চট্টগ্রাম বন্দরে ট্যারিফ বাড়ানোর উদ্যোগ

অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয় । শিপিং সেক্টরের ৫৬টি সেবার বিপরীতে গড়ে ৬০ শতাংশ মূল্য বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে । বন্দর ব্যবহারকারীদের উদ্বেগ

হাসান আকবর | বৃহস্পতিবার , ১৯ জুন, ২০২৫ at ৬:০৮ পূর্বাহ্ণ

শিপিং সেক্টরের বিভিন্ন সেবার বিপরীতে ট্যারিফ বাড়াচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। বিদেশি একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাপক পর্যালোচনা করে সেবার মূল্য নির্ধারণ করে রিপোর্ট প্রদান করার পর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নয়া ট্যারিফ অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। প্রস্তাবে ৫৬টি সেবার বিপরীতে গড়ে ৬০ শতাংশ মূল্য বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। ট্যারিফ বাড়ানোর এই উদ্যোগে বন্দর ব্যবহারকারীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

তারা বলেছেন, ট্যারিফ বৃদ্ধি পেলে ভোক্তা পর্যায়ের ভোগান্তি বাড়বে। অবশ্য বন্দর কর্তৃপক্ষ বলেছে, চল্লিশ বছর আগেকার তুলনায় বিভিন্ন খাতে খরচ অনেক বেড়েছে, বেড়েছে পরিচালন ব্যয়ও। তাই নতুন ট্যারিফ নির্ধারিত না হলে বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখা দিনে দিনে কঠিন হয়ে উঠছে। গতকাল বিষয়টি নিয়ে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। চলিত মাসের শেষ সপ্তাহে চট্টগ্রামে বন্দর ব্যবহারকারীদের সাথে আরো একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। আগামী জুলাই মাসের মধ্যেই নয়া ট্যারিফ কাঠামো কার্যকর করার লক্ষ্য নিয়েই সরকার অগ্রসর হচ্ছে বলেও সূত্র জানিয়েছে।

সূত্র জানায়, বিদেশ থেকে আমদানি পণ্য নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের জলসীমায় একটি জাহাজ পৌঁছার পর থেকে রপ্তানি পণ্য নিয়ে ফিরে যাওয়া পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ৫৬ ধরনের সেবা দিয়ে থাকে। বহির্নোঙর থেকে জাহাজকে জেটিতে আনার জন্য পাইলট পাঠানো, টাগবোট সার্ভিস, পানি সরবরাহ, ক্রেন চার্জ, জাহাজ ভিড়ানো, কন্টেনার জাহাজ থেকে নামানো কিংবা জাহাজে উঠানো, পণ্য ডেলিভারি উঠানো নামানোসহ পণ্য ডেলিভারি পর্যন্ত বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে। প্রতিটি কাজের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট হারে মাশুল আদায় করে। এটাকেই বন্দরের ট্যারিফ বা সেবার মূল্য বলা হয়।

বতর্মানে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ যে ট্যারিফ আদায় করছে তা ১৯৮৬ সালে নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ২০০৮ অর্থবছরে ৫টি খাতে ট্যারিফ বাড়ানো হলেও বাকি খাতগুলোর মূল্য আদায় করা হয় ১৯৮৬ সালের হিসেবে। বন্দর কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময় ট্যারিফ বাড়ানোর আলোচনা বা চিন্তাভাবনা করলেও তা সম্ভব হয়নি। ২০১৩ সালে সেবার মূল্যের পুরো খাতকে পুনঃনির্ধারণের উদ্যোগ নেয়া হলেও মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন জুটেনি। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে বন্দর কর্তৃপক্ষ আবারো প্রস্তাব দাখিল করলে সরকার ট্যারিফ বাড়ানোর অনুমোদন দেয় এবং আন্তর্জাতিক একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিয়ে ট্যারিফ কাঠামো তৈরির নির্দেশনা প্রদান করে। সরকারের নির্দেশনায় বন্দর কর্তৃপক্ষ স্পেনভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আইডিএম কনসাল্টিং ও লোকিকফোরাম’কে ট্যারিফ কাঠামো নির্ধারণের পরামর্শক নিয়োগ করে। ওই প্রতিষ্ঠান নানা বিষয়ে পর্যালোচনা এবং বিভিন্ন দেশের বন্দরের সেবার মূল্য পর্যালোচনা করে একটি প্রস্তাব দাখিল করে। ২০২০ সালে জমা দেয়া ওই প্রস্তাবনার প্রেক্ষিতেই পাঁচ বছর পর নতুন ট্যারিফ কাঠামো নিয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে।

বন্দর সূত্র জানিয়েছে যে, নয়া ট্যারিফ কাঠামোর প্রস্তবনায় ১৮টি খাতে ট্যারিফ বাড়ছে ৬০ শতাংশের বেশি, ১৭টি খাতে ট্যারিফ বাড়ছে ২০ থেকে ৫৯ শতাংশ, ১৯টি খাতে বাড়ছে ২০ শতাংশ। দুটি খাতে ট্যারিফ কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

নয়া প্রস্তাবনায় প্রতিটি ২০ ফুট কন্টেনার হ্যান্ডলিং চার্জ ১৫ ডলার থেকে বাড়িয়ে ২৩.১৫ ডলার, ৪০ ফুট কন্টেনার ২২.৫০ ডলার থেকে ৩৪.৮৩ ডলার, জাহাজ পাইলটিং চার্জ ৩৫৭ ডলার থেকে ৭০০ ডলারের প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য সেবারও মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়।

নয়া ট্যারিফ কাঠামো নিয়ে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে বন্দর কর্তৃপক্ষের একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকালও একটি বৈঠক হয়। ওসব বৈঠকে নয়া ট্যারিফ কাঠামো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। বৈঠকে সকল অংশীজনের সাথে আলোচনা করে যুগোপযুগী এবং বাস্তবসম্মত একটি ট্যারিফ কাঠামো গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ইতোমধ্যে বন্দর ব্যবহারকারীদের বিভিন্ন সংগঠনের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলাপ আলোচনা এবং মতামত চাওয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ট্যারিফ বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই। ৪০ বছর আগে কার কাঠামো দিয়ে ট্যারিফ আদায় করা আর সম্ভব হচ্ছে না। বন্দরের পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন ট্যারিফ নির্ধারণ করতে হচ্ছে বলেও তারা উল্লেখ করেন। তারা বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের মতো কম মূল্যে বিশ্বের আর কোথাও শিপিং সেক্টরের সেবা পাওয়া যায় না। তারা বলেন, আমাদের ধারে কাছের ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার ট্যারিফ কাঠামো চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে বেশি।

চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে সিঙ্গাপুর, কলম্বো এবং পোর্ট কেলাংয়ে নিয়মিত জাহাজ চলাচল রয়েছে। এসব জাহাজ ওই বন্দরগুলোতে বাড়তি ট্যারিফ দিচ্ছে, অথচ চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে অজুহাতের আশ্রয় নিচ্ছে। যা অনুচিত বলে তারা মন্তব্য করেন।

নতুন ট্যারিফ কাঠামো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বন্দর ব্যবহারকারীরা বলেছেন, যে হারে ট্যারিফ নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে তা অযৌক্তিক। এভাবে সেবার বিপরীতে মূল্য আদায় করা হলে জাহাজ ও কন্টেনার ভাড়া অনেক বেড়ে যাবে। যা মূলতঃ দেশের সাধারণ ভোক্তাদের উপরই পড়বে।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান সৈয়দ ইকবাল আলী (শিমুল) দৈনিক আজাদীকে বলেন, ট্যারিফ কিছু বাড়াতে হবে। এই বাস্তবতা আমাদের মেনে নিতে হবে। তবে ওই বাড়ানোটা যেনো সহনীয় হয়। ট্যারিফ বাড়ালে তা ভোক্তাদের উপরই পড়বে। বন্দরের ট্যারিফ বাড়লে শিপিং কোম্পানিগুলোও তাদের বিভিন্ন খাতের ভাড়া বাড়াবে। যার যোগান দিতে হবে ভোক্তাদের। কিন্তু কোনোভাবেই তা যেনো অসহনীয় হয়ে না যায় সেদিকে সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের সিনিয়র সহসভাপতি এ.এম মাহবুব চৌধুরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, বন্দর চল্লিশ বছরে ট্যারিফ বাড়ায়নি বলে যে কথাটি বলছে সেটি সঠিক নয়। মূলতঃ প্রতি বছরই ট্যারিফ বেড়েছে। কারণ বন্দরের বিভিন্ন সেবার মূল্য পরিশোধ করা হয় মার্কিন ডলারে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের সাথে সাথে বন্দরের ট্যারিফ বেড়ে যায় বলে মন্তব্য করে মাহবুব চৌধুরী বলেন, ২০০৮ সালে যখন ডলারের দাম ছিল ৭৬ টাকা। তখন আমরা ৭৬ টাকা হারে সেবার মূল্য দিতাম। প্রতি বছরই ডলারের দাম বাড়তে বাড়তে এখন সেটা ১২১টাকা। আমরা এখন ১২১ টাকা কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে আরো বাড়তি রেটেই বন্দরের পাওনা পরিশোধ করছি। ফলে আমাদেরকে প্রতি বছরই প্রতিটি সেবার বিপরীতে বাড়তি টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে, হচ্ছে। যতবার ডলারের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ততবার বন্দরের রেট বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায় সরকার ক্ষমতায় আসলেই ট্যারিফ বাড়ানোর তোড়জোড় শুরু করে। ২০০৮ সালে ৩ ডলার থেকে ১২ ডলার করা হয়। প্রায় ৩শ’ গুণ ট্যারিফ বাড়ানো হয়। এবারও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষেত্রবিশেষে একশ’ গুণ ট্যারিফ বাড়ানোর তোড়জোড় শুরু করেছে।

ট্যারিফ বাড়ানো অযৌক্তিক এবং বন্দর ব্যবহারকারীরা এর ঘোরতর বিরোধী বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বন্দর প্রতিবছর সব খরচ বাদ দিয়েও দুই হাজার কোটি টাকার বেশি নিট মুনাফা করছে। এতো টাকা আয়ের পরও ট্যারিফ বাড়িয়ে জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলার কি দরকার বলেও তিনি প্রশ্ন তোলেন। নতুন ট্যারিফ কাঠামো কার্যকর হলে ভোক্তাদের ভোগান্তি বাড়বে, বেড়ে যাবে মূল্যস্ফীতি। দ্রব্যমূল্যেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

অবশ্য মন্ত্রণালয় এবং চট্টগ্রাম বন্দরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দৃঢ়ভাবে বলেছেন যে, অংশীজনদের সাথে আলাপ আলোচনা করেই ট্যারিফ কাঠামো চূড়ান্ত করা হবে। এক্ষেত্রে বাস্তবতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হবে বলেও তারা উল্লেখ করেন। চলতি মাসেই চট্টগ্রামে বড় পরিসরে অংশীজনদের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হবে বলেও তারা জানিয়েছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমেমন মাতৃসদন-২ হাসপাতালে করোনা টিকাদান শুরু
পরবর্তী নিবন্ধবর-কনে দু’জনই বাক প্রতিবন্ধী