চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) এ চাকুরির সুবাধে চট্টগ্রাম–চুয়েট–চট্টগ্রাম এর নিয়মিত কমিউটার যাত্রী বলা যায় আমাকে। সকালে শহর হতে চুয়েট পৌঁছাতে চল্লিশ–পঞ্চাশ মিনিট লাগলেও, বিকেল অফিস হতে ফিরতে তা দেড়–দুঘণ্টার ধাক্কা। চট্টগ্রাম–কাপ্তাই সড়কটি সকালে অনেকটা হালকা থাকলেও সময় গড়াতে গড়াতে সড়কটি ব্যস্ত হয়ে উঠে। অফিসগামী মানুষের ব্যস্ততা, স্কুল কলেজগামী ছাত্র–ছাত্রীর ভিড়সহ সাধারণ মানুষের চলাচলের কারণে প্রতিনিয়ত বেলা বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে যায় রাস্তায় গাড়ির পরিমাণ। যাত্রী চাহিদায় একপর্যায়ে গড়ে প্রায় সাড়ে ছয় মিটার প্রশস্তের এ রাস্তায় ধারণ ক্ষমতারও বেশি গাড়ি রাস্তায় এসে পড়ে। সৃষ্টি হয় মোড়ে মোড়ে অসহনীয় জ্যাম এবং সাথে চলে অপরিপক্ক বাস–সিএনজি চালকদের দৌরাত্ম্য। চলে প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রশস্ত রাস্তায় একজন আরেকজনকে ওভারটেক করে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা। এ রাস্তায় চলা বাসগুলো ক্রমাগত হর্ণ বাজিয়ে চলে এবং ওভারটেক করে।
এরকমই এর ওভারটেক এর ঘটনায় অতি সম্প্রতি চুয়েটের মোটরসাইকেল আরোহী দুজন শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম কাপ্তাই সড়কে বাসের ধাক্কায় নিহত হয়েছেন। উক্ত সড়কের জিয়া নগরে সেলিনা কাদের চৌধুরী কলেজ সংলগ্ন এলাকায় এই দুর্ঘটনা ঘটে। এর প্রেক্ষিতে চুয়েট শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রাম–কাপ্তাই সড়ক অবরোধ করে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করেছিল। প্রশাসন ও বিভিন্ন সংস্থার আশ্বাসে আন্দোলন স্থগিত হয়। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন স্থগিত হওয়ার একদিন পর আবার ইছাখালী এলাকায় সিএনজি এক্সিডেন্টে একজন বৃদ্ধার মৃত্যু হয়। অর্থাৎ এই রাস্তায় এক্সিডেন্ট এবং ফলাফল স্বরূপ মৃত্যু অনেকটা নিয়মিত হয়ে উঠেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী চট্টগ্রাম কাপ্তাই সড়কে গত দেড় বছরে প্রায় ৭০ টির অধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে মারা গেছেন ২৫ জন এবং আহত হয়েছেন একশরও অধিক।
চট্টগ্রাম শহরের রাস্তার মাথা থেকে কাপ্তাই পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত কিলোমিটার রাস্তা। আগেই উল্লেখ করেছি এই রাস্তার প্রশস্ততা সাড়ে ছয় মিটারের মত। ৫০ কিলোমিটারের এই রাস্তায় অন্তত ৪০টি বাঁক সড়কটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ও বিশৃঙ্খল সড়কে পরিণত করেছে। এতে নিত্য ঘটছে দুর্ঘটনা, ব্যাপক যানজটে প্রতিনিয়ত কষ্ট পাচ্ছেন যাত্রীরা। প্রতিদিন যাতায়াত করেন পাঁচ উপজেলা–হাটহাজারী, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, কাপ্তাই ও বিলাইছড়ির কমপক্ষে পাঁচ লাখ মানুষ। এছাড়াও আছে শহর হতে এ পাঁচ উপজেলায় অফিসগামী মানুষ। এ সড়কে দূরপাল্লার বাস, ট্্রাক, মিনি ট্রাক, অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, ব্যক্তিগত কার ও মোটরচালিত রিকশা চলাচল করে। তবে সিএনজিচালিত অটোরিকশার দাপট সবচেয়ে বেশি। চালকদের হিসাবে, অন্তত ১০ হাজার অটোরিকশা চলাচল করে এই সড়কে যার অধিকাংশের এই লাইসেন্স নেই, চালকরাও অপরিপক্ক।
বিভিন্ন সংবাদপত্রাদির সংবাদ হতে জানা যায়, কম প্রশস্ত সড়ক ও অপরিপক্ব চালকদের কারণে সড়কের এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির জন্য দিন দিন দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। ফুটপাত দখল, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং ও যাত্রী উঠানামা করানো, সড়কের উপর বাজার, যেমন খুশি তেমন স্টাইলে গাড়ি চালানো, ফিটনেস ও নম্বরবিহীন যানবাহন, লাইসেন্সবিহীন চালক, ট্রাফিক সিস্টেমের অভাব, ঘুষ বাণিজ্য, সাধারণ মানুষের সদিচ্ছা, টার্মিনালের অভাব, আইন না মানার মানসিকতা সহ নানা কারণে কাপ্তাই সড়কে কোনো শৃঙ্খলা নেই। এসব কারণে এতে সড়ক জুড়ে তীব্র যানজট, নিয়মিত সড়ক দুর্ঘটনা সহ নিত্য দুর্ভোগ লেগেই রয়েছে।
চট্টগ্রাম–কাপ্তাই সড়কের ব্যস্ততম বড় মোড়গুলোর অন্যতম হল রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া। এ জায়গায় একাধারে বাজার, অফিস, স্কুল, বিপণিবিতান ও হাসপাতালের অবস্থানের কারণে সব সময় শত শত মানুষের ভিড় লেগে থাকে। ব্যস্ত এই মোড়ে যানবাহন চলাচল করে বিশৃঙ্খলভাবে। সড়কের ওপর দাঁড়িয়েই চলে যাত্রীরা ওঠানামা। হুটহাট বাস–ট্রাকের সামনে এসে পড়ে তিন চাকার যান সিএনজি ও অটোরিকশা। শুধু নোয়াপাড়া নয়, চট্টগ্রাম–কাপ্তাই সড়কের ১১টি মোড়ে নিয়মশৃঙ্খলার ছিটেফোঁটাও নেই। এগুলোর মধ্যে নজুমিয়া হাট, পাহাড়তলী, শান্তিরহাট, গোডাউন, ইছাখালী, রোয়াজারহাটসহ মরিয়মনগর চৌমুহনীতে সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করানো হয়। পার্কিংও চলে সড়কের ওপর। এ ছাড়া সড়কের ওপরই বসে বাজার। আবার মোড় পেরোলেই যানবাহনগুলো বেপরোয়া গতির ‘প্রতিযোগিতায়’ নামে। ফলে ছোট–বড় দুর্ঘটনা লেগেই আছে। পঞ্চাশ কিলোমিটারের এ রাস্তায় নোয়াপাড়া ছাড়া অন্য কোথাও ট্রাফিক পুলিশ চোখে পড়ে না।
কাপ্তাই রাস্তার মোড়ে গেলে চোখে পড়ে আরেক নৈরাজ্য। সচেতন মানুষ হিসেবে তা চোখে পড়লেও কিছু বলার সাহস হয়ে উঠে না তখন। সিএনজিতে যাত্রীপূর্ণ করে গাড়ি চলা শুরু করার মুহূর্তেই লাঠি হাতে একজন এসে হাজির হবে। ওকে দশ টাকা দিলেই গাড়ি ছাড়তে পারবে। জানি না এই টাকার ভাগ কোথায় যায়? কার কাছে যায়? কতটুকু পর্যন্ত যায়? এসব অবৈধ লেনদেনের কারণেই হয়তো অবৈধ সিএনজি, অপরিপক্ব সিএনজি ড্রাইভাররা লাইসেন্স পেয়ে রাস্তায় নামে এবং ঘটায় দুর্ঘটনা। আবার অন্যপক্ষে কাপ্তাই–লিচুবাগান হতে যে সিএনজিগুলো কাপ্তাই রাস্তার মাথা অবধি যাওয়ার কথা, অনেক সময় সেগুলো ৪০০/৫০০ মিটার আগেই যাত্রী নামিয়ে দেয়। কারণ তাদের কাছে অবৈধ টোকেন নেই বা বৈধ কোনো কাগজপত্র নেই। দিনশেষে হয়রানিটা হয় সাধারণ যাত্রীদের।
এখন প্রশ্ন হল শুধু রাস্তা প্রশস্ত করেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? সাধারণভাবে উত্তর হলো না। কিন্তু দুর্ঘটনা প্রতিরোধে অনেকগুলো কারণের মধ্যে রাস্তা প্রশস্তকরণ ও একটি কারণ। আমরা চট্টগ্রাম থেকে হাটহাজারী পর্যন্ত রাস্তা চারলেন করে মাঝখানে রাস্তা বিভাজক (ডিভাইডার) দেওয়ার ফলাফল দেখতে পাচ্ছি। ঐ রাস্তায় দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে আসছে। রাস্তা চার লাইন করার আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়গামী ছাত্র–ছাত্রী ও সাধারণ যাত্রীদের অনেক দুর্ঘটনার আগে খবর পাওয়া যেত। এখন আর প্রায় শোনাই যায় না। বিশেষজ্ঞদের মতে, কাপ্তাই রোডে বাসের পরিমাণ বেশি নয়, বরং সিএনজি পরিমাণ অতিরিক্ত। আগে থেকেই এ রোড চট্টগ্রামের অন্য রাস্তার তুলনায় শান্ত ছিল। সমস্যা হলো নিয়ম না মেনে বা বেপরোয়া গাড়ি চালানো। সেটা চার বা ছয় লাইন হলেও চলবে আর এরকম মর্মান্তিক দুর্ঘটনা হবে। তাই সবার আগে রাস্তার নিয়ম মানতে বাধ্য করতে ভূমিকা নিতে হবে। সেক্ষেত্রে নিয়ম মেনে গাড়ি চালানো, মোটরবাইক চালক ও আরোহীদের হেলমেট পড়াও কোনোমতেই বেপরোয়া গাড়ি না চালানো, ওভার টেক না করা, ড্রাইভিং লাইসেন্স এর সঠিক ও কঠোর মূল্যায়ন, বিপজ্জনক স্থানে যথাযথ গতিরোধক এর ব্যবস্থা ইত্যাদি। অর্থাৎ সড়কে শৃঙ্খলা না ফিরিয়ে রাস্তা বড় করলেই আর যা হোক দুর্ঘটনা বন্ধ হবে না, হয়ত কিছুটা কমবে। অতএব শৃঙ্খলা ফেরাতে সড়ক প্রশস্তকরণসহ অদক্ষ চালক ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল বন্ধে কঠোর মনিটরিংয়ের ব্যবস্থাটা জরুরিভিত্তিতে করতে হবে। একসময় শুনেছিলাম গুরত্ব বিবেচনায় সড়কটি প্রশস্তকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। আবার অজানা কারণে সে উদ্যোগ ফাইলবন্দী। জনপ্রতিনিধিরা বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় তা নীতিনির্ধারকসহ সবার নজরে আনতে পারেন। প্রত্যাশা আর কোনো প্রাণ যেন না যায় এ সড়কে।
লেখক: অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।