বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর সর্বশেষ ‘বস্তি-শুমারি’র তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম শহরে দুই হাজার ২১৫টি বস্তি আছে। এসব বস্তি এলাকায় আবাসনের অবস্থা খুব সুবিধাজনক নয়। বেশিরভাগই ঝুপড়ি ঘর। পাকা দালান নাই সেখান। কিছু কিছু ঘরে দেয়াল থাকলেও টিনশেডের ছাদ। ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও যাতায়াতসহ অন্যান্য সুবিধাগুলোও তেমন নাই। এসব বস্তিতে বাস করেন চার লাখ ৮৫ হাজার ৮৬১ জন। ২০১৪ সালে যখন বস্তি-শুমারির তথ্য প্রকাশ করা হয় তখন পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহরের জনসংখ্যা ছিল ২৫ লাখ ৯২ হাজার ৪৩৯ জন (২০১১ সালের আদম শুমারির তথ্য অনুযায়ী)। বস্তি-শুমারির তথ্য থেকে এটাই স্পষ্ট, শহরের এক পঞ্চমাংশের বেশি বাসিন্দার উপযুক্ত আবাসন সুবিধা নাই। বস্তির বাইরে হিসেব করলে এ পরিসংখ্যান আরো বাড়বে সন্দেহ নাই।
বিবিএস এর সর্বশেষ জনসংখ্যার তথ্য (২০২২) অনুয়ায়ী, বর্তমানে শহরের জনসংখ্যা ৩২ লাখ ২৭ হাজার ২৪৬ জন। তবে বিভিন্ন সংস্থা দাবি করে আসছে শহরের জনসংখ্যা ৭০ লাখের বেশি হবে। যা ১৯৯০ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন যাত্রার সময় ছিল ২০ লাখ। চট্টগ্রাম শহরের আয়তন ৬০ বর্গমাইল। অর্থাৎ গত ৩২ বছরে শহরের জনসংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি ভূমির সংখ্যা। এখন প্রশ্ন অপরিবর্তিত ভূমিতে পরিকল্পিতভাবে আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে? আবাসন নিয়ে কাজ করেন এমন সংস্থাগুলোর তথ্য বলছে, হয়নি। শুধু চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ইতিহাসে নয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ৬৩ বছরের ইতিহাসেও কাঙ্খিত আবাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি।
চটগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক), গণপূর্ত অধিদপ্তরসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্ব নগরবাসীর আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। কিন্তু এসব সংস্থার পক্ষে সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে এগিয়ে আসে বেসরকারি আবাসন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু শুরুতে ধনাঢ্য ব্যক্তি ছাড়া অন্যদের পক্ষে আবাসন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সুবিধা নেয়া সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে কিস্তি সিস্টেম চালু হলে কিছুটা সাহস করে মধ্যবিত্ত জনগেষ্ঠি। তবে তার সংখ্যা খুব কম।
৬৩ বছরে মাত্র ১২ আবাসিক এলাকা
নগরবাসীর জন্য পরিকল্পিত আবসন নিশ্চিত করার অন্যতম দায়িত্ব চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ)। অথচ প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রত্যাশা পূরণ থেকে পিছিয়ে আছে প্রতিষ্ঠানটি। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে গত ৩০ আগস্ট সর্বশেষ হালনাগাদ করা তথ্যে উল্লেখ করা হয়, ইতোমধ্যে সাত হাজার এর অধিক প্লট বিভিন্ন পেশা-শ্রেণির জনগণের মাঝে বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। যদিও প্রতিটি আবাসিক এলাকার পৃথক তথ্য অনুযায়ী বরাদ্দকৃত প্লটের সংখ্যা ছয় হাজার ৩৬৪।
সিডিএ প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৫৯ সালে। ইতোমধ্যে কেটে গেছে ৬৩ বছর। দীর্ঘ এ সময়ে প্রতিষ্ঠানটি শহরে মাত্র ১২টি আবাসিক এলাকা প্রতিষ্ঠা করেছে। অর্থাৎ গড়ে একটি আবাসিক এলাকা প্রতিষ্ঠা করতে পাঁচ বছরেরও বেশি সময় লেগেছে। সিডিএ’র গড়ে তোলা আবাসিক এলাকাগুলো হচ্ছে- আগ্রাবাদ আবাসিক এলাকা, চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা, চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা (২য় পর্ব), চন্দ্রিমা আবাসিক এলাকা, ফৌজদারহাট পুনর্বাসন এলাকা, হালিশহর পুনর্বাসন এলাকা, কাতালগঞ্জ আবাসিক এলাকা, ষোলশহর পুনর্বাসন এলাকা, সিলিমপুর আবাসিক এলাকা, কর্ণফুলী আবাসিক এলাকা, কল্পোলোক আবাসিক এলাকা এবং অনন্যা আবাসিক এলাকা।
সিডিএ প্রতিষ্ঠিত আবাসিক এলাকাগুলোর মধ্যে ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠা করা কাতালগঞ্জে ৫৮টি, ১৯৬৫ সালে করা আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকায় ৩৯১টি, ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠা করা চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় ৭৫৯টি, ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠা করা কর্নেল হাট আবাসিক এলাকায় ১৬৮টি, ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠা করা সলিমপুর আবাসিক এলাকায় ৯০৪টি, ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠা করা কর্ণফুলী আবাসিক প্রকল্পে ৫১৭টি, ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠা করা চন্দ্রিমা আবাসিক এলাকায় ১৮০টি, ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠা করা চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা (দ্বিতীয় পর্যায়) ৮২টি, ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠা করা কল্পলোক আবাসিক এলাকায় (প্রথম পর্যায়) ৪২৩টি, ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠা করা কল্পলোক আবাসিক এলাকা (দ্বিতীয় পর্যায়) এক হাজার ৩৫৬টি, ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠা করা অনন্যা আবাসিক এলাকায় এক হাজার ৪৭৮টি এবং ২০০৯ সালে ষোলশহর পুনর্বাসন এলাকায় ৪৮টি প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়।
চসিকের তিন প্রকল্পে ৭৩৮ প্লট
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) তিনটি হাউজিং প্রকল্প আছে। প্রকল্পগুলো হচ্ছে- উত্তর খুলশী কোবে সিটি হাউজিং প্রকল্প, লেকসিটি হাইজিং প্রকল্প (ফিরোজশাহ বিশ্বকলোনি সংলগ্ন) এবং মাদারবাড়ি পোর্ট সিটি হাউজিং প্রকল্প (শুভপুর বাসস্ট্যান্ড এর দক্ষিণ পাশে)। এছাড়া মাদারবাড়ি ও অক্সিজেনে ফ্ল্যাট নির্মাণ করে বরাদ্দ দিয়েছে। তবে তিনটি হাউজিং প্রকল্প নিয়ে জটিলতা আছে। এর মধ্যে লেকসিটি হাউজিং প্রকল্প গ্রহণ করা হয় ২০০৬ সালে। ওই সময় ৫৪৮ জন গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নেয় সিটি কর্পোরেশন। এর মধ্যে ৪৫০ জনকে প্লট বুঝিয়ে দেয়া হয়। বাকি ৯৮ জনকে এখনো প্লট বুঝে দেয়নি। প্রকল্প গ্রহণের সময় প্রথমে সবাইকে তিন কাঠা জমি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২০০৯ সালে তৎকালীন মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী জায়গার অপ্রতুলতার কারণে তিন কাঠার পরিবর্তে আড়াই কাঠা জমি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
এছাড়া উত্তর খুলশী কোবে সিটি হাউজিং প্রকল্পে প্লট আছে ৫০টি এবং পোর্ট সিটি হাউজিং প্রকল্পে প্লট আছে ১৪০টি। কোবে সিটিতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এবং পোর্ট সিটিতে রেলওয়ের সঙ্গে মামলা চলছে। ফলে এ দুই প্রকল্পও আটকে আছে।
প্লট পেয়েও ভবন নির্মাণে অনাগ্রহ
২৭ বছর বছর আগে সিডিএ’র গড়ে তোলা কর্ণফুলী আবাসিক এলাকায় কোনো ঘর-বাড়ি নির্মাণ করেনি প্লট গ্রহীতারা। প্রায় একই অবস্থা ১৪ বছর আগে প্লট বরাদ্দ দেয়া অনন্যা আবসিক এলাকায়। সেখানে একটি হাসপাতাল ছাড়া আর কোনো ঘর-বাড়ি নির্মাণ করা হয়নি। এছাড়া ৩৮ বছর আগে গড়ে তোলা সলিমপুর আবাসিক এলাকায় খালি পড়ে আছে অধিকাংশ প্লট।
এই তিন আবাসিক এলাকার বাইরে সিডিএ’র গড়ে তোলা অন্যান্য আবাসিক এলাকার বেশ কয়েকটিতে প্লট খালি পড়ে আছে। সব মিলিয়ে সিডিএ যেসব প্লট বরাদ্দ দিয়েছে তার অর্ধেকেরও বেশি খালি পড়ে আছে। সেখানে কোনো ঘর-বাড়ি নির্মাণ করা হয়নি। যারা প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন তারা কেবল মালিকানা পরিবর্তন করে ভূমির দামি বাড়িয়েছেন। লাভবান হয়েছেন আর্থিকভাবে।
অবশ্য সত্যিকার অর্থে একটি আবাসিক এলাকায় যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকা উচিত তা নিশ্চিত না হওয়ায় সেখানে বাড়ি ঘর করতে আগ্রহী হন নি প্লট গ্রহীতারা। প্লট বরাদ্দ পাওয়া একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে আলাপকালে তারা জানিয়েছেন, পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাগুলো না থাকায় সেখানে ঘর-বাড়ি নির্মাণে উৎসাহ পাচ্ছেন না প্লট গ্রহীতারা। অথচ আবাসিক এলাকাতেও নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধির কার্যকর প্রদক্ষেপ নেয়া উচিত ছিল সিডিএ’র। তাছাড়া প্লট বরাদ্দের পর নির্দিষ্ট সময়ের ঘর-বাড়ি নির্মাণ না করলে বরাদ্দ বাতিলসহ আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার মাধ্যমে ঘর-বাড়ি নির্মাণ নিশ্চিত করতে পারে সিডিএ। তার আগে অবশ্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
একইভাবে সিটি কর্পোরেশনর তিন প্রকল্পে যারা প্লট বুঝে পেয়েছেন তারাও সেখানে ভবন নির্র্মাণ করেনি। ফলে যে উদ্দেশে সিডিএ ও চসিক আবাসন প্রকল্প গ্রহণ করে তার পুরোপুরি সুফল আসেনি।
পরিচ্ছন্নকর্মীদের আবাসন ব্যবস্থা
চট্টগ্রাম মহানগরীতে সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব ভূমিতে আটটি স্থানে দুই হাজার ৪৬১ পরিবারে তিন হাজার ৪৬৩ জন সেবক বসবাস করেন। এদের মধ্যে এক হাজার ৩০৯ জন পরিচ্ছন্নকর্মী সিটি কর্পোরেশনের কাজে নিয়োজিত। কিছু সেবক নগরীর অন্যান্য অফিস ও ব্যক্তিগত ভবনে পরিচ্ছন্ন কাজে নিয়োজিত। ঔপনিবেশিক আমলে ভারত উপ-মহাদেশের অন্য প্রান্ত থেকে এরা এদেশে এসেছে। তারা প্রায় দুইশ বছর ধরে বসবাস করছে। কিন্তু তাদের কোনো নিজস্ব জমি এবং আবাসিক সুযোগ-সুবিধা নাই। অথচ এসব পরিচ্ছন্নকর্মীদের ন্যূনতম বাসস্থান, শিক্ষা, স্যানিটেশন ও সুপেয় পানি সরবরাহ করা সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব। বর্তমানে মাদারবাড়ি, ফিরিঙ্গিবাজার
বান্ডিল কলোনি এবং ঝাউতলায় পরিচ্ছন্নকর্মীদের জন্য চসিকের নির্মিত ভবন রয়েছে। তবে বেশিরভাগ ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
নগরের পরিচ্ছন্নকর্মীদের আবাসন নিশ্চিতের পাশাপাশি তাদের জীবনমান উন্নত করার লক্ষ্যে ‘পরিচ্ছন্নকর্মী নিবাস’ প্রকল্প আছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের। ২০১৮ সালে গৃহীত প্রকল্পটির আওতায় পরিচ্ছন্নকর্মীদের জন্য ১৪ তলা বিশিষ্ট ৭টি ভবন নির্মাণ করার কথা। ভবনগুলোতে থাকবে এক হাজার ৩০৯টি ফ্ল্যাট। এর মধ্যে ফিরিঙ্গিবাজার ওয়ার্ডের বান্ডেল কলোনিতে তিনটি, ফিরিঙ্গবাজারে একটি, দক্ষিণ আগ্রাবাদ ওয়ার্ডের ঝাউতলায় দুইটি এবং সাগরিকায় চসিকের নিজস্ব জায়গায় একটি ভবন নির্মাণ করার কথা। প্রকল্পের উন্নয়ন প্রস্তাবনা অনুযায়ী, ভবনগুলোতে বসবাসকারী পরিচ্ছন্নকর্মীদের প্রতিটি পরিবারের জন্য দুইটি বেডরুম, একটি রান্নাঘর এবং দুইটি বাথরুম থাকবে। প্রতিটি ভবনে দুইটি লিফট থাকবে। এছাড়া পরিচ্ছন্নকর্মীদের ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনা করা ও এবং তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য প্রতিটি ভবনের নীচতলায় স্কুল ও সাংস্কৃতিক কাজে ব্যবহারের সংস্থান রাখা হবে। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন হলেও এখনো কাজ শেষ হয়নি। মাত্র পাঁচটি ভবনের কাজ চলছে।
বস্তিবাসীর ফ্ল্যাটে নগর ভবন
১৯৯৩ সালে নগরের ১১টি বস্তির স্বল্পপরিমাণ সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করেছিল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। ২০০৪-২০০৬ খ্রিস্টাব্দে ঠান্ডছড়িতে দরিদ্রের আবাসন ব্যবস্থা করা হয়। ২০১২ সালে ভাসমান ভবঘুরে ও ছিন্নমূলদের রাত্রিযাপনে নগরের বিআরটিসি মার্কেটের পাশের একটি তিনতলা আবাসকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়।
সর্বশেষ টাইগারপাসে বস্তিবাসীদের জন্য সাততলা একটি ভবন নির্মাণ করে। যদিও বর্তমানে ভবনটি নগর ভবন হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। অথচ ফ্ল্যাট দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৩ সালে বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ করে চসিক। প্রতিটি ফ্ল্যাটের মূল্য ধরা হয় ৬ লাখ ১০ হাজার টাকা। এসময় ৩৩ পরিবার থেকে টোকেন মানি হিসেবে ১০ হাজর টাকা করে নেয় চসিক। বাকি টাকা ফ্ল্যাট বুঝে পাওয়ার পর কিস্তিতে পরিশোধ করার কথা ছিল। পরে উচ্ছেদ হওয়া জায়গায় সাততলা ভবন নির্মাণ করে চসিক। কিন্তু বস্তিবাসীদের ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেয়া হয়নি। উল্টো ২০১৯ সালের জুনে নগরের আন্দরকিল্লা থেকে নগর ভবন সেখানে স্থানান্তর করে। এখনো চসিকের কার্যক্রম চলমান আছে।
অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ
১৯৬০ সালে তৎকালীন গৃহসংস্থান অধিদপ্তর হালিশহরে একটি কলোনি এবং ফিরোজ শাহ ও শেরশাহ কলোনি গড়ে তোলে। সেখানে দুই হাজার ৬৭৯টি গুচ্ছবাড়ি নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে হালিশহরে ৫৩৭ একর জায়গায় এক হাজার ৯৭৮টি, ফিরোজ শাহে ১২৬টিএকর জায়গায় ৫০১টি এবং শেরশাহে ৩৩ একর জায়গায় নির্মাণ করা হয় ২০০ টি গুচ্ছবাড়ি। এসব বাড়িতে অবাঙালি মোহাজেরদেরকে পুনর্বাসিত করা হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা দেশ ত্যাগ করলে বাড়িগুলো পরিত্যক্ত হয়ে যায়। পরবর্তীতে সেগুলো দখল-বেদখলে জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে। এর মধ্যে দুই হাজার ৫৩৩টি বাড়ি ১৯৮৭ সালে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে সরকার। যা দখলদার, শহীদ পরিবারের উত্তরাধিকারী এবং সরকারি কর্মচারী ও সাধারণ নাগরিকদের কাছে সহজ কিস্তিতে বিক্রি করে দেয়।
জতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষও আবসন নিশ্চিতে কাজ করে চট্টগ্রামে। তবে খুব বেশি প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি সরকারি সংস্থাটি। ১৯৫৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত মাত্র সাড়ে সাত হাজার প্লট বরাদ্দ দেয় তারা।
বেসরকারি উদ্যোগ
বেসরকারি উদ্যোগে নাসিরাবাদ ও খুলশি এলাকায় ১৯৫২ থেকে ৫৪ সালে বেসরকারি ৯৩ একর জমিতে ৩২৬টি আবাসিক প্লট তৈরি করা হয়। তবে কেবল উচ্চ বিত্তরায় সেখানে ভবন নির্মাণের সুযোগ পায়।
এছাড়া প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত বেসরকারি হাউজিং সোসাইটি, সমবায়ের ভিত্তিতে বেসরকারি গৃহায়ণ, রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে গঠিত জমি বিক্রির কারবারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আবাসিক এলাকা গড়ার অনুমতি দেয়। যদিও সবগুলো আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেনি। দৈনিক আজাদীর ৩৫ বছরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম’ এর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ৩০০ হেক্টর জমির ওপর আলাদা আলাদা ভাবে মোট ২৫ টি আবাসিক এলাকা গড়ার অনুমতি দেয় সিডিএ। তবে এখন পর্যন্ত সবগুলো আবাসিক এলাকা শতভাগ নাগরিক সুবিধা নিয়ে গড়ে উঠেনি।
ফ্ল্যাট কালচার
১৯৯৫ সালের পর থেকে চট্টগ্রামে ফ্ল্যাট কালচার শুরু হয়। শুরুতে নাসিরাবাদ এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণ করে এ ফ্ল্যাট বাণিজ্য চলে। তবে কেবল বিত্তবানরায় এসব ফ্ল্যাট কেনার সুযোগ পায়। পরবর্তীতে গড়ে উঠা একাধিক বেবসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে জমে উঠে ফ্ল্যাট বাণিজ্য। কিস্তিতে মধ্যবিত্তরাও সুযোগ পায় ফ্ল্যাট কেনার। যা কিছুটা আবাসন নিশ্চিতে ভূমিতে রাখে। তবে কয়েক বছর ধরে এ খাতটি নানা সমস্যায় পড়ে। বিশেষ করে কোভিডকালীন সময়ে।
করোনার ধাক্কা সামলে উঠার পর সম্প্রতি আবারো সমস্যা দেখা দিয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়া, জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধিসহ দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য নানা কারণে নির্মাণ সামগ্রির মূল্য অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় আবাসন সেক্টরে দুর্দিন দেখা দেয়। রড-সিমেন্ট, পাথর, বালি, ক্যাবলসহ নির্মাণ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সামগ্রির দাম বেড়ে যাওয়ায় আবাসন সেক্টরের স্বাভাবিক প্রবাহ একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে। কোটি কোটি টাকা ক্ষতির শংকায় বহু কোম্পানি নির্মাণ কাজ বন্ধ করে রেখেছে। এতে অসংখ্য মানুষ ফ্ল্যাট কিনেও সময়মতো এ্যাপার্টমেন্ট বুঝে না পাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বাইরে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর সাধারণ মানুষের আবাসন নিশ্চিতে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেয়। অক্সিজেন ও মাদারবাড়িতে বরাদ্দ দিয়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন।
এছাড়া সিডিএ ইতোমধ্যে বেশ কিছু গরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। নাসিরাবাদে ১৬৫ ফ্ল্যাট নির্মাণ কাজ চলছে। ইতোমধ্যে ১১৬টি বরাদ্দও দেয়া হয়। দেওয়ানহাটে চলছে ১০ তলা ভবন নির্মাণ কাজ। এছাড়া বিশতলা বিশিষ্ট আবাসিক কাম বানিজ্যিক ভবন নির্মাণ (কাজির দেউড়ি কাঁচাবাজার এলাকা), গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য ডরমেটরী নির্মাণ এবং স্বল্প আয়ের জনসাধারণের জন্য ২৫, ২২, ২০ তলা বিশিষ্ট তিনটি (প্রায় ১৯৬ টি ফ্ল্যাট) আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে।
চাকরিজীবীদের আবাসন
সরকারি ও স্বায়ত্তশাষিত কিছু কিছু প্রতষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আবাসন সুবিধা পেয়ে আসছেন। তবে বেসরকারিভাবে এ সুবধা নাই। বাস্তবতা হচ্ছে বেসরকারি চাকুরিজীবীর সংখ্যাই বেশি। সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে কর্মকর্তারা প্রায় শতভাগ এবং কর্মচারীরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ আবাসন সুবিধা পাচ্ছেন। এ সংস্থাটির ছয় হাজারের অধিক ইউনিট বা ফ্ল্যাট আছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য। এছাড়া চসিকের ৯ হাজারে অধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে দুইশ’র মত এ সুবিধা পাচ্ছেন। এছাড়া ওয়াসা, গণপূর্ত অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথ, বন অধিদপ্তর, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, জেলা প্রশাসন, সিডিএ এবং সরকারি কলেজের শিক্ষকদের একটি অংশ এ সুবিধা পাচ্ছেন। এর বাইরে যারা আছেন তাদের বেশিরভাগই থাকেন ভাড়া-বাড়িতে। নিজস্ব আবাসন ব্যবস্থা নাই তাদের।
আশার আলো
জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় নগরের বস্তিবাসীদের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণের আলোচনা চলছে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে এ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা। এটি বাস্তবায়িত হলে বিনামূল্যে ৩৪০ প্রান্তিক পরিবার ফ্ল্যাট পবে।
‘বায়েজিদ বোস্তামী আবাসিক এলাকা’ নামে নতুন একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে সিডিএ। বায়েজিদ বোস্তামী লিংক রোড সংলগ্ন মোট ১৯ দশমিক ৬৫ একর জমিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পের তিন কাঠার ১২৬টি, চার কাঠার ৭টি এবং পাঁচ কাঠার ৩৪টি আবাসিক প্লট থাকবে। অবশ্য সিডিএ এর আগে সাগর পাড়ে স্মার্ট সিটি আবাসিক এলাকা, ডেভেলপমেন্ট অব ফতেহাবাদ নিউ টাউন ইন চট্টগ্রাম, রেসিডেনসিয়াল এরিয়া ফর নন-রেসিডেন্ট বাংলাদেশি অ্যাট কুলগাঁওসহ আরও একাধিক আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলেও বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী