চট্টগ্রামের বইমেলায় চট্টগ্রামের প্রকাশক ও লেখকদের স্বার্থকে কীভাবে অগ্রাধিকার দেয়া যায় তা নিয়ে ভাবতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক। তিনি বলেন, জাতীয় পর্যায়ের লেখকদের বই চট্টগ্রামের প্রকাশনা সংস্থা থেকে বের হলে এ অঞ্চলের প্রকাশনাকে সমৃদ্ধ করা হয়। এখান থেকে ভালো মানের বই প্রকাশ করার ঐতিহ্য আছে, এখন প্রয়োজন সেটা পুনরুদ্ধার করা।
তিনি গতকাল সোমবার অমর একুশে বইমেলার আলোচনা মঞ্চে ‘প্রকাশনা শিল্পের বিকাশে লেখক–প্রকাশক ও পাঠকের দায়বদ্ধতা’ শীর্ষক আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। এতে আলোচক ছিলেন কবি জিন্নাহ চৌধুরী ও সমাজচিন্তক জাহিদুল ইসলাম। চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদের সভাপতি মো. সাহাব উদ্দীন হাসান বাবুর সভাপতিত্বে বক্তব্য দেন, সাধারণ সম্পাদক আলী প্রয়াস ও সহ–সভাপতি মিজানুর রহমান শামীম।
একুশে পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব এম এ মালেক বলেন, ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আমার বাবা ১৯৩২ সালে কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস ও কোহিনূর লাইব্রেরি স্থাপন করেছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, চট্টগ্রামবাসী এবং বাংলা ভাষার লোকজন যদি লেখাপড়ায় এগিয়ে না যায় তাহলে আমাদের পিছিয়ে পড়তে হবে। তাই তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে লাইব্রেরি এবং প্রেসে মনোনিবেশ করেন।
এম এ মালেক বলেন, বিগত সরকারের সময়ে ভারত থেকে বই ছাপিয়ে আনতে হয়েছে। আমাদের বাংলাদেশের মুদ্রণশিল্প অনেক অ্যাডভান্স। তারপরও আমরা বিদেশ থেকে বই ছাপিয়ে এনেছি। এতে দেশের মুদ্রা অন্য দেশে চলে যাচ্ছে। আমি দৃঢ় কণ্ঠে বলতে পারি, বাংলাদেশে ছাপার যে ব্যবস্থা আছে সেটা পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় অনেক বেশি উন্নত। ওরা যে মেশিন ব্যবহার করে তা ভারতে প্রোডিউস হয়। তাই বলে তাদের খারাপ বলছি না। কিন্তু এখানকার ৯০ শতাংশ মেশিনারিজ জার্মানি থেকে আনা হয়েছে, যেগুলো অনেক বেশি উন্নত। মুদ্রণশিল্পের গুরুত্ব তুলে ধরে এম এ মালেক বলেন, রবীন্দ্রনাথ, বার্নার্ড শ তো এখন নেই। বড় বড় লেখকরাও চলে গেছেন। কিন্তু আমরা তাদের লেখা বই পড়তে পারছি। কারণ এগুলো প্রিন্টেড। ছাপার অক্ষরে রেখে গছে বলেই এগুলো পড়া সম্ভব হচ্ছে। অর্থাৎ ছাপাখানার বদৌলতে পড়তে পড়ছি। লেখক–প্রকাশকদের কারণে শত বছরের পুরনো বইও আজ আমরা পড়তে পারি।
ছাপাখানার সামাজিক দায়বদ্ধতা প্রসঙ্গে এম এ মালেক বলেন, আমার বাবা ১৯৫২ সালে মাহবুব উল আলম চৌধুরীর রচিত ভাষা আন্দোলনের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ ছাপিয়ে দিয়েছিলেন। আমার বাবা কিন্তু জানতেন এ কবিতা ওই সময়ে ছাপানো মানে তৎকালীন পাকিস্তানি সরকারের চোখে দেশদ্রোহিতা। জেল–জুলুমের বিষয়টি মাথায় রেখেইে বাবা কবিতাটি ছাপিয়ে দিয়েছিলেন। পরদিন সেটা লালদীঘি মাঠে পঠিত হয়েছিল। সেই কবিতার প্রিন্টার্স লাইনে কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস লেখা ছিল। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, সরকারের কোনো প্রমাণের দরকার হয়নি। যখন রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে মামলা হল তখন আমাদের ম্যানেজার দবিরকে জেলে নিয়ে গেল পুলিশ। ছয় মাস জেল খাটার পর যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এলে উনাকে জেল থেকে ছেড়ে দেয়া হয়।
বইয়ের গুরুত্ব তুলে ধরে এম এ মালেক বলেন, মানুষের শরীরের জন্য যেমন খাদ্যের দরকার, তেমনি মনের খাদ্যও তার প্রয়োজন। এই প্রয়োজন মেটাতে পারে একটি ভালো বই। তবে কালপরিক্রমায় ঘটা করে বই পড়ার অভ্যাস এখন বিলুপ্তির পথে। নতুন প্রজন্ম আগ্রহ হারাচ্ছে বইয়ের প্রতি। এমন যদি চলতেই থাকে তাহলে হয়তো আগামী প্রজন্ম আস্তে আস্তে ভুলেই যাবে বইপড়ার কথা। তাই আমাদের উচিত আমাদের যুবসমাজকে বইমুখী করতে নানা কর্মসূচির আয়োজন করা। তরুণদের রাখতে হবে বিদ্যাচর্চায়, জ্ঞান অন্বেষণে এবং রাখতে হবে সমাজ উন্নয়নে।
তিনি বলেন, একটা সময় স্মার্টফোন ছিল দুর্লভ একটি বন্ধু। সেই সময় মানুষের আগ্রহ ছিল বই পড়ার প্রতি, গল্প করার প্রতি। অনেক সামর্থ্যবানের বাড়িতে থাকত নিজস্ব গ্রন্থাগার। এখন সেসব গল্প শুধুই অতীত। এ যুগে ঘরে ঘরে পাঠাগার না পাওয়া গেলেও স্মার্টফোন ঠিকই পাওয়া যায়।
এম এ মালেক বলেন, সামপ্রতিক এক গবেষণায় জানা গেছে, গত বছর মাত্র ৪৩ শতাংশ মানুষ বছরে মাত্র একটি বই পাঠ করেছেন। শুধু তাই নয় প্রতিদিনই বাড়ছে তরুণদের অনলাইনে কাটানো সময়ের হার। পাঁচ থেকে ১৫ বছর বয়সীরা প্রতি সপ্তাহে গড়ে ১৫ ঘণ্টা অনলাইনে কাটায়। যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে কিশোর বয়সীদের মধ্যে একাকীত্বের মাত্রা সবচেয়ে বেশি এবং ২০০৭ সালে আইফোন বাজারে আসার পর থেকে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে।
আজাদী সম্পাদক সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘বই কিনে কেউ কখনো দেউলিয়া হয় নাই’ লাইনটির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, সৈয়দ মুজতবা আলী গুরুত্ব দিয়েছেন বই কেনার ওপর। বাঙালির বইকেনার প্রতি বৈরাগ্যকে তীক্ষ্ণ উপহাস করেছেন তিনি। বাঙালির সেই অনীহা অনেকটাই কেটে গেছে এই বইমেলার বদৌলতে। বাংলা একাডেমির বইমেলায় হাজার হাজার মানুষ যাচ্ছে, বই কিনছে, গৌরবের প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে সমাগম হচ্ছে, মেলার তাৎপর্য উপলব্ধি করছে– সেটা অনেক বড় পাওয়া। বইমেলা মানুষকে আনন্দমুখী করে। মেলায় গেলে বই কেনা ও পড়ার জন্য তাগিদ অনুভব হয়।
এম এ মালেক বলেন, মানুষকে বইমুখী করে তোলার জন্য বইমেলার রয়েছে এক অসামান্য ভূমিকা। সকল বয়সের মানুষের জন্য এখানে থাকে উপযুক্ত বইয়ের পর্যাপ্ত কালেকশন। বাঙালি নাকি জাতিগতভাবে আরাম ও প্রমোদপ্রিয়। জ্ঞানান্বেষণের উদ্দেশ্যে লাইব্রেরিতে গিয়ে বইপড়া ও বই সংগ্রহ করার ইচ্ছা ও সুযোগ অনেকেরই হয় না। মেলা উপলক্ষ্যে প্রমোদ ও বইকেনা দুটোই একসাথে হয়ে যায়। মেলায় যেসব দুর্লভ বই হাতের নাগালে পাওয়া যায় অন্য অনেক সময়েই তা খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে।
এসময় চট্টগ্রামের সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদের সহযোগিতায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে একুশের বইমেলা এবার পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়াকে প্রশংসার দাবিদার উল্লেখ করে এম এ মালেক বলেন, এবার শুরু থেকেই চট্টগ্রামের সাহিত্যকর্মী, সংস্কৃতিকর্মী, বইপ্রেমী নাগরিকরা অভিন্ন বইমেলার স্বাদ গ্রহণ করতে পারছে শুরু থেকে। এ উদ্যোগ রীতিমতো প্রশংসনীয়।
জিন্নাহ চৌধুরী বলেন, লেখক, প্রকাশক ও পাঠক তিনপক্ষের দায়বদ্ধতা রয়েছে। পাঠক সবসময় একটি ভাল বইয়ের আশা করেন। লেখকও পাঠককে ভালো কিছু উপহার দেয়ার চেষ্টা করেন। লেখক বইয়ের মধ্যে শুধু রাম–শ্যাম, যদু–মধু, প্রেম–ভালোবাসা দিয়ে তার দায়বদ্ধতা শেষ করতে চান না। তার যে একটি সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে সেটাও প্রকাশ করার চেষ্টা করেন। একইসঙ্গে প্রকাশকও চেষ্টা করেন তাদের প্রকাশিত বইটি শুধুমাত্র যেন বিকিকিনির জন্য না হয়। তিনি বলেন, বইমেলাকে সামনে রেখে শত শত বই প্রকাশিত হয়েছে এবং আরো হবে। সবগুলো বইয়ের মান কি সমান? নিশ্চই না। এরমধ্যে ভালো পাঠক ভালো বইটি খুঁজে বের করবেন।
জাহিদুল ইসলাম বলেন, পাঠক কেন ইলেক্ট্রনিঙ ডিভাইসমুখী হচ্ছেন, সেটাই সবার চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। লেখক যাই লিখুক তাই গুরুত্বপূর্ণ। পাঠক কি গ্রহণ করল, কি গ্রহণ করল না এটা নিয়ে বাছবিচার না করে শুধুই লিখতে থাকেন। একসময় না একসময়, কেই না কেউ তা গ্রহণ করবে।
আলী প্রয়াস বলেন, পাঠকের জ্ঞান তৃষ্ণা মিটাতে লেখেন লেখক। এরপর লেখক তার পাণ্ডুলিপি তুলে দেন প্রকাশককে। প্রকাশক পাঠকের হাতে সেটা পৌঁছে দেন। এভাবেই তিনজনের যোগসূত্র রয়েছে।
মিজানুর রহমান শামীম বলেন, প্রকাশনা শিল্প বাঁচিয়ে রাখার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছেন পাঠক। প্রকাশনা শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে দায়বদ্ধতা আছে পাঠকের। কারণ পাঠক কি গ্রহণ করছে তার উপর নির্ভর করে বই প্রকাশ করেন প্রকাশকরা। তিনি বলেন, ইদানিং ভালো লেখকের চেয়েও টিকটক ও ফেসবুক সেলিব্রেটিদের বইয়ের প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন পাঠক। পাঠকরা বই বিমুখ হচ্ছেন, বিশেষ করে ছাত্র–ছাত্রীরা। তারা ডিভাইসমুখী হয়ে পড়ছেন।
আজকের অনুষ্ঠান : আজ বিকেল ৫ টায় বইমেলা মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘ছড়া উৎসব’। এতে প্রধান আলোচক থাকবেন কবি ও সাংবাদিক রাশেদ রউফ। সভাপতিত্ব করবেন ছড়াকার মিজানুর রহমান শামীম।