চট্টগ্রাম : স্বাস্থ্য ও চিকিৎসায় কী নাই কী চাই

অধ্যাপক ইমরান বিন ইউনুস, চিকিৎসাবিজ্ঞানী | বৃহস্পতিবার , ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৮:০১ পূর্বাহ্ণ

সাগরের পাড়ে পাহাড়ে হেলান দেয়া ও কর্ণফুলির তীরে অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী চট্টগ্রাম শিল্প নগরী ও বাণিজ্যিক রাজধানী। বাংলাদেশের আবহমান সামুদ্রিক বন্দর। দেশের অন্যতম প্রাচীন ও প্রবেশ পথ সুবাদে চট্টগ্রাম স্বাগত জানিয়েছে নানা ভাষা, বর্ণ, বিশ্বাস, গোষ্ঠির মানুষকে। চট্টগ্রামের যে কোনো জনসমাবেশে তা দেখা যায়। জীবন সংশ্লিষ্ট পাঁচটি মৌলিক প্রয়োজন হলো অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। ভালো ভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে সব কিছুর কেন্দ্রে হলো স্বাস্থ্য। স্বাস্থ্যের পরিধি ব্যাপক। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (বিস্বাস) সংজ্ঞা হলো, স্বাস্থ্য সামগ্রিকভাবে দৈহিক, মানসিক ও সামাজিক হিতাবস্থা এবং যা শুধুমাত্র রোগ বা অক্ষমতার অনুপস্থিতি নয়’। স্বাস্থ্য ব্যাপক অর্থে প্রয়োগ হলেও চিকিৎসা ব্যবস্থার আলাদা দ্যোতনা আছে, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সমার্থক নয়। স্বাস্থ্য আর চিকিৎসার সূচক পুরোপুরি একও নয়। তবে স্বাস্থ্য রক্ষায় চিকিৎসার গুরুত্ব অপরিসীম। দিনে দিনে চট্টগ্রামের গুরুত্ব বাড়ছে। বাড়ছে বহুবিধ চিকিৎসার প্রয়োজন। অন্যদিকে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় চিকিৎসার নতুন নতুন পদ্ধতি ও পন্থার উদ্ভব হচ্ছে। যা প্রাগ্রসর প্রযুক্তি, প্রশিক্ষিত জনশক্তি নির্ভর ও ব্যয়বহুল। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা দুই বিষয়ের সমস্যাগুলো সম্পূরক ও পরিপূরক। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসায় চট্টগ্রামে চ্যালেঞ্জ সমুহ জরুরি ভিত্তিতে নির্ণয় ও সমাধান প্রয়োজন।

চট্টগ্রামের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য ক্যানভাস পরিবীক্ষণ ও পর্যালোচনায় অবস্থা খুব সুখকর মনে হবে না। চিকিৎসা সেবাকে জীবন সংকটের স্কেলে কয়েক ভাবে ভাগ করা হয়। অতি জরুরি, জরুরি, নিয়মিত ও প্রান্তিক। অন্যভাবে ভাগ হলো সাধারণ নিরাময় যোগ্য, জটিল, অনিরাময় যোগ্য, শেষ অবস্থা। এক এক ধরনের রোগীদের সমস্যা এক এক ধরনের। কিন্তু কিছু সমস্যা সাধারণ। চিকিৎসা কেন্দ্রের অপ্রতুলতা ও একই জায়গায় কেন্দ্রীভূত, যাতায়াতের সমস্যা, ভীড়, অব্যবস্থাপনা, অস্বাস্থ্যকর অবস্থা, চিকিৎসা ও সহায়তা সাধারণ কর্মীর স্বল্পতা বা অবহেলা বা অযথাযথ সমমর্মিতা, চিকিৎসা উপকরণের দুষ্প্রাপ্যতা, চিকিংসা যন্ত্রপাতির রক্ষণাবেক্ষণে অবস্থাপনা ও বিকল হয়ে থাকা, সময়মত সেবা না পাওয়া, নগরে চিকিৎসাকেন্দ্রগুলির অসম বিন্যাস বা অবস্থান, সরকারি ও বেসরকারি কেন্দ্র সমুহের মধ্যে আনুষ্ঠানিক সমন্বয় না থাকা, তথ্য সংরক্ষণে অমনোযোগিতা ও অবহেলা, তথ্যভিত্তিক তত্ত্ব বিবর্ধিত না করা, সবকিছুতে সময় ক্ষেপণ ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ইত্যাদি। সাথে আছে দালাল ও দুষ্টু চক্র যারা চিকিৎসা নিয়ে রোগীদের প্রতারণা ও শোষণ করে। স্বাস্থ্যের ভিন্ন ভিন্ন শাখার পারঙ্গমতাও খুব ভালো না, ইপিআই টিকাদান ও মা ও শিশু স্বাস্থ্যের কিছু সফলতা ছাড়া। প্রাথমিক স্বাস্থ্যের উপাদানগুলি হলোঃ ১. স্বাস্থ্য শিক্ষা, . যথাযথ সরবরাহ সহ সুষম খাদ্য পাওয়া, . মা ও শিশু স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, . পর্যাপ্ত নিরাপদ পানি সরবরাহ ও পয়:নিষ্কাশন, . রোগ প্রতিরোধক টিকাদান, . স্থানীয় ভাবে প্রাদুর্ভাবের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ, . প্রচলিত সাধারণ রোগ ও জখম সমুহের যথাযথ চিকিৎসা, এবং ৮. অত্যাবশকীয় ওষুধের প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। প্রাথমিক স্বাস্থ্যের উপাদানগুলির কোনোটিরও অবস্থা ও মান সন্তোষজনক নয়। চট্টগ্রামে সত্যিকারভাবে কোনো বিশেষায়িত হাসপাতাল নেই। খণ্ডিত একটি প্রশাসনিক বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়েছে। এককালের সবচেয়ে কার্যকরী প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থা, জেনারেল প্রাকটিস ধীরে ধীরে লোপ পেয়ে যাচ্ছে। নেই কোনো চিকিৎসা সেবা কর্মী বা প্রতিষ্ঠান সুরক্ষার যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা বা নিরাপত্তা জাল। অন্যদিকে নাই চিকিৎসা ব্যবস্থায় দায়বদ্ধতার প্রয়োগ। সুযোগ, সামর্থ ও আস্থার অভাবের এক দুষ্টু চক্র সৃষ্টি হয়ে চলছে ও স্বাস্থ্য বাণিজ্য এবং স্বাস্থ্য পর্যটন দিনে দিনে বাড়ছে।

চ্যালেঞ্জগুলোকে সাধারণত নিম্নরূপে বিন্যস্ত করা যায়

. সুযোগের অভাব

. সামর্থের অভাব

. আস্থার অভাব

সুযোগের অভাব

. নন কম্যুনিকেবল রোগ সমুহের সময়োপযোগী রোগ চিকিৎসার প্রতুলতা প্রকট। এসবের মধ্যে আছে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সিস্টেমের রোগ সমুহ। ডায়বেটিস, হৃদরোগ, টিউমার ও ক্যানসার, বিভিন্ন বিকলঙ্গতা, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন, প্লাস্টিক সার্জারী, জটিল অপারেশন, অথবা উদ্ভাবনীর নতুন বা বিকল্প ভাবনার চিকিৎসা। সবই খুবই অপ্রতুল বা নেই।

. কম্যুনিকেবল তথা সংক্রমণ রোগেও সার্বিক পরিবীক্ষণ পর্যালোচনার সুযোগ কম। সংক্রমণের কারণ ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ফাংগাস, প্যারাসাইট ইত্যাদি বের করা অনেক সময় সম্ভব হয় না।

. অত্যাধুনিক রোগ নিরূপণী এবং নিত্যনতুন যথাযথ সংযোজন ও হাল নাগাদের অপ্রতুলতা।

. চিকিৎসা রেফারেল নেটওয়ার্কিং এর অভাব। চিকিৎসা কার্যক্রম এককভাবে কোনো সেন্টার বা ব্যক্তি প্রায়ই করতে পারেন না। যেমন রোগ নিরূপণে তেমন চিকিৎসায়। চিকিংসা বা স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রমের স্বীকৃত তিনটি পর্যায় আছে। প্রাথমিক বা প্রাইমারি, মাধ্যমিক বা সেকেন্ডারি, টারসিয়ারি বা তৃতীয় পর্যায়। প্রত্যেক পর্যায়ের সেবা ও কাজের পরিধি নির্ধারণ করা আছে। তাছাড়া আছে বিশেষায়িত পর্যায়। প্রাইমারি কেন্দ্রগুলি হলো উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, মাধ্যমিক হলো জেলা সাধারণ হাসপাতাল, তৃতীয় পর্যায়ের হাসপাতাল আসলে বাংলাদেশে প্রায়শ নেই। সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলো তৃতীয় পর্যায়ের হাসপাতাল হিসাবে চালানো হচ্ছে। ফলে হাসপাতালের একাডেমিক কার্যক্রম যেমন বিঘ্নিত হয় তেমনি রোগীর চিকিৎসাও যথাযথ হয় না। রাজধানীর বাইরে, কয়েকটি শহরে রোগ ভিত্তিক কয়েকটি বিশেষায়িত হাসপাতাল আছে। যেমন হৃদরোগ, কিডনী রোগ, স্নায়ুরোগ, ক্যানসার, হাড় ও জোড়া রোগ ইত্যাদি। এসব পর্যায় ও কেন্দ্রগুলির মধ্যে কোনো রেফারেল নেটওয়ার্ক নেই, নেই কোনো স্ট্যান্ডার্ড অপারেশন প্রসিজিওর। প্রতি পর্যায়ে রোগীগণ হেনস্থার স্বীকার হন। একই ভাবে জেনারেল বা প্রান্তিক চিকিৎসক থেকে বিশেষজ্ঞ, বিশেষজ্ঞ থেকে বিশেষজ্ঞ পর্যায় পর্যন্ত প্রাইভেট চিকিৎসায়ও কোনো রেফারেল ব্যবস্থা কার্যকর নেই।

. রোগ নিরূপণী বা ডায়গনোষ্টিক ল্যাব ব্যবস্থার রেফারেল সংযোগ ও নেই। আধুনিক রোগ নিরূপণী ব্যবস্থা সমূহ উচ্চতর প্রযুক্িত, প্রশিক্ষিত জনশক্তি নির্ভর ও ব্যয়বহুল। তাই সরকারি হাসপাতাল সমুহে রোগ নিরূপণী সুযোগ খুব কম ও অনিয়মিত। ফলে রোগীদের ও চিকিৎসকদের বেসরকারি ব্যবস্থার উপর নির্ভর করতে হয়। আঞ্চলিক রেফারেল ল্যাবের অভাবে কিছু টেস্টেরে জন্য অতি উচ্চ মূল্য দিতে হয়। এছাড়া সরকারি ও বেসরকারি আনুষ্ঠানিক অংশিদারিত্ব থাকলে রোগ নিরূপণীর অনেক সমস্যা লাঘর হয়ে সবার জন্য সহজ ও সাশ্রয়ী হতো। বেশির ভাগ বায়োকেমিকেল টেস্ট ব্যাচে করতে হয়, ৫০১০০ টেস্ট করতে যে পরিমান রিএজেন্ট লাগে ১ টেস্টেও একই। কারণ রিএজেন্ট প্রস্তুত করার পর তার শেলফ লাইফ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টা। তারপর রিএজেন্ট ফেলে দিতে হয় না হলে টেস্ট রেজাল্ট সঠিক হবে না। ল্যাবগুলির মধ্যে রেফারেল সংযোগ থাকলে রিএজেন্ট সাশ্রয়ের ফলে টেস্ট ফি কমে যেত।

সামর্থের অভাব

অনেক আগের সমীক্ষায় প্রতীয়মান হয় মাত্র শতকরা পচিশ ভাগ রোগী বাধ্য হয়ে সরকারি ব্যবস্থায় চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করেন। তাও পুরোপুরি না। রোগীরা সাধারণত প্রান্তিক কম উপার্জনের। বেশিরভাগ প্রয়োজনীয় পরীক্ষা সমূহ ও অনেক চিকিৎসা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে নিতে হয়। কারণ অপ্রতুলতা বা না থাকা। দেশে কোনো তৃতীয় পাক্ষিক মূল্য পরিশোধ বা ইন্সিওরেন্স বা জাতীয়ভাবে ব্যয়পূরণ ব্যবস্থা না থাকায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজ খাত থেকে ব্যয় সামাল দিতে হয়। প্রায় সময় এই ব্যয় আর্থিক ক্ষমতার অনেক বাইরে। ফলে রোগী পুরো চিকিৎসা সমপন্ন না করেই বেসরকারি হাসপাতাল ত্যাগ করে সরকারি হাসপাতালে যান বা সরকারি হাসপাতালে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না থাকলে সামথানুযার্য়ী বেসরকারি হাসপাতালে যান। না থাকলে বিনা চিকিৎসায় কষ্টে ধুকে ধুকে কাটান বা মৃত্যুবরণ করেন। বেসরকারি চিকিৎসা সেবা তৃতীয় পাক্ষিক মূল্য পরিশোধ ব্যবস্থা চালু করা না পর্যন্ত বেশির ভাগ জনগণের ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকবে। সরকারি চিকিৎসা সেবায় প্রয়োজন প্রতিবন্ধকতা নিরূপণ করে যথাযথ ব্যবস্থায় তা পরিচালনা করা।

আস্থার অভাব

এটা বলা হয়ে থাকে রোগীর সন্তুষ্টিই হলো চিকিৎসা ব্যবস্থার মান ও কার্যকারিতার সব চেয়ে বড় সূচক। বিদ্যমান চিকিৎসা সেবায় এই সূচকের মান সবচেয়ে নিম্নে। যদিও অনেক সময় ঢাক ঢোলের শোরগোলে অনেক বড় বড় দাবী করা হয়। আস্থা তখনি তৈরী হয় যখন চিকিৎসায় রোগীর প্রত্যাশার ফলাফল গুণগত মান সহ প্রতীয়মান হয়। মেডিকেল দার্শনিকগণ কর্তৃক সংগৃহীত রোগীদের চিরায়ত প্রত্যাশা সমুহ। রোগীরা চান: , তাদের চিকিৎসকগণ তাদের সব কথা শুনবেন ও বুঝার চেষ্টা করবেন, . তাদের রোগের বস্তা মনে না করে মানুষ ভেবে আচরণ করবেন, . যথাযথ জ্ঞান ও দক্ষতা ধারণ করবেন, . রোগ ও চিকিৎসা সম্পর্কে যৌক্তিক ধারণা দেবেন এবং ৫. যেকোনো অবস্থার উদ্ভব হোক না কেন তাদের চিকিৎসক তাদের পরিত্যাগ করবেন না। পরিবীক্ষণে পাওয়া যাবে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা ও চিকিৎসকগণ জনগণের চিরায়ত প্রত্যশা সমুহ মিটাতে হয়ত ব্যর্থ হচ্ছেন তাই আস্থাহীনতার এই মহামারী। বিত্তশালী ও ক্ষমতাবান তারা কখনই দেশের চিকিৎসায় আস্থাবান নন। কারণ তারা ভিন্ন ভিন্ন কারণে তাদের ইগো ও ইচ্ছাপূরণ করে, দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় অনাস্থার বলয় সৃষ্টিতে।

একটি সহজ সরল সমীক্ষা

সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এবং চেম্বারে আসা কয়েকজন রোগীকে নিবিড় ভাবে অনুসরণ করলে চিকিৎসা সেবা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সমস্যাগুলো অবলোকন ও অনুধাবন করা যাবে। জরুরি ও বহিঃবিভাগে আসা রোগী, ভর্তির রোগী, অন্তঃবিভাগের রোগী, অপারেশনের রোগী, টেস্ট করতে আসা রোগী। রোগীর চিকিৎসার কাগজ পত্রাদি ও ডকুমেন্টেশন ও রেকর্ড সমুহ পর্যবেক্ষণ। সরকারি হাসপাতালের আউটডোর টিকেট দেখলেই উপলব্ধি হবে কতটুকু অবহেলা বা অজ্ঞতা রোগীর রোগের বর্ণনা ও চিকিৎসায়। টিকেটটার আকার হলো প্রায় ৪ বাই৩ ইঞ্চি, যথাযথ বর্ণনা বা নির্দেশনা যাতে দেয়া যাবে না।

বাস্তবতার চিত্র

রাতের বেলায় কোনো রোগীর ইমারজেন্সী অপারেশনের প্রয়োজন হয় তখন সে অনেক না এর সম্মুখীন হতে হবে যদি তার পকেট শক্তিশালী না হয়। সরকারি হাসপাতালে ঠাঁই পেলেও পরীক্ষা ওষুধ ইত্যাদির জন্য ছুটতে হবে। পড়তে হবে অনেক টানাটানিতে। চট্টগ্রামে এমনকি রক্তের অত্যন্ত সাধারণ অতি প্রয়োজনীয় টেস্ট কাউন্টের রিপোর্ট সাধারণত ২৪ ঘণ্টার আগে পাওয়া যায় না। যেসব টেস্টে বিশেষজ্ঞের উপস্থিতি প্রয়োজন সেখানেই সময়ক্ষেপণটা বেশি। সরকারি হাসপাতালগুলোর ইমারজেন্সী সেবা যথাযথ নয়। মোটামুটি একই অবস্থা বেসরকারি হাসপাতালগুলোরও। সরকারি হাসপাতালে উপকরণের অভাব আর বেসরকারিতে হলো দক্ষ জনবলের। প্রায় বেসরকারি হাসপাতাল ভিজিটিং বিশেষজ্ঞদের উপর নির্ভরশীল। কিছু অত্যন্ত প্রয়োজনীয় রোগ নিরূপণী পরীক্ষা সহজ লভ্য নয়। যেমন কিডনী বায়োপসী। আবার কিছু চিকিৎসারও দারুন অপ্রতুলতার জন্য সমস্যা হয়। যেমন ডায়ালাইসের জন্য এভিএফ তৈরী করা যা হলো একটা ছোট অপারেশনের মাধ্যমে ধমনী ও শিরাকে যুক্ত করা যা দিয়ে রক্ত পরিশুদ্ধতার জন্য রক্ত প্রবাহকে মেশিনে সংযোগ দেয়া। একাধিক বিশেষজ্ঞের রেফারে সমস্যা হয় ও রোগীর ভোগান্তি বারে।

চট্টগ্রামের চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিন্যাস ও প্রয়োজন

সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা সেবা ও রোগ নিরূপণী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিন্যাস সুষম নয়। সরকারি মেডিকেল কলেজকে ঘিরে প্রায় সব বেসরকারি হাসপাতাল ও রোগ নিরূপণী কেন্দ্র। তবে স্বেচ্ছাসেবী হাসপাতালগুলো যেখানে স্থাপনার প্রয়োজনীয় জমি পেয়েছে সেখানেই গড়ে উঠেছে। সরকারি হাসপাতালগুলো ঠিক মত ছড়িয়ে দেয়া হয়নি। কারও ইচ্ছাপুরণের জন্য একই জায়গায় ঠেসে দেয়া হয়েছে। তার ফলে উদ্ভূত সমস্যাগুলোকে ভ্রুক্ষেপ করা হয়নি। যেমন ক্যানসার হাসপাতালকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মধ্যে অনেক স্থাপনা পাল্টে দিয়ে ঠাসা হয়েছে। এ বৃহত্তর অঞ্চলের একমাত্র টারসিয়ারী চিকিৎসা কেন্দ্র ও বিদ্যাপীঠের সব খালী নিঃশ্বাস ফেলার স্থানগুলো ঘিজি করে দেয়া হচ্ছে। কদিন পরে দেখা যাবে হাফ ছাড়ার খেলার মাঠটাও নেই। সুবিন্যস্ত না থাকায় জনগণকে নগরীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে আসতে হয়। ট্রাফিক জ্যামসহ অনেক সমস্যা সারাক্ষণ হতে থাকে। চট্টগ্রামে প্রয়োজনের তুলনায় বলতে গেলে সরকারি জেনারেল ও বিশেষায়িত হাসপাতাল সাকুল্যে একটাই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। লোক সংখ্যা ও প্রয়োজন মনে করে চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে আরো কয়েকটি জেনারেল ও বিশেষায়িত হাসপাতালের প্রয়োজন।

সরকারি হাসপাতাল পরিসীমায়

সরকারি বড় হাসপাতাল তথা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিসীমায় সকল বেসরকারি হাসপাতাল ও রোগ নিরূপণী কেন্দ্র। সরকারি হাসপাতালগুলো এসব কেন্দ্রে রোগী সরবরাহের ক্ষেত্র। সরকারি হাসপতালে প্রায়শ চিকিৎসার সরঞ্জাম ও উপকরণের অভাব থাকে এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তা আরো প্রকট হয়। এজন্য বেসরকারি হাসপাতাল ও নিরূপণী কেন্দ্রগুলো শুন্যস্থান পূরণ করে। প্রয়োজন অনুযায়ী সজ্জিত ও সুবিন্যস্ত হাসপাতাল ও কেন্দ্রগুলো মানুষের সেবায় অনন্য অবদান রাখতে পারবে।

কিছু ভ্রান্ত মাইন্ডসেট ও প্রতিকার

বিশেষায়িত চিকিৎসা বা কেন্দ্র আর মেডিকেল কলেজ সমার্থক নয়। মেডিকেল কলেজ হলো মেডিকেল শিক্ষা, প্রশিক্ষণ আর গবেষণার পাদপীঠ। তাই বিশেষায়িত চিকিৎসার নামে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ার মত নিম্ন মান সম্মত মেডিকেল কলেজ স্থাপন বন্ধ করতে হবে এবং এধরণের যেগুলো আছে সবগুলো বন্ধ করতে হবে। দেশের সব মেডিকেল কলেজগুলোকে আন্তর্জাতিক সমমানের এবং স্বশাসিত করতে হবে।

করণীয়

চারিদিকে বিদ্যমান ব্যাপক সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের পাহাড় ডিঙ্গানো সহজ না, আবার অসাধ্যও নয়। তবে তা হতে হবে যথাযথ পেশাগত বৈজ্ঞানিক উপায়ে আমলাতন্ত্র মুক্ত প্রেক্ষাপটে। সার্বিক তথ্য সংগ্রহ করে তত্ত্বে রুপান্তরিত করতে হবে। তা থেকে লক্ষ্য ও অভিষ্টতা নির্ধারণ করা। প্রতিটি ক্ষেত্রানুযায়ী লক্ষ্যমাত্র একক ও সামগ্রিকভাবে অবধারণ। বিভিন্ন পর্যায়ের দক্ষ ও সমর্পিত জনবল সংগঠন, সেবা প্রদান কেন্দ্রগুলোর নগর ও আশে পাশে পর্যায় ভিত্তিক সুষম বিন্যাস, নেটওয়ারকিং, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সমুহের মধ্যে আনুষ্ঠানিক অংশীদারিত্ব, রেফারেল ও চিকিৎসার গাইডলাইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ, গুড মেডিকেল প্রাকটিস গাইডলাইন সজ্জিত করে প্রবর্তন। সকল পর্যায়ের মেডিকেলে জনবলের জ্ঞান, দক্ষতা ও আচরণের আধুনিকায়নের জন্য নিয়মিত দেশে ও বিদেশে পেশাগত অনুশীলনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার সাথে সাথে যথাযথ জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণা একটি নিয়মিত কর্মযজ্ঞে পরিনত করতে হবে। এ কাজগুলো হবে জনগণের নির্বাচিত নির্বাহীদের নেতৃত্বে ও পেশাজীবীদের সার্বিক তত্তাবধানে। উপজেলা, জেলা ও অঞ্চলে স্বাস্থ্য ও জাতীয় চিকিৎসা কাউন্সিলের মাধ্যমে কৃত হবে যে ভাবে শাসনতন্ত্রে বর্ণিত আছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সবার কিছু কিছু মাইন্ডসেট পাল্টাতে হবে। একটা থীম হৃদয়ে সেঁধিয়ে দিতে হবে, ‘সুযোগ, সামর্থ ও আস্থার অভাবে কোনো জীবন প্রদীপ যেনো নিভে না যায়’।

কল্যাণকামী রূপান্তরিত মাইন্ডসেট দিয়ে সুযোগ, সামর্থ আর আস্থার যথাযথ সমন্বয় করতে পারলে চট্টগ্রামকে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসায় জনবান্ধব করা যাবেই।

লেখক : চিকিৎসাবিজ্ঞানী, ইন্টারনিস্ট ও নেফ্রোলজীস্ট এবং গবেষক; প্রাক্তন অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও খণ্ডকালীন শিক্ষক, চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধনদীমাতৃক বাংলাদেশ নৌপথে বাণিজ্য
পরবর্তী নিবন্ধভারতে পালানোর সময় ফজলে করিম চৌধুরী আটক