প্রথম শিল্প বিপ্লব সূচিত হয়েছিল ইংল্যান্ডে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে। আজকের ৪র্থ বিপ্লবের যে যাত্রা তার সূচনা ঘটেছিল হস্তচালিত যন্ত্রের মাধ্যমে। নদীর স্রোত ছিল এসব হস্তচালিত মেশিনের চালিকা শক্তি। ফলশ্রুতিতে মেশিন ভিত্তিক কারখানা গড়ে ওঠেছিল ছোট ছোট নদীর তীরে। ১৭৬৯ সালে জেমস ওয়াটের বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আবিষ্কার এবং পরবর্তীতে এর অগ্রগতি অর্জিত হলে বাষ্পীয় ইঞ্জিন হয়ে উঠে কারখানা সমূহের মূল চালিকা শক্তি। ফলে কারখানা সমূহ নদীর তীরে সীমাবদ্ধ না থেকে তা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। এতে শিল্পের আকার এবং শিল্প কারখানায় পুঁজির বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়। প্রথম শিল্প বিপ্লবের কারণে উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। মানুষের কায়িক শ্রমের বড় অংশ যান্ত্রিক শক্তি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয় এবং শ্রমের উৎপাদনশীলতার গুণগত পরিবর্তন আসে। মাথাপিছু উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
প্রযুক্তির বিকাশ প্রথম শিল্প বিপ্লবে থেমে ছিল না। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি প্রথম শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তিগত সাফল্যের পূর্ণতা অর্জন করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ্বে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে অর্থাৎ ১৮৭০ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত সময়কালকে ২য় শিল্প বিপ্লবের সময়কাল হিসাবে ইতিহাসে চিহ্নিত করা হয়। বিদ্যুৎ এর আবিষ্কার ছিল ২য় শিল্প বিপ্লবের মূল সফলতা। শিল্পের চালিকা শক্তি বাষ্পীয় ইঞ্জিনের পরিবর্তে বিদ্যুৎ চালিত ইঞ্জিন দখল করে নেয়। শুধু তাই নয়। যে সব ক্ষেত্রে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের প্রয়োগ সম্ভব ছিল না, সেসব ক্ষুদ্রাকার পরিধির এবং ভোগ্যপণ্যের উৎপাদনে চালিকা শক্তি হিসাবেও বিদ্যুৎ কাজ করতে সক্ষম হয়। রাসায়নিক শিল্পের আবিষ্কার ছিল ২য় শিল্প বিপ্লবের আরেকটি বড় সফলতা। যার ফলশ্রুতিতে প্লাস্টিক, কৃত্রিম রাবার, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ঔষধ ইত্যাদি উৎপাদনেরও সূচনা ঘটে। এছাড়া লোহা উৎপাদনের ক্ষেত্রে কুপার চুল্লীর উদ্ভাবন, ইস্পাত উৎপাদনে বেসেমার পদ্ধতির প্রবর্তন, যন্ত্র উৎপাদনের জন্য যন্ত্রের উদ্ভব, পেট্রোলিয়াম উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ, মোটর গাড়ির উদ্ভব ও উৎপাদন, টেলিফোনের আবিষ্কার, টেলিযোগাযোগ এবং জাহাজ শিল্পের বিকাশও ছিল ২য় শিল্প বিপ্লবের ফলাফল।
২য় শিল্প বিপ্লব পরবর্তী ১৯৫০ এর দশকে কম্পিউটার আবিষ্কার হয়। তবে কম্পিউটারগুলো ছিল আকারে বড়। আবার কম্পিউটার গুলো কেবল মাত্র বড় প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু ৮০’র দশকে ডেস্কটপ কম্পিউটার এবং পরবর্তীতে ল্যাপটপ কম্পিউটার আবিষ্কার হয়। কম্পিউটার থেকে কম্পিউটার সংযোগ স্থাপন তথা ইন্টারনেট আবিষ্কার, পরবর্তীতে মোবাইল ফোনের আবিষ্কার এবং মোবাইলের সাথে ইন্টারনেটের সংযোগ বিশ্বব্যপী যোগাযোগ মাধ্যমে এর বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। যা ২য় শিল্প বিপ্লবকেও ছাড়িয়ে যায় এবং মূলত ইন্টারনেটের ব্যবহারের ফলে প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মাধ্যমে পৃথিবীতে ব্যাপক পরিবর্তন সংগঠিত হয়। বিশ্বব্যাপী এ পরিবর্তনকে ৩য় শিল্প বিপ্লব হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
বর্তমানে পৃথিবীতে আরো নতুন নতুন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির আবির্ভাব ঘটছে। রোবটের সাথে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যুক্ত হয়ে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন ধরনের মেশিন, যা কেবল মানুষের কায়িক শ্রমকে প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম নয় বরং মানুষের মানসিক শ্রম ও বুদ্ধিমত্তাকেও প্রতিস্থাপন করার ক্ষমতা রাখে। প্রযুক্তির এই অগ্রগতিকে পর্যবেক্ষকরা ৪র্থ বিপ্লবের আগমন হিসাবে আখ্যায়িত করছে। অর্থাৎ পৃথিবী এখন ৩য় শিল্প বিপ্লব অতিক্রম করে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের মহা সড়কে যাত্রা শুরু করেছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ছাড়াও ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের যাত্রা পথে যুক্ত হয়েছে ত্রিমাত্রিক মুদ্রণ, জীব প্রযুক্তি তথা বায়ো-টেকনোলজি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, জিন এডিটিং ইত্যাদি বিস্ময়কর প্রযুক্তি। বলা হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে অদূর ভবিষ্যতে মানুষের চিকিৎসার জন্য আর কোন ডাক্তার প্রয়োজন হবেনা। মানুষের অনেক জটিল অপারেশন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাযুক্ত রোবটের মাধ্যমে করা সম্ভব হবে। গাড়ি চালানোর জন্য ভবিষ্যতে আর ড্রাইভার প্রয়োজন হবেনা। সুতরাং প্রশ্ন জাগে, ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের অগ্রগতি কি মানব সমাজের মানসিক এবং কায়িক শ্রমের প্রয়োজনীয়তা সংকুচিত করে দিচ্ছে? আমাদের ১৮ কোটি মানুষের দেশে শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয় কোটি। এখানে দক্ষ-অদক্ষ কিংবা অর্ধ দক্ষ শ্রমিকের সম্মিলন ঘটেছে। এ সকল শ্রমিকের উপর ভর করে গড়ে উঠেছে শ্রমঘন শিল্প কারখানা। ৪র্থ শিল্প বিপ্লব যত বেশি অগ্রসর হবে তত বেশি শ্রমঘণ শিল্প কারখানার প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পাবে এবং বৃদ্ধি পাবে উচ্চতর প্রযুক্তি নির্ভর মূলধন ঘন শিল্প কারখানা। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায়, ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের আগমন এদেশের ব্যাপক শ্রমজীবী মানুষের জন্য সুখকর হবেনা। ব্যাপক শ্রমিক চাকরি হারাবে। ১ম এবং ২য় শিল্প বিপ্লবের সময়েও শ্রমজীবী মানুষের চাকরি হারানোর চ্যালেঞ্জ ছিল। কিন্তু উক্ত সময়ের চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে শ্রমজীবী মানুষ তাদের অধিকারের প্রশ্নগুলোর ব্যাপারেও বিশ্ববাসির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। ফলে ১ম ও ২য় শিল্প বিপ্লবকালীন শ্রমিকশ্রেণির বড় অগ্রগতি ছিল দৈনিক শ্রমঘন্টা সর্বোচ্চ ৮ ঘণ্টা হিসাবে স্বীকৃতি অর্জন করা। উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত দৈনিক শ্রমঘন্টা সুনির্দিষ্ট ছিলনা। তখন শ্রমিকদেরকে দৈনিক ১২ থেকে ২০ ঘন্টা পর্যন্ত শ্রম দিতে হতো। ১ম ও ২য় শিল্প বিপ্লবের সময় উৎপাদন প্রক্রিয়ার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। উৎপাদনের গতি ও দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। ফলশ্রুতিতে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিশ্বব্যাপী দৈনিক ৮ ঘন্টা শ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশ্য এ ব্যাপারে ১৮৮৬ সালের শ্রমজীবী মানুষের রক্তস্নাত আন্দোলনও অন্যতম প্রভাবক হিসাবে কাজ করেছিল। কেননা দৈনিক ৮ ঘন্টা শ্রম প্রতিষ্ঠা করাই ছিল ১৮৮৬ সালের শ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।
বর্তমানে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের পূর্ণতার যাত্রাপথে, প্রযুক্তির একের পর এক অভাবনীয় সফলতা বিশ্ববাসির জন্য যেমন আনন্দবার্তা বয়ে আনছে তেমনি শংকার কারণ হয়েও দাঁড়িয়েছে। বিশ্ববাসী এ পর্যন্ত ৩টি শিল্প বিপ্লব প্রত্যক্ষ করেছে।
অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায় শিল্প বা প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রার একটা বিপরীতমুখী সম্পর্ক রয়েছে। প্রযুক্তির উন্নয়নের উল্টো পিঠে আমরা দেখতে পাই, শিল্পে বা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যন্ত্রের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে এবং শ্রমের ব্যবহার কমে যাচ্ছে। অর্থাৎ শ্রম ঘন শিল্পের পরিবর্তে মূলধন ঘন শিল্পের প্রাধান্য ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যাপক মানুষ বেকার হয়ে পড়ার শংকা তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে কম দক্ষ বা অদক্ষ মানুষের ক্ষেত্রে এ সমস্যা সবচেয়ে বেশি প্রকট হচ্ছে। প্রযুক্তির উন্নয়নের সুফল বিশ্বের সব মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। এ যেন বিশ্ব যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। প্রযুক্তির অগ্রগতি হচ্ছে বটে তবে এর নিয়ন্ত্রণ কতিপয় পুঁজিপতি এবং প্রযুক্তি জ্ঞানে সমৃদ্ধ হাতেগোনা কিছু সৌভাগ্যবান মানুষের কাছে সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে মানুষে মানুষে বৈষম্য আরো বাড়বে। যা বিশ্বকে একটা ভয়াবহ মানবিক বিপর্জয়ের পথে ঠেলে দিবে তাতে কোন সন্দেহ নাই। জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি, মাথা পিছু জাতীয় আয় বৃদ্ধি, বড় বড় দালান কোঠা, রাস্তা ঘাট, ফ্লাইওভার তৈরি এবং প্রযুক্তির অগ্রগতি কখনোই মানব জাতির জন্য কল্যাণকর হবেনা যদি না এর সুফলের অংশীদার শ্রমজীবী তথা দারিদ্র পীড়িত প্রান্তিক মানুষ হতে পারে।
এটি আজ সুস্পষ্ট যে, প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে মূলধন ঘন শিল্প বাড়ছে ফলে বিশ্ব আজ কর্পোরেট পুঁজির পূর্ণ দখলে। ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের অগ্রগতি এবং কর্পোরেট পুঁজির নিয়ন্ত্রণ যেন একই সমান্তরালে এগিয়ে চলছে। কর্পোরেট পুঁজি শিল্প খাত পেরিয়ে কৃষিতেও হানা দিয়েছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, সমপ্রতি ভারতের কৃষক আন্দোলন কর্পোরেট পুঁজির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মহা বিস্ফোরণ।
কর্পোরেট পুঁজির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ভারতে কৃষক আন্দোলন থেকে বিশ্ববাসিকে শিক্ষা নিতে হবে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে গরীব, মেহনতি এবং শ্রমজীবী মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার দায়িত্ব, আদর্শিক শক্তি ও ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনগুলোকে নিতে হবে। প্রযুক্তিকে কর্পোরেট পুঁজির নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করে গণমানুষের কল্যাণে এর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু কাজটি খুব সহজ নয়। এটা একটি রাজনৈতিক ও আদর্শগত লড়াই। বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় এ লড়াইকে এগিয়ে নেয়ার মত রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং শক্তি সমাবেশের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। অথচ শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি ছাড়া প্রযুক্তির অগ্রগতির কোন সুফল আসবেনা।
দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির বিজয় অর্জিত হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন। আমাদের বিজয়ের ৫০ বছর উদযাপনের মহেন্দ্রক্ষণে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবকে মানব কল্যাণমুখী করতে পারাই হবে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
লেখক : সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি