পরীক্ষামূলকভাবে বেশ কয়েক দফায় জ্বালানি তেল সরবরাহের পর অবশেষে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পাইপ লাইনে জ্বালানি তেল সরবরাহ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হচ্ছে। আগামী ১৬ আগস্ট সকালে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান চট্টগ্রামে এসে গুপ্তাখালস্থ পদ্মা অয়েল কোম্পানির ডেসপাস টার্মিনালে পাইপ লাইনে জ্বালানি তেল সরবরাহের কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন। অনুষ্ঠানে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার ইন চিফ মেজর জেনারেল মুহাম্মদ হাসান–উজ–জামান বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। পাইপ লাইনে জ্বালানি তেল সরবরাহের এই কার্যক্রম দেশের জ্বালানি খাতের ইতিহাসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার পাশাপাশি তেল চুরি এবং অপচয় ঠেকানোসহ কোটি কোটি টাকা সাশ্রয় করবে।
সূত্র জানিয়েছে, প্রায় ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় জ্বালানি তেল সরবরাহের পেট্রোলিয়াম পাইপ লাইন নির্মাণের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রকৌশলীরা। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে নারায়নগঞ্জের গোদনাইল হয়ে ঢাকার ফতুল্লা পর্যন্ত ২৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পাইপলাইনটিতে ইতোমধ্যে লক্ষ লক্ষ টন জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হয়েছে। চট্টগ্রামের প্রধান ডিপো থেকে ঢাকা অঞ্চলে জ্বালানি তেল সরবরাহকালে বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে বেশ কিছু সমস্যা চিহ্নিত হয়। এগুলো পুরোপুরি সুরাহা করা হয়েছে।
দেশের চাহিদার ৭০ লাখ টন জ্বালানির অন্তত ৩০ লাখ টন ব্যবহৃত হয় ঢাকা ও কুমিল্লা অঞ্চলে। এসব জ্বালানির বেশিরভাগই বেসরকারি অয়েল ট্যাংকারের মাধ্যমে নৌপথে পরিবাহিত হয়। যেখানে কোটি কোটি টাকার তেল চুরিসহ নানা ধরণের অপকর্ম ঘটে। ট্যাংকারে জ্বালানি তেল পরিবহনের ক্ষেত্রে পয়েন্ট ১৭ শতাংশ সিস্টেম লস বিপিসি মেনে নেয়। বছর শেষে এই পয়েন্ট ১৭ শতাংশ বিশাল অংক হয়ে দাঁড়ায়। সিস্টেম লস কিংবা তেল চুরির এই বিশাল লোকসান থেকে দেশের জ্বালানি তেল সেক্টরকে বাঁচাতেই মূলতঃ চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত পাইপ লাইন নির্মাণ করা হয়। ৫০ লাখ টন ধারণক্ষমতার পাইপ লাইনে বর্তমানে ৩০ লাখ টন জ্বালানি তেল সরবরাহ দেয়া হবে। জ্বালানি তেল সরবরাহ এবং চট্টগ্রাম থেকে গোদনাইলে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সিস্টেম লস শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
আগামী ১৬ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের পর থেকে এই পাইপ লাইন ব্যবহার করে তিনটি তেল বিপণন কোম্পানি জ্বালানি তেল সরবরাহ করবে। এই পাইপ লাইনের মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লার বারুড়া হয়ে জ্বালানি তেল যাবে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল এবং ঢাকার ফতুল্লায়। কুমিল্লার বরুড়ায় স্থাপন করা হয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ অটোমেটেড ডিপো। সর্বাধুনিক এই ডিপো থেকে চাঁদপুর, বি–বাড়িয়াসহ সন্নিহিত অঞ্চলের প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হবে। যা এখন নৌপথে চাঁদপুরে পাঠানো হয়ে থাকে। এই ডিপোতে জ্বালানি তেল গ্রহণ এবং সরবরাহ সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হবে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে। তেলের ওজন, তাপমাত্রা, সরবরাহ সবই পরিচালিত হবে কম্পিউটারাইজড প্রযুক্তিতে। ম্যানুয়েলি কোন কাজই হবে না। চট্টগ্রামের ডেসপ্যাচ টার্মিনালের স্ক্যাডা মাস্টার কন্ট্রোল স্টেশন থেকেই পুরো পাইপলাইনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনা করা হবে। স্ক্যাডা, টেলিকমিউনিকেশন এবং লিক ডিটেকশন করতে এই পাইপ লাইনের সাথে অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল লাইন সংযুক্ত রয়েছে। ২৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইনের ২৪১ কিলোমিটার অংশে ১৬ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ বসানো হয়েছে, যা পতেঙ্গা থেকে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। পাশাপাশি, গোদনাইল থেকে ফতুল্লায়ডিপো পর্যন্ত ৮.২৯ কিলোমিটার পৃথক ১০ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে।
বিপিসি’র একজন কর্মকর্তা জানান, ভূগর্ভস্থ এই পাইপলাইন ২২টি নদী ও খালের নিচ নিয়ে এসেছে এবং পুরো রুটে মোট ৯টি পাম্পিং স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে।
নৌপথে তেলবাহী ট্যাংকারে চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত তেল পরিবহনে অন্তত ২৪ ঘণ্টা সময় লাগে। নতুন পাইপলাইনের মাধ্যমে মাত্র ৪ ঘণ্টায় তেল পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত তেল পরিবহনে বিপিসির বার্ষিক খরচ হয় প্রায় ৩২৬ কোটি টাকা। কিন্তু পাইপলাইন চালু হলে খরচ হবে মাত্র ৯০ কোটি টাকা। ফলে বছরে অন্তত ২২৬ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। এছাড়া সিস্টেম লস এবং চুরি ঠেকানোর মাধ্যমেও কোটি কোটি টাকা রক্ষা পাবে বলেও সূত্র জানিয়েছে।