চট্টগ্রাম বন্দরে আইসিডিগামী কন্টেনারের ধারণক্ষমতা ৮৭৬ টিইইউএস। কিন্তু গতকাল চট্টগ্রাম বন্দরে আটকা পড়ে থাকা কন্টেনারের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ১২১ টিইইউএস। ধারণক্ষমতার তিনগুণের কাছাকাছি কন্টেনার নিয়ে দিশেহারা বন্দর কর্তৃপক্ষ। আইসিডিমুখী কন্টেনার জটে চরম বেকায়দায় পড়েছেন ঢাকা অঞ্চলের ব্যবসায়ী–শিল্পপতিরা। কাঁচামাল সংকটে বিভিন্ন কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার ঘটনাও ঘটতে শুরু করেছে। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চলে আসা অচলাবস্থার মাঝে গতকাল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ঢাকা আইসিডির কন্টেনারগুলো শর্তসাপেক্ষে ঢাকা আইসিডির পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দর থেকেও খালাস করার অনুমোদন দিয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানায়, বন্দরের সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা হয় ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে আইসিডি। কাস্টমস বন্ডেড এই আইসিডি থেকে ঢাকা অঞ্চলের আমদানি–রপ্তানিকারকেরা পণ্য আনা নেয়া করেন। ঢাকা আইসিডির নামে আমদানিকৃত পণ্যসমূহ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্যবাহী রেলওয়ে ওয়াগনের মাধ্যমে পাঠানো হয়। একইভাবে ঢাকার রপ্তানিকারকদের পণ্য ঢাকা আইসিডিতে গ্রহণ করে তা ট্রেনযোগে চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে আসা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে ঢাকার কমলাপুর আইসিডিতে প্রতিদিন দুই থেকে তিনটি রেলওয়ে ওয়াগন চলাচল করে। এগুলোর মাধ্যমে ৮০ থেকে সর্বোচ্চ ১২০ টিইইউএস কন্টেনার পরিবহন করা হয়। কোটা আন্দোলন ইস্যু এবং পরবর্তী গণঅভ্যুত্থানে বিরাজমান পরিস্থিতিতে গত ১৯ জুলাই থেকে ট্রেন যোগে কন্টেনার পরিবহন পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়। দেশব্যাপী রেল চলাচল বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণার সাথে সাথে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে বিদেশ থেকে আসা বিভিন্ন কারখানার কাঁচামালসহ নানা পণ্য বোঝাই কন্টেনারগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে আটকা পড়তে থাকে। একইভাবে ঢাকার পণ্যও আটকা পড়তে থাকে কমলাপুরে।
চট্টগ্রাম বন্দরে আইসিডিগামী কন্টেনারের ধারণক্ষমতা ৮৭৬ টিইইউএস। কিন্তু গতকাল চট্টগ্রাম বন্দরে আটকা পড়ে থাকা কন্টেনারের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ১২১ টিইইউএস। ধারণক্ষমতার বেশি কন্টেনার নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ চরম বেকায়দায় পড়েছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ ইতোপূর্বে রেলওয়ে বরাবরে চিঠি দিয়ে কন্টেনার পরিবহন শুরু করার অনুরোধ জানায়। অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের পর গত ১২ আগস্ট থেকে শুরু হলেও বন্দরে কন্টেনার জট খুব একটা প্রভাব ফেলেনি। জট পরিস্থিতি ক্রমে জটিল হতে শুরু করে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে দাঁড়ায় যে বন্দরে কন্টেনার রাখার জায়গার সংকটের চেয়ে ঢাকা অঞ্চলের কারখানাগুলোর কাঁচামাল সংকট প্রকট হয়ে উঠে। বহু ব্যবসায়ী শিল্পপতি কন্টেনার খালাস করতে না পেরে দিশেহারা হয়ে পড়েন।
উল্লেখ্য, কোনো চালান আমদানির সময়ই কোন বন্দর থেকে (চট্টগ্রাম বন্দর, পানগাঁও কন্টেনার টার্মিনাল নাকি কমলাপুর আইসিডি) খালাস করা হবে তার ঘোষণা দিতে হয়। ওই ঘোষণার বাইরে গিয়ে পণ্য শুল্কায়ন বা ডেলিভারি নেয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। কমলাপুর আইসিডির নামে আমদানিকৃত চালান চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস করার কোনো সুযোগ থাকে না। এই কন্টেনার সংশ্লিষ্ট স্টেশনে শুল্কায়ন করেই খালাস করতে হয়। প্রচলিত এই আইন বা নিয়মের কারণেই কমলাপুর আইসিডির নামে আমদানিকৃত পণ্য বা শিল্প কাঁচামাল চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস করতে পারছিলেন না সংশ্লিষ্ট আমদানিকারকরা।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে জরুরি পত্র দিয়ে ঢাকার কমলাপুর আইসিডির কন্টেনারগুলো চট্টগ্রাম বন্দর কিংবা পানগাঁও থেকে খালাসের অনুমোদন দেয়ার জন্য অনুরোধ জানায়। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অনুরোধের প্রেক্ষিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দ্বিতীয় সচিব (কাস্টমস নীতি) মুকিতুল হাসান স্বাক্ষরিত পত্রে গতকাল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে ঢাকা আইসিডিমুখী ১৮৫৬ টিইইউএস কন্টেনার ঢাকা আইসিডির পাশাপাশি ঘোষণা সংশোধন করে চট্টগ্রাম কাস্টমসে শুল্কায়ন করে চট্টগ্রাম বন্দর থেকেও খালাস করার জন্য অনুমোদন প্রদান করা হয়। তিন মাসের জন্য এই বিশেষ সুবিধা প্রদানের কথাও পত্রে বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, চট্টগ্রাম বন্দরের আইসিডি ইয়ার্ডে ঢাকা আইসিডিগামী কন্টেনার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় কন্টেনারসমূহ যানবাহন বা কার্গো ঘোষণা সংশোধনের মাধ্যমে তালিকাভুক্ত মোট ১৮৫৬ টি কন্টেনারে আনীত পণ্য চালানসমূহ কাস্টমস হাউস, চট্টগ্রাম, কাস্টমস হাউস, আইসিডি, কমলাপুরের মাধ্যমে শর্তসাপেক্ষে শুল্কায়ন ও খালাস কার্যক্রম সম্পন্ন করা যাবে। এতে শর্ত দেয়া হয়, আমদানিকারকের অভিপ্রায় অনুসারে কাস্টমস হাউস, চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস, আইসিডি, কমলাপুরের যে কোনো বন্দর হতে পণ্য চালান খালাস করা যাবে; চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস হতে খালাসের ক্ষেত্রে আমদানিকারকগণ অথবা তাদের পক্ষে সংশ্লিষ্ট সিএন্ডএফ এজেন্টকে খালাসতব্য কন্টেনারের তালিকা এবং খালাসের স্থান উল্লেখপূর্বক চট্টগ্রাম কাস্টমসে আবেদন করতে হবে। কাস্টমস আইন, ২০২৩ (২০২৩ সনের ৫৭ নং আইন) এর ধারা ৪৮ অনুযায়ী এক্ষেত্রে যানবাহন এবং কার্গো ঘোষণা সংশোধন করতে হবে।
শুধুমাত্র তালিকায় উল্লেখ করা ১৮৫৬ টিইইউএস কন্টেনারের ক্ষেত্রে আগামী তিন মাসের জন্য এই অনুমোদন কার্যকর থাকবে বলেও পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অনুমোদন পাওয়ার পর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট আমদানিকারকদের চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, ঢাকা কমলাপুর আইসিডির নামে আমদানিকৃত পণ্যবোঝাই কন্টেনার চট্টগ্রাম বন্দর থেকেও খালাস করার অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। এতে করে ঢাকা অঞ্চলের যেসব আমদানিকারকের কন্টেনার চট্টগ্রাম বন্দরে আটকা পড়েছিল সেগুলো খালাসের সুযোগ তৈরি হয়েছে। তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এই অনুমোদন বন্দরে কন্টেনার জট কমাতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেও মন্তব্য করেছেন।
উল্লেখ্য, গতকাল চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ডে থাকা কন্টেনারের সংখ্যা ৩৯ হাজার ৩৮ টিইইউএস। বন্দরের ইয়ার্ডে স্বাভাবিক সময়ে সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৩১ হাজার টিইইউএস কন্টেনার থাকে। বন্দরের বহির্নোঙরে গতকালও ১৬টি কন্টেনার জাহাজ অলস ভাসছিল।