চট্টগ্রাম মহানগরীর সার্বিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে। সাথে সরকারের অন্যান্য সংস্থা যেমন– চট্টগ্রাম ওয়াসা, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, কর্ণফুলি গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি–নাগরিকদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। মহানগরীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে আছে–মেট্রোপলিটন পুলিশ, ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে আছে –চট্টগ্রাম ট্রাফিক পুলিশ বিভাগ, আছে জেলা প্রশাসন ও জেলা পরিষদ। এছাড়া এমপি সাহেবদের চেষ্টা তদবিরের কারণেও কিছু উন্নয়ন কাজ হয়।
মহানগরীর নাগরিকদের সুখ–দূঃখ দেখভাল করা ও উন্নয়নের কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য ১৮৬৩ খ্রি. চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৭৭ খ্রি. নাম পরিবর্তন করে চট্টগ্রাম পৌরসভা করা হয়। ১৯৮২ খ্রি. ‘চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনে’ উন্নীত করা হয়। অন্যদিকে পরিকল্পিত নগরী প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে ১৯৫৯ সনে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ–সিডিএ গঠন করা হয়েছিল। স্ট্রাকচার প্ল্যান–১৯৯৫ অনুযায়ী চউক নিয়ন্ত্রিত এলাকা ১১৫২ বর্গ কি.মি.।
চট্টগ্রাম মহানগরী বিভিন্ন কারণে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী তথা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নগরী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ‘চট্টগ্রাম বন্দর’– এই নগরীকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। তাছাড়া শহরের চাক্তাই–খাতুনগঞ্জ দেশের অন্যতম বাণিজ্য স্থানে পরিণত হয়েছে। ‘চিটাগং ইপিজেড– কেইপিজেড’ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই শহর দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।
তবে বিগত তিন দশক যাবৎ নগরীর ‘জলাবদ্ধতার’ কারণে নগরবাসীর কষ্ট চরমে পৌঁছলে অবশেষে সরকারের পক্ষ থেকে জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য ২০১৭ সালের আগস্টে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন‘ প্রকল্পের অনুমোদন দেয় একনেক। এই প্রকল্পটি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড বাস্তবায়ন করছে। জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য ইতোপূর্বে বহদ্দারহাট–বলিরহাট (কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত) ‘একটি নতুন খাল খননের’ সিদ্ধান্ত হলেও তা অদ্যাবধি বাস্তবায়ন করা যায়নি (এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে আছে)।
সম্প্রতি নগরীর জলাবদ্ধতা নিয়ে ‘চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকায় মাস্টারপ্ল্যান (২০২০– ২০৪১) প্রণয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘পরিকল্পিত উন্নয়ন ছাড়া ২০ বছরে পরিত্যক্ত হবে চট্টগ্রাম নগর’। তিনি আরও বলেন, ‘এই নগর নষ্ট করার জন্য সবার দায় রয়েছে। পাহাড় কেটে আবাসন গড়ে তোলা হয়েছে। খাল–নালা ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। খেলার মাঠে ভবন ও বাজার বসেছে। এগুলো করা না হলে সুন্দর চট্টগ্রাম নগর নষ্ট হতো না’। তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামের নগরে একসময় ৭২টি খাল ছিল। এখন আছে ৫৭টি। তার মধ্যে জলাবদ্ধতা নিরসনে মেগা প্রকল্পের আওতায় ৩৬টিতে কাজ করছে সিডিএ। বাকি ২১টি ধ্বংসের পথে। আরএস (রিভিশনাল সার্ভে) জরিপ অনুযায়ী খালগুলো উদ্ধার করতে করতে হবে’। মেয়র মহোদয়ের এই বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। কারণ দীর্ঘ দিন যাবৎ চট্টগ্রাম শহরের মানুষ ‘অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প’ ও স্বার্থান্বেষী নেতাদের ‘স্বেচ্ছাচারিতার’ জন্য কষ্ট পাচ্ছে। বহদ্দারহাট কাঁচাবাজারের পাশের প্রশস্ত খাল ১৯৮৫ সনে আমি নিজেও দেখেছি। সত্তর দশকে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা চাক্তাই–খাতুনগঞ্জ হতে এই খাল দিয়ে নৌকায় পণ্যসামগ্রী আনতো। দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো, আজ এই খালের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। স্বয়ং সিটি কর্পোরেশন এই খালের উপর ‘নিজস্ব ভবন’ ও কাঁচাবাজার নির্মাণ করে খালটি ধ্বংস করেছে। ফলস্বরূপ সামান্য বৃষ্টি হলেই বহদ্দারহাট এলাকা আজ পানির নীচে তলিয়ে যায়। সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব ছিল খাল সংরক্ষণ করা। সেই কর্পোরেশনই যদি এমন অযৌক্তিক কাজ করে, তাহলে অন্যরা বসে থাকবে কেন! প্রবর্তক মোড়ে খালের উপর নির্মিত ভবন ইতোমধ্যে ভাঙা শুরু হয়েছে। নগরীর কিছু প্রভাবশালী মানুষও নালা–নর্দমা ও খালের উপর স্থাপনা নির্মাণ করে পানি নিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে জলাবদ্ধতাকে স্থায়ী রূপ দিয়েছে। নগরবাসীর কষ্ট লাঘবের জন্য এবং আইনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য এসব অবৈধ স্থাপনা যে কোন মূল্যে ভেঙে ফেলতে হবে।
আমরা যদি ‘সিটি কর্পোরেশন’ ও ‘সিডিএ’র দায়িত্বগুলো সামান্য বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখা যাবে যে, দু‘প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব ভিন্ন প্রকৃতির। মূলত ‘সিটি কর্পোরেশন’ নগরবাসীর সাথে সম্পৃক্ত ও দৈনন্দিন গুরুত্বপূর্ণ কাজ গুলো করে থাকে। যেমন–পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, জলাবদ্ধতা নিরসন, আবর্জনা সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা, লাইটিং সিস্টেম, রাস্তা মেরামত/কার্পেটিং/ব্রিক সলিন, খননের অনুমতি, ফুটপাত সংরক্ষণ, নালা–নর্দমা পরিষ্কার, নতুন হোল্ডিং নম্বর ও হোল্ডিং ট্যাঙ সার্ভিস, বাজার নিয়ন্ত্রণ, জনস্বার্থে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, ট্রেড লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন, জন্ম–মৃত্যু ও নাগরিকত্ব সনদ, কবরস্থান ব্যবস্থাপনা ও অন্যান্য নাগরিক সেবা।
অন্যদিকে ‘চউকের’ মূল দায়িত্বসমূহ ভিন্ন ধরনের। বলা যায়–তারা অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজই বেশি করে থাকে। যেমন–চট্টগ্রাম শহর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার জন্য একটি উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা তৈরী করা এবং চট্টগ্রাম শহরের সম্প্রসারণের জন্য স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন। এই পরিকল্পনার আওতায় রয়েছে নতুন রাস্তা নির্মাণ, শহরের প্রধান সড়ক সমূহ প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন, আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ, শিল্প– বাণিজ্যিক প্লটসহ শহর কেন্দ্রিক উন্নয়ন। ইমারত নির্মাণ অনুমোদন। বলা যায়– প্রাচীন এই নগরীর নগরায়রনের ক্রমবর্ধমান ধারার প্রতি দৃষ্টি রেখে নগরায়রনের ধারাকে পরিকল্পিত এবং টেকসই করার লক্ষে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) কাজ করে যাচ্ছে। উল্লেখ্য যে, সর্বপ্রথম ১৯৬১ সালে চট্টগ্রাম শহরের মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছিল।
সুতরাং একথা স্পষ্ট যে, যদিও আমরা উন্নয়নের জন্য সরকারের মন্ত্রী–এমপিদের দায়ী করে থাকি, কিন্তু উন্নয়নের ‘দায়’ রয়েছে এই দু‘প্রতিষ্ঠানেরই। জলাবদ্ধতার কথা বলি বা অন্যান্য সমস্যা সমাধানের কথা বলি না কেন, নগরবাসীর নিরাপদ বসবাস নিশ্চিত করাই এই দু‘প্রতিষ্ঠানের মূল দায়িত্ব। বিশেষ করে সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব বেশি। তাই সিটি কর্পোরেশনকে অধিক সহায়তা করা সরকারের উচিত। আমরা যখন দেখি পর্যাপ্ত ফান্ডের অভাবে কর্পোরেশনের অবসরে যাওয়া চাকরিজীবীরা সময়মত ‘সার্ভিস বেনিফিট’ পান না। তখন অবাক লাগে। একজন মানুষ ৩৫ বছর চাকরি করে পেনশন বা গ্র্যাচুয়েটি পাবে না –এটা কেমন কথা! সিটি মেয়রগণ যুগ যুগ ধরে এই সমস্যা লালন করে আসছেন, যা সমাধান হওয়া উচিত। আমরা দেখি যে, সিটি কর্পোরেশন অনেক স্কুল কলেজ পরিচালনা করে। ‘যদি’ এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তুকি দিতে হয়, তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলো ছেড়ে দেয়া উচিত। কারণ শিক্ষার উন্নয়নের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়– অধিদপ্তর আছে। আছে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা উদ্যোক্তা। কিন্তু নাগরিক সেবা তথা জলাবদ্ধতা নিরসন, আবর্জনা অপসারণ, সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। সুতরাং কর্পোরেশনের উচিত– আগে নাগরিক সেবার মূল দায়িত্ব নিখুঁতভাবে পালন করা। এরপর সম্ভব হলে অন্যান্য দায়িত্ব কাঁধে নেয়া। আমাদের মনে আছে, নাগরিক সেবা নিশ্চিতের জন্য প্রয়াত মেয়র হানিফ ‘সিটি গভর্মেন্ট’র এর কথা বলেছিলেন। আমরাও মনে করি নগরে দায়িত্ব পালনরত সব প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে সিটি কর্পোরেশনের নেতৃত্বে ‘সিটি গভর্নমেন্ট’ প্রতিষ্ঠা সময়ের দাবি। যা বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।
নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় বর্তমান মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী ১৮ জানুয়ারি বলেছিলেন, ‘নির্বাচিত হলে..প্রিয় চট্টগ্রামকে শান্তি, সৌহার্দ্যের চট্টগ্রাম হিসেবে, স্বাস্থ্যকর নান্দনিক ও আধুনিক চট্টগ্রাম হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হব’। আমরা আশাবাদী যে, তিনি তাঁর অঙ্গীকার বাস্তবায়নে চেষ্টা করে যাবেন। আর সিডিএ‘র উচিত হবে– নগরবাসীর কষ্টের কথা মাথায় রেখে নিবিড় তদারকির মাধ্যমে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পটি সুন্দর ভাবে বাস্তবায়ন করা। তাহলে নগরবাসীর হতাশা দূরীভূত হবে এবং সবার মনে স্বস্তি ফিরে আসবে।
লেখক : কলামিস্ট, গল্পকার ও সমাজকর্মী।