চট্টগ্রাম–করাচি সরাসরি জাহাজ চলাচলে গতিশীলতা আনার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের আমদানি–রপ্তানি বৃৃদ্ধির জন্য জাহাজ চলাচলের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। মাস কয়েক আগে কয়েকটি দেশের বন্দর হয়ে ঘুরপথে শুরু হওয়া চট্টগ্রাম–করাচি জাহাজ চলাচলকে আরো বেশি কার্যকর করা গেলে ব্যবসা বাণিজ্যে গতিশীলতা আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। চট্টগ্রাম করাচি সরাসরি জাহাজ চলাচলসহ সার্বিক বিষয়ে কথা বলতে পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী আজ চট্টগ্রাম বন্দর সফরে আসছেন। বিষয়টি নিয়ে তিনি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করবেন। ব্যবসা বাণিজ্যে গতিশীলতা আনতে পাক বাণিজ্যমন্ত্রী চট্টগ্রামে ব্যবসায়ীদের সাথেও বৈঠক করবেন। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী শিল্পপতিরাও চট্টগ্রাম করাচি সরাসরি জাহাজ চলাচলে গতি আসলে ব্যবসা–বাণিজ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন।
সূত্র জানিয়েছে, পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের বহু ব্যবসা বাণিজ্য রয়েছে। কিন্তু সরাসরি জাহাজ চলাচল না থাকায় এই ব্যবসায় খুব বেশি গতি আসেনি। সরাসরি জাহাজ চলাচল না থাকায় ব্যবসা বাণিজ্যে সবসময়ই একটি স্থবিরতা ছিল বলে উল্লেখ করে সূত্র বলেছে যে, পাকিস্তান থেকে চালসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানির সুযোগ রয়েছে। এরমধ্যে তৈরি পোশাকশিল্পের কাঁচামাল যেমন ডেনিম ফেব্রিক, সুতোসহ বিভিন্ন পণ্য রয়েছে। এছাড়া চিনি, সোডা অ্যাশ, ডলোমাইট লুম্পস, ন্যাচারাল ডলোমাইট, শুঁটকি, ইউপিএস, আলু, রেডিয়েটর কোরসহ বেশ কিছু পণ্য আমদানি হয়ে থাকে। এছাড়া সিমেন্ট ক্লিংকার, ফলমূল এবং থ্রিপিস আমদানি হয়। বেশিরভাগ পণ্য আনা হয় বাল্ক ক্যারিয়ারে। কিছু কিছু পণ্য কন্টেনার জাহাজেও আনা হয়।
পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ব্যাপক না হলেও অনেক বলে উল্লেখ করে সূত্র বলেছে, বাংলাদেশ থেকে গত বছর প্রায় ৬.২৬ কোটি ডলারের পাট, ওষুধ, হাইড্রোজেন, চা ও তৈরি পোশাক পাকিস্তানে রপ্তানি হয়েছে। অপরদিকে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আমদানি করা হয়েছে প্রায় ৭৫ কোটি ডলারের পণ্য। এর মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল এবং প্রক্রিয়াজাতকরণকৃত চামড়া।
গত অর্থবছরে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে মোট ১৬ লাখ টন পণ্য আমদানি করা হয়। এরমধ্যে মাত্র ৩ লাখ টনের মতো এসেছিল কন্টেনারে, বাকিগুলো খোলা পণ্যবাহী জাহাজে। বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের সরাসরি জাহাজ চলাচল না থাকায় আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের পণ্য পরিবহনে বেশ ঝক্কি কাজ করে। পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে বাংলাদেশের কন্টেনারবাহী পণ্য কলম্বো, সিঙ্গাপুর, দুবাইসহ বিভিন্ন বন্দর ঘুরে চট্টগ্রাম বন্দরে আসতে সময় লাগে ২০ দিন থেকে এক মাস। আবার করাচি থেকে আসা কন্টেনার সিঙ্গাপুর, কলম্বো কিংবা পোর্ট কেলাংয়ে ঠিকঠাকভাবে ফিডার ভ্যাসেল ধরতে না পারলে এই সময় আরো বেশি লাগে। কিন্তু করাচি–চট্টগ্রাম রুটে সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু করা গেলে এই সময় ১০–১১ দিনে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়।
চট্টগ্রাম–করাচি জাহাজ চলাচলের সম্ভাবনার বিষয়টি সামনে নিয়ে দুবাইভিত্তিক কন্টেনার জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থা ‘ফিডার লাইনস ডিএমসিসি’ নতুন একটি রুটের মাধ্যমে পাকিস্তান–বাংলাদেশ সরাসরি পণ্য পরিবহন শুরু করে।
পানামার পতাকাবাহী ‘ইউয়ান জিয়াং ফা ঝং’ নামের কন্টেনার জাহাজ দিয়ে করাচি বন্দর থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত জাহাজ চলাচল শুরু করে। গত বছরের ১১ নভেম্বর জাহাজটি করাচি থেকে কন্টেনার নিয়ে বেশ কয়েকটি বন্দর ঘুরে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রামে পৌঁছায়। ইতোমধ্যে জাহাজটি ৫টি ভয়েজ সম্পন্ন করেছে। প্রতিবারই জাহাজটি পুরোপুরি লোড অবস্থায় চলাচল করেছে।
বন্দর সূত্র জানিয়েছে, দুবাইভিত্তিক ‘ফিডার লাইনস ডিএমসিসি’ করাচি–চট্টগ্রাম সরাসরি জাহাজ চলাচল বলা হলেও কার্যতঃ এটি সরাসরি নয়। জাহাজটি সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে পণ্য নিয়ে করাচি যায়। ওখান থেকে পণ্য নিয়ে ভারতের মুন্দ্রা, মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং কিংবা সিঙ্গাপুর বা ইন্দোনেশিয়া ঘুরে চট্টগ্রামে আসে। প্রতি ৪২ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে জাহাজটি একটি ভয়েজ সম্পন্ন করছে। এটি করাচি থেকে যাত্রা করে চট্টগ্রামে আসা জাহাজ না হলেও করাচি কিংবা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কন্টেনার নিয়ে সেটি সরাসরি গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। এতে সেকেন্ড কোনো জাহাজে ট্রানশিপমেন্ট করতে হয় না। এই সুবিধা ছাড়া সময়ের দিক থেকে আমদানি রপ্তানিকারকেরা খুব বেশি সুবিধা পাচ্ছেন না বলে উল্লেখ করে সূত্র জানায়, আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যে সবচেয়ে বেশি জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সময়। যেটি কেবলমাত্র দুই বন্দরের মাঝে সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু করা গেলেই রক্ষা করা সম্ভব হবে। তবে এক্ষেত্রে কার্গোর পরিমাণ অনেক বড় ব্যাপার বলেও সূত্রগুলো মন্তব্য করেছে। প্রয়োজনীয় কার্গো পাওয়া না গেলে কন্টেনার জাহাজের একটি রুট চালু রাখা অসম্ভব। তবে এক্ষেত্রে ভারত কিংবা মালয়েশিয়ার বন্দর হয়ে আসলে কার্গোর ঘাটতি বহুলাংশে কমে যাবে।
চট্টগ্রাম–করাচি সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু হলে সময় এবং খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম–করাচি সরাসরি জাহাজ চলাচলসহ সার্বিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার জন্য পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান আজ চট্টগ্রাম বন্দর সফরে আসছেন। এই সময় বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিনও উপস্থিত থাকবেন। পাক বাণিজ্যমন্ত্রী এবং বাণিজ্য উপদেষ্টা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এসএম মনিরুজ্জামানসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে মতবিনিময় করবেন। পরে তারা বন্দরের জেটি ও ইয়ার্ডসহ সক্ষমতার বিষয়গুলোও সরজমিনে পরিদর্শন করবেন।
পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের সাথেও বৈঠক করবেন। এই সময় তিনি পাকিস্তানের ব্যবসায়ী গ্রুপের শুভেচ্ছা এবং কিছু ম্যাসেজ চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের প্রদান করবেন বলেও সূত্র জানিয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক অন্তবর্তীকালীন সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন আজ বিকেলে পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রীকে সাথে নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর সফরে আসছেন বলে জানিয়েছেন।
চট্টগ্রামের একাধিক ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতি বলেছেন, পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রীর এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুইদেশের মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে এই সফর ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। চট্টগ্রামের সাথে করাচির সরাসরি জাহাজ চলাচল পুরোদমে শুরু করা গেলে দেশ দুইটির বাণিজ্য ঘাটতিও কমে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।
পাকিস্তানের সাথে ব্যবসা করেন এমন একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আগে পাকিস্তান থেকে পণ্য আমদানি করে পদে পদে হয়রানি হতে হতো। জাহাজ কবে আসবে তার কোনো ঠিক ছিল না। আবার চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ আসার পর সব ধরনের পণ্য খালাসের আগে শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করতো কাস্টম। এতে করে একদিকে পণ্য আসতে সময় লাগতো বেশি, অন্যদিকে খালাসের এমন বিড়ম্বনার কারণে আমদানিকারকরাও বিমুখ হতেন। গতবছরের ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পাকিস্তানের আমদানি পণ্য খালাসে ওই জটিলতা দূর করে। দুই দেশের মধ্যে ব্যবসার সুবিধার্থে পাকিস্তান থেকে আমদানি করা সকল পণ্যের ওপর থেকে শতভাগ কায়িক পরীক্ষার শর্ত প্রত্যাহার করা হয়। এই শর্ত প্রত্যাহারের ফলে এখন অন্যান্য দেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বিবেচনায় যেভাবে পরীক্ষা করা হয়, পাকিস্তান থেকে আমদানির ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ফলে আগের ভোগান্তি এখন আর নেই বলেও তিনি স্বীকার করেন।