সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণে এবার দুর্নীতির সংযোগ তৈরি হয়েছে চট্টগ্রাম ভূমি অধিগ্রহণ (এলএ) শাখা থেকে কক্সবাজার এলএ শাখা পর্যন্ত। চট্টগ্রাম এলএ শাখায় ক্ষতিপূরণের টাকা ছাড় করিয়ে দিতে কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠার পরেও এক সার্ভেয়ার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বদলি নিয়েছেন কক্সবাজার এলএ শাখায়। এছাড়া দুদকে মামলার পর চট্টগ্রাম এলএ শাখার বেশ কয়েকজন দালাল ও ক্যাজুয়াল কর্মচারী স্থান পাল্টে কাজ করছেন কক্সবাজার এলএ শাখায়। এসব কর্মচারী ও দালালরা জড়িয়ে পড়ছেন কক্সবাজারের সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের এলএ ক্ষতিপূরণের অর্থ ছাড়ের কমিশন বাণিজ্যে। এদিকে সার্ভেয়ারের মতো একজন ছোট কর্মচারীকে এক জেলা থেকে কাজের ক্ষেত্রে অধিকতর সুবিধাজনক জেলায় বদলিতে মন্ত্রণালয়ের নাক গলানো নিয়েও সমালোচনা তৈরি হয়েছে।
সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর নগরীর শপিং কমপ্লেক্স থেকে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার চেইনম্যান নজরুল ইসলামকে নগদ সাড়ে ৭ লাখ টাকা এবং সাড়ে ৯১ লাখ টাকার ১০টি চেকসহ হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরপর নজরুলের বিরুদ্ধে মামলা হলে তার বেশ কয়েকটি ব্যাংক হিসাব ও একটি ফ্ল্যাট জব্দ করে দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা। পরে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলা হয় নজরুল ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে। বর্তমানে নজরুল কারাগারে থাকলেও তার স্ত্রী পলাতক বলে জানিয়েছে দুদক। তবে ৯১ লাখ টাকার এলএ চেক নিয়ে হাতেনাতে চেইনম্যান নজরুল গ্রেপ্তার হলেও এসব এলএ চেক কিভাবে নজরুলের হাতে গিয়েছে তার উত্তর এখনো মেলেনি। যে কারণে অধরা রয়ে যাচ্ছে অনেক বড় বড় রাঘব বোয়াল।
নজরুলকে গ্রেপ্তারে অভিযানে অংশ নেওয়া দুদকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘অভিযানের সময় নজরুলের দোকান থেকে ২০-২৫টি এলএ মামলার মূল নথি পাওয়া গেছে। পরে তার বাসায় অভিযান চালিয়ে এক বস্তা এলএ মামলার নথি জব্দ করা হয়। এসব নথির মধ্যে অসংখ্য নথি রয়েছে যেগুলো চট্টগ্রাম এলএ শাখার সার্ভেয়ার ইব্রাহীম খলিল রিসিভ করেছেন।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম এলএ শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, সার্ভেয়ার ইব্রাহীম খলিল দীর্ঘদিন এলএ শাখায় কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল। সেই সূত্র ধরে দুদকের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার কিছুদিন আগে নজরুলই সার্ভেয়ার ইব্রাহীম খলিলকে নোয়াখালী এলএ শাখা থেকে চট্টগ্রামে বদলি করিয়ে আনেন। এখানে এসেই নজরুলের সাথে সিন্ডিকেট করে কমিশন বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন সার্ভেয়ার ইব্রাহীম খলিল। বর্তমানে তিনি মোটা অংকের বিনিময়ে মন্ত্রণালয়ে তদবির করে কক্সবাজার এলএ শাখায় বদলি হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে গত ২০ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদীতে ‘চট্টগ্রাম এলএ শাখায় অর্ধশত দালাল; অধরা রাঘব বোয়ালরা; চট্টগ্রাম চার হাজার কোটি টাকার ভূমি অধিগ্রহণ’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে নাম প্রকাশ পাওয়ার পর চট্টগ্রাম এলএ শাখার প্রথম ও দ্বিতীয় সারির দালালরা সটকে পড়েন। বর্তমানে ওই স্থান নিয়েছেন নতুন তৃতীয় সারির দালালরা। পত্রিকায় আসা প্রথম সারির দালালদের মধ্যে বেশ কয়েকজন কক্সবাজার এলএ শাখায় কমিশনের কাজ শুরু করেছেন। তাছাড়া চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার এলএ শাখার সার্ভেয়ার ওয়াসিম ঘুষের ৯৩ লাখ ৬০ হাজার ১৫০ টাকাসহ হাতেনাতে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তারের পর দুদকের অভিযান শুরু হলে চট্টগ্রামের ন্যায় কক্সবাজার এলএ শাখার প্রথম সারির দালালরা গা ঢাকা দেন। এ সুযোগে চট্টগ্রামের পুরনো দালাল ও জেলার তৃতীয় সারির দালালরা কক্সবাজার এলএ শাখায় নতুন করে কমিশন বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ছেন।
অন্যদিকে দৈনিক আজাদীকে সংবাদ প্রকাশের পর গত ১৩ অক্টোবর ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাঠ প্রশাসন-১ অধিশাখার উপসচিব মোছাম্মাৎ মমতাজ বেগম স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে চট্টগ্রাম এলএ শাখার সার্ভেয়ার ইব্রাহীম খলিলকে (সংযুক্ত মীরসরাই উপজেলা ভূমি অফিস) কক্সবাজার এলএ শাখায় সংযুক্তি করে বদলিয় আদেশ দেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুদকের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া নজরুলের এক কম্পিউটার অপারেটর ছিলেন রনি। রনি এলএ শাখায় ক্যাজুয়াল কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন। কমিশন বাণিজ্যের সার্ভেয়ারদের কম্পিউটার ছিল তার নখদর্পনে। রনির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠার পর তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এলএ) আমিরুল কায়সার মুচলেকা নিয়ে তাকে (রনি) এলএ শাখা থেকে বের করে দেন। রনির বাড়ি কক্সবাজারের রামুতে। নজরুল দুদকের হাতে গ্রেপ্তারের আগে রনিকে সার্ভেয়ার ইব্রাহীম খলিলের সাথে সংযুক্ত করে দিয়েছিলেন। এলএ শাখা থেকে বের করে দিলেও রনি অফিসের বাইরে সার্ভেয়র ইব্রাহীম খলিল ও দালাল মামুনুলের কাজ করতেন। সার্ভেয়ার ইব্রাহীম খলিল কক্সবাজার এলএ শাখায় যোগদানের পর রনিকে নিয়ে চট্টগ্রাম এলএ শাখার দালাল মামুনুল বর্তমানে মহেশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ি বন্দর প্রকল্পের এলএ ফাইল নিয়ে কমিশন বাণিজ্য শুরু করেছেন। কক্সবাজার এলএ শাখার সংশ্লিষ্ট সূত্র জানা গেছে, দুদকের অভিযানের কারণে ও করোনাকালীন ২০১৩-১৪ সালের যেসব ফাইলের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। গত ১৫ দিন থেকে সেইসব ফাইলও চালু হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের আদেশে সার্ভেয়ার বদলির বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার এ বি এম আজাদ বুধবার সন্ধ্যায় দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘ভূমি অফিসের সার্ভেয়ারসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি বিভাগীয় কমিশনার ও সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক করে থাকেন। মন্ত্রণালয় চাইলেও বদলি করতে পারেন।’ সার্ভেয়রের মতো ছোট কর্মচারীদের মন্ত্রণালয় থেকে বদলি আদেশ দেওয়ার দুরভিসন্ধির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় ভয়াবহ দুর্নীতি হয়। বর্তমানে চট্টগ্রামের চেয়ে কক্সবাজারে বেশি সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ চলছে। সে হিসেবে কক্সবাজার এলএ শাখায় দুর্নীতির পরিধিও বেশি। এরমধ্যে গত বছরের শেষে চট্টগ্রামে একজন ও চলতি বছরের শুরুতে কক্সবাজার এলএ শাখার একজন সার্ভেয়ার হাতেনাতে দুদকের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ওই দুই ঘটনার পর থেকে চট্টগ্রাম বিভাগের এই দুই জেলার ভূমি অধিগ্রহণ শাখা নিয়ে আলোচনা সমালোচনার অন্ত নেই। সমালোচনার মধ্যেও চট্টগ্রাম থেকে সার্ভেয়ারের মতো একজন ছোট কর্মচারীকে কক্সবাজার এল এ শাখায় বদলি করা হয়েছে। এটা অবশ্যই দুরভিসন্ধিমূলক। কিন্তু ছোট পদের একজন কর্মচারী যার সম্পর্কে নানা রকম বিতর্ক রয়েছে, তাকে আগ্রহ দেখিয়ে মন্ত্রণালয় অন্যত্র বদলি করেছে।’ এই আইনজীবী বলেন, ‘পছন্দের জায়গায় যাওয়ার জন্য সে (সার্ভেয়ার) হয়তো নিজেই তদবির করে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বদলি নিয়েছেন। মন্ত্রণালয় অনেক কিছুই পারে। কিন্তু যেখানে বিভাগীয় কমিশনার কিংবা জেলা প্রশাসক বদলির অথরিটি, সেখানে সার্ভেয়ারের মতো নিম্ন পদের একজন ছোট কর্মচারীকে বদলির জন্য মন্ত্রণালয়ের নাক গলানোতে প্রমাণিত হয়েছে, বাংলাদেশে সবই সম্ভব। এখন কক্সবাজারে বেশি ভূমি অধিগ্রহণ হচ্ছে, ক্ষতিপূরণের টাকা বেশি লেনদেন হচ্ছে। সেখানে (কক্সবাজার) গিয়ে লোকজনকে হয়রানি করার আরো বেশি সুযোগ তৈরি হয়েছে আর কী।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সার্ভেয়ার ইব্রাহীম খলিলের বিরুদ্ধে নোয়াখালীতে দুদকের অনুসন্ধান চলছে। তার হাত অনেক লম্বা। সার্ভেয়র হলেও মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন পর্যায় পর্যন্ত তার হাত রয়েছে। তিনি এতোই প্রভাবশালী যে চাকুরি জীবনে বেশিরভাগ সময় ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় ছিলেন। উপজেলা ভূমি অফিসে থাকলেও জেলা এলএ শাখায় সংযুক্ত থাকেন। এখন আরো বেশি দুর্নীতি করার জন্য কক্সবাজারে পোস্টিং নিয়েছেন।’