোবরা গ্রাম ও রেলগেইট এলাকার কিশোররা এসব অপরাধের সাথে জড়িত। এসব কাজে ক্যাম্পাসের কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক নেতাদের মদদ রয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
গত ৫ মে চবির টেলিটক পাহাড়ে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে মাদকের আস্তানা থেকে হাতেনাতে ৪৪ পিস ইয়াবা ও ২টি চাপাতিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ কর্মচারী ও ১ দোকানিকে আটক করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ঘন্টা হিসেবে ইয়াবা সেবদীদের সেই আস্তানা ভাড়া দিত তারা। এ কাজে কিশোরদের ব্যবহার করা হত জবাবন্দিতে এমন বক্তব্যই দিয়েছিলেন এ তিন অভিযুক্ত। এর আগে গত বছরের ১ জুলাই ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজে পরীক্ষা চলাকালীন একটি পরিত্যক্ত ব্যাগ থেকে ৪ পিস ইয়াবা এবং একটি মোবাইল পাওয়া গিয়েছিল। কে বা কারা এ ব্যাগের মালিক কোথায় থেকে আসল এসব খতিয়ে দেখতে তৎকালীন দুই সহকারী প্রক্টরকে সদস্য করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল সেই সময়। আজ অবধি কোনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি সেই তদন্ত কমিটি। অভিভাবকদের দাবি- বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষসহ সকলকে এ ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। কিশোর গ্যাং নামক অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় এটি নির্মূল করা সম্ভব নয়।
কিশোর অপরাধ বাড়ার কারণ জানতে চাইলে চবি ক্রিমিনোলজি পুলিশ সায়েন্স বিভাগের প্রভাষক মো. সাখাওয়াত হোসেন আজাদীকে বলেন, ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পদচারণা কম। এতে কিশোর সুযোগ পেয়েছে অপরাধ করতে। বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকলে নিরাপত্তার বিষয়টাও আরো কঠোরভাবে দেখা হতো। আর অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে কিশোররা নানাবিধ পারিপার্শ্বিকতার কারণে আগ্রহী হয়ে উঠে। যে বিষয়গুলোর কারণে অপরাধীরা অপরাধ সংঘটনে উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকে সেগুলো হাতের নাগালেই পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বলেন, অপরাধ থেকে কিশোরদের নিবৃত্ত করার জন্য যে ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বহাল রাখা প্রয়োজন তার সংকট দেখা যায় সেটা হোক পারিবারিক, সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে।
তবে কিশোর অপরাধ বন্ধে প্রশাসনের নজরদারি রয়েছে বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া। তিনি আজাদীকে বলেন, কিশোর গ্যাং বলে আগে কিছু ছিল না। করোনার কারণে হয়তো এরা সুযোগ পেয়েছে। কিশোর অপরাধ এবং মাদক নির্মূলে আমরা শক্ত অবস্থানে আছি। অপরাধ দমনে নিজের সন্তানের প্রতি অভিভাবকদের দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বানও জানান তিনি।
এব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বরত কর্মকর্তা মো. দুলাল আজাদীকে বলেন, আসলে এ ধরনের কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে আসেনি। আমরা তো সব সময় পরিদর্শনের মধ্যে আছি। এরকম দেখলে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করি।