এই রচনার শিরোনামে ‘নিষ্করুণ’ কথাটি কেন লিখলাম তা চট্টগ্রাম বিদ্রোহের অন্যতম নেতা ও সৈনিক বিপ্লবী গণেশ ঘোষের কথা দিয়েই শুরু করি। তিনি বলেছেন পেছনের দরজা খুলে রেখে অর্থাৎ- সুযোগ রেখে, এগিয়ে গেলে চরম সংকটের সময় পরিপূর্ণভাবে দায়িত্ব পালন করা, অপেক্ষা, অপসারণের এবং প্রাণ রক্ষার আগ্রহই প্রবল হয়ে ওঠে। কাজেই বোঝা যায় চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের প্রত্যেকটি পরিকল্পনাই পরিচালিত হয়েছে মুখোমুখি সংঘর্ষ এবং চৎড়মৎধসসব ড়ভ উবধঃয কে সামনে রেখেই। চট্টগ্রামে ব্রিটিশ বিরোধী এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারীদের মৃত্যু করুণরসসিক্ত চিত্রাবলীতে অংকিত হয়নি; হয়েছে বীরোচিত জীবন উৎসর্গের মধ্য দিয়ে। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল থেকে শুরু করে জালালাবাদ যুদ্ধ এবং ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ সব ক্ষেত্রেই ছিল স্বদেশের স্বাধীনতার জন্যে আত্মবলিদানের স্পৃহা। এইখানেই চট্টগ্রাম অভ্যুত্থানের বা যুবকদের সশস্ত্র সংঘর্ষের সঙ্গে বুড়ি বালামের তীরে বাঘা যতীনের দলের সঙ্গে ইংরেজ পোষ্য সৈনিকদের মুখোমুখি যুদ্ধ (যা অযাচিত ঘটে যাওয়া ঘটনা); প্রতিশোধমূলক ব্যক্তিগত আক্রমণ সমূহের (জেলের অভ্যন্তরে বা বাইরে) অনেক পার্থক্য রয়েছে। যে ঘটনাগুলোর নেপথ্যে কোন সংঘবদ্ধ পরিকল্পনা বা কর্মসূচীর ধারাবাহিকতা ছিল না বলেই, মনে হয়েছে। ১৯৬১ খৃস্টাব্দে ‘দৈনিক হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড’ এ প্রকাশিত বিপ্লবী অনন্ত সিংহর বছরওয়ারী কিস্তি আকারে লেখা দঈযরঃঃধমড়হম ঐবৎড়বং ভরমযঃ ভড়ৎ ঋৎববফড়স রচনাটিতেও একটি নিশ্চিত ফলাফল ও কর্মসূচীর সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। এই কর্মসূচি সম্মুখ যুদ্ধে আত্মদান ছাড়া কিছুই নয়। এই আত্মনিবেদনের প্রেক্ষাপট ও ভূমিকাটি ছিল পর্ব ভিত্তিক ও ক্রমানুসারিক নিয়মে একটি পরিণতির দিকে ধাবিত।
অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সম্পর্কে যাঁরা আগ্রহী পাঠক তাঁরা অবশ্যই জ্ঞাত আছেন যে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ থেকে শুরু করে পিন্ডারী, নীল বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ সবই ইংরেজদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ছিল কিন্তু এইসব বিদ্রোহ ছিল আকস্মিক এবং অপরিকল্পিত।তাই এর ফলাফল ছিল করুণ, মর্মান্তিক। শত সাধারণ নিরস্ত্র,অনভিজ্ঞ প্রতিবাদী মানুষের অকাতরে জীবনদান। অভিভক্ত ভারতের এই ঔপনিবেশিক অত্যাচারের, শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ও প্রতিরোধের প্রেক্ষাপট ও ব্যর্থতাকে সামনে রেখেই এক স্মরণীয় সংগ্রামের, স্বাদেশিকতার অমোঘ লক্ষ্য নির্ধারণে চট্টগ্রামের বিপ্লবী যুবকেরা খুবই সতর্ক ও সচেষ্ট ছিলেন।
এই জন্যেই মাস্টারদা সূর্য সেনকে দেখতে পাই দলের সদস্যদেরকে দীর্ঘ সময় ধরে সাহস, ধৈর্য্য বুদ্ধি ও সহিষ্ণুতার মাত্রা পর্যবেক্ষণ ও অনুমোদন করে দলের সদস্যদের স্বদেশপ্রীতি ও আদর্শজীবন গঠনের দিকে উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং নানা দেশের বিপ্লব, বিদ্রোহ সম্পর্কে পুস্তকপাঠে উৎসাহ দান করেছেন প্রতিমুহূর্তে। মাতৃভূমি ও পরাধীন জাতিকে স্বাধীন করার ব্রত নিয়েই চট্টগ্রামের তরুণদের দীক্ষিত করে ছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেন। একটি প্রকৃষ্ট পরিকল্পনা ও সুসংগঠিতভাবে সম্মুখ যুদ্ধে নিশ্চিত মৃত্যুকে ফুলের মালার মতো গলায় পরে নিয়েছিলেন জালালাবাদ যুদ্ধের শহীদ বিপ্লবীরা। এই বীরোচিত সুসংগঠিত সম্মুখ যুদ্ধের এক গৌরবজনক অধ্যায় রচনা করেছে কেবলমাত্র বিপ্লবতীর্থ এই চট্টগ্রাম।
চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহে দীর্ঘ সময় ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে অনন্য এক সাংগঠনিক বিপ্লবী কার্যক্রম কিভাবে অনেক ছোটখাটো দুর্ঘটনার পরেও এবং ইংরেজদের সুদক্ষ গোয়েন্দা বাহিনীর নেটওয়ার্ক এড়িয়ে এক সফল সংগ্রামের পটভূমি রচনা করতে সমর্থ হয়েছিল তা হয়তো অনেকের কাছে অজ্ঞাত থেকে গেছে। চট্টগ্রামের বৈপ্লবিক কার্যক্রমে প্রধান একটি কাজ হয়ে উঠেছিল গোয়েন্দা ও গুপ্তচরের চলাফেরা নজরে রাখা এবং বিশেষ করে দলের ভেতরে সদস্যদের চরম কিছু পরীক্ষার পর বিশেষ কাজের জন্য অন্তর্ভুক্তি চলতো। কারণ অনুশীলন ও যুগান্তরের এবং অন্যান্য দলের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের ব্যর্থতার একটি প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছিল গোপন তথ্য প্রকাশ হয়ে যাওয়া। মাস্টার দা সূর্য সেন প্রথম থেকেই এই বিষয়ে একদম কঠোর নিয়মবিধি শেষ অবধি পালন করেছিলেন। দুর্ভাগ্য সেদিন গৈড়লা গ্রামে এক সাধারণ গ্রাম্য মহিলার সন্দেহপ্রবণ দৃষ্টির কাছে তিনি হেরে গিয়েছিলেন। অর্থের লোভে নেত্র সেন এই সংবাদ চালান করে দিয়েছিল নিকটস্থ পুলিশ চৌকিতে। যা হোক যা বলছিলাম, চট্টগ্রামের বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে কোন স্তরেই বিন্দুমাত্র আকস্মিকতা, হঠকারিতা এবং উদ্দেশ্যহীনভাবে ত্বরিত উত্তেজনায় কিছু করার কোন সুযোগ ছিল না। চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের সাংগঠনিক স্তরের গভীরে যে ভিত্ নির্মায়িত হয়েছিল তা ছিল সর্বাংশে দেশমাতৃকার পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের এক দৃঢ় অঙ্গীকারের কাহিনী। যেটি যুবকদের স্বতস্ফূর্ত মুক্ত জীবনের স্বপ্নকে আন্দোলিত করেছে। তরুণ চিত্তকে করেছিল মৃত্যুভাবনাহীন।
বিপ্লবী অনন্ত সিংহ বলেছেন ‘মাস্টার দা’র নেতৃত্বেই মূল বৈপ্লবিক বৈশিষ্ট্যের দরুণ ভারতীয় গণতন্ত্র বাহিনীর চট্টগ্রাম শাখা ভাবতে পেরেছিল ঝটিকাবেগে আক্রমণে প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী বৃটিশের অস্ত্রাগারগুলি ও শহরটি দখল করে অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার ঘোষণা করা যায়।
চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ ও সংগঠনের মূল নয়টি বৈশিষ্ট্যের কয়েকটি এখানে উল্লেখ করতে চাই।
স্বাধীনতা সংগ্রামের কর্মসূচীতে দুটি পথ তার মধ্যে স্থির করতে হবে- হয় চরকা নয়তো রিভলবার।
সশস্ত্র সংগ্রামের কর্মসূচী যখন সংক্ষিপ্ত না হয়ে পারে না তখন বিপ্লবী যুবকদের সংশয়ের মধ্যে রেখে সময় অতিবাহিত করার নীতি বর্জন করে ঞধৎমবঃ চবৎরড়ফ দুই বছর ঠিক করা হয়। কারণ বহু বছর ধরে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখবে অথচ প্রত্যক্ষ সংগ্রাম হতে বিচ্ছিন্ন থাকবে। তা সম্ভব নয়। বাস্তব কর্মসূচীর অভাবে সেইরূপ বৈপ্লবিক সংঘের অস্তিত্ব বিনষ্ট হয়ে যায়। বছরের পর বছর অযথা সময় অতিবাহিত করার অন্তর্নিহিত দুর্বলতার উপলব্ধি ছিল বলেই মাস্টার দা’র নেতৃত্বে যুব বিদ্রোহের প্রস্তুতি ও অভ্যুত্থানের কর্মসূচীর সময় নির্ধারিত হয় দুই বৎসর।
সশস্ত্র আক্রমণে অংশগ্রহণ করতে হলে যেরূপ বৈপ্লবিক মনোবলের অধিকারী হওয়া প্রয়োজন তার সম্যক উপলব্ধি থাকার দরুণ প্রত্যেকের সামনে ‘মৃত্যু কর্মসূচী’ (উবধঃয চৎড়মৎধসসব) রেখে বিশেষ ধরনের শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। টেবিলে বসে বই পড়েই সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী সৈন্যদল তৈরি করা সম্ভব নয়। তাই তরুণদের সঙ্গে পাহাড়ে, জঙ্গলে, মাঠে ময়দানে নানান বিপদসস্কুল কাজে অংশগ্রহণ করে শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা ছিল। উপরে উল্লেখিত এই তিনটি বৈশিষ্ট্য থেকে উপলব্ধি করা যায় যে বৃটিশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের পরিণতি যে অনিবার্য মৃত্যু এবং তার ভূমিকাও যে বীরোচিত এবং তা করুণ রসে সিক্ত নয় সেইটিও সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
মাস্টার দা সূর্য সেন অবিভক্ত ভারতের বৃটিশ বিরোধী প্রত্যেকটি উদ্যোগের ইতিহাসকে গভীর মনোযোগের সঙ্গে অনুধাবন ও পর্যবেক্ষণ করেছেন একেবারে কষ্টি পাথরে যাচাই করে। গান্ধীর অহিংস নীতিকে মাস্টার দা সূর্য সেন গ্রহণ করেছিলেন একটি কৌশল হিসেবে কিন্তু বৈপ্লবিক কোন আস্থা বা বিশ্বাসের (ঈৎববফ) জায়গা থেকে নয়। বরং তাঁকে অনুশীলন দলের প্রথম পর্বের নেতা রাসবিহারী বসু’র ছোটখাটো পরিকল্পনা ও ভূমিকা এবং ব্যর্থতা, গদর পার্টির নেতা মোহন সিং, সর্দার জোয়ালা সিং’র কর্মকাণ্ড চট্টগ্রামে সশস্ত্র সংগ্রামের বিষয়ে একই সংগঠনমুখী পরিকল্পনা গ্রহণে উৎসাহিত করে। বিপ্লবী অনন্ত সিংহের কথায় মাস্টার দা সূর্য সেনের অভিমতই বোধহয় ধ্বনিত হয়েছে। বিপ্লবী অনন্ত সিংহ বলেছেন ‘গণআন্দোলন যখন গণবিক্ষোভে পরিণত হয়, তখন গোপন বিপ্লবী ঝযড়পশ ঞৎড়ড়ঢ়ং (ঝটিকা বাহিনী) যদি প্রথম পর্যায়ের অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে সরকারি অস্ত্রাগার প্রভৃতি দখল করে ছঁরঃ ওহফরধ সংগ্রামের সময় জনগণের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে সশস্ত্র বিপ্লবের পথে স্বাধীনতার যুদ্ধকে পরিচালিত করতো, তবে ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস অন্যরূপ পরিগ্রহ করতো।
এই অন্যরূপের একটি ঐতিহাসিক, অবিস্মরণীয় ঘটনা ‘চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ’।
বৃটিশ বিরোধী সংগ্রাম ও সফল অভ্যূত্থান সম্পর্কে বিশ্ববিশ্রুত গণিত বিজ্ঞানী, প্রফেসর সত্যেন বোস মন্তব্য করেছেন যে ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের কাহিনী’ আজ ইতিহাসের স্মৃতিকথায় দাঁড়িয়েছে। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে বিদেশী শাসনের ভিত্তি ধরে নাড়া দেবার চেষ্টা করেছিল। এই শৌর্য কাহিনী বাঙালির প্রাণের রোমাঞ্চ জাগিয়েছিল সেদিন। বিদেশীদের মনেও আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল বিপুল। তাই চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ এক ব্যতিক্রমী জীবনোৎসর্গ, আত্মবলিদানের সুবর্ণময় ইতিহাস ও চিরজীবী অধ্যায় চির অনুপ্রেরণার উৎসস্থল।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক










