চট্টগ্রামে ফিটনেসসহ ডকুমেন্ট হালনাগাদবিহীন প্রায় ৩৫ হাজার যানবাহনের ভাগ্য নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে গাড়ির মেয়াদোত্তীর্ণ ডকুমেন্ট জরিমানা ব্যতিরেকে হালনাগাদ করার সময় নির্ধারিত রয়েছে। এতে গাড়ির ডকুমেন্ট হালনাগাদ করতে বেকায়দায় পড়ছেন বেশিরভাগ গাড়ির মালিক। পণ্যবাহী ট্রাক, যাত্রীবাহী বাস, মিনিবাস, প্রাইভেট কার, জিপ, মাইক্রো, টেক্সি, টেম্পু রয়েছে ফিটনেসবিহীন এসব গাড়ির তালিকায়। তবে গাড়ির ডকুমেন্ট হালনাগাদ করতে না পারার জন্য করোনাকালীন আর্থিক মন্দাকে অযুহাত হিসেবে তুলে ধরছেন গাড়ি মালিকরা।
জানা যায়, গত বছরের ২০ জুন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের বিআরটিএ সংস্থাপন শাখার সহকারী সচিব মো. জসিম উদ্দিন স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে গাড়ির কাগজপত্র (ফিটনেস, ট্যাক্স টোকেন ও রুট পারমিট) এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স এর জরিমানা ব্যতীত মূল কর ও ফি জমা দিয়ে গাড়ির কাগজপত্র হালনাগাদ করার জন্য সুযোগ প্রদান করা হয়। চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত এ সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর খেলাপী যানবাহন মালিকদের আর কোনো সুযোগ দেয়া হবে না মর্মে ওই প্রজ্ঞাপনে ঘোষণা দেওয়া হয়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে কোভিড সংক্রমণ শুরু হলে পরবর্তীতে এই মেয়াদ বাড়িয়ে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১০ বছরের অধিক সময় ফিটনেসবিহীন এমন গাড়ির সংখ্যা প্রায় ৫৬ হাজারের বেশি। দেশে ফিটনেসবিহীন গাড়ি রয়েছে প্রায় ৪ লাখ ৮০ হাজার। তন্মধ্যে বাস ১৪ হাজার, কার্গোভ্যান দেড় হাজার, কাভার্ডভ্যান ৫ হাজার, ডেলিভারি ভ্যান ৭ হাজার, হিউম্যান হলার ১৪ হাজার, জিপ ১০ হাজার, মাইক্রোবাস ২২ হাজার, মিনিবাস ৯ হাজার, পিকআপ ৫০ হাজার, ট্রাক ৫৫ হাজার, প্রাইভেট কার ৪৮ হাজার, ট্যাক্সিক্যাব ১৬ হাজার এবং অটোরিকশা ১ লাখ ৬০ হাজার ছাড়াও ট্যাঙ্কার, ট্রাক্টর, অ্যাম্বুলেন্সসহ বিভিন্ন ফিটনেসবিহীন গাড়ি রয়েছে। তন্মধ্যে চট্টগ্রামে রয়েছে চলমান ৩৫ হাজার গাড়ি রয়েছে, যেগুলো ফিটনেসবিহীন। তবে দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত ও চলাচল অনুপযোগী গাড়ির সংখ্যা আরো বেশি। বিশেষত চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১০ বছরের অধিক সময় ধরে ডকুমেন্ট হালনাগাদ করা হয়নি চট্টগ্রামে নিবন্ধিত এমন ৫৫ হাজার গাড়ির তথ্য মুছে দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) কেন্দ্রীয় সার্ভার থেকে। তালিকায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক রয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠানের যানবাহনগুলো। তাছাড়া ব্যক্তি মালিকানাধীন ট্রাক, হিউম্যান হলার, বাসও রয়েছে এ তালিকায়।
এদিকে চট্টগ্রামে বিভিন্ন মালিক সংগঠনের নামে অন্তত ৮-১০ হাজার পণ্যবাহী ট্রাক-কাভার্ডভ্যান রয়েছে। এরমধ্যে বেশিরভাগ গাড়ির বেশ কয়েকবছর ধরে ফিটনেস, ট্যাঙটোকেন কিংবা রুট পারমিট নবায়ন হয়নি। অসংখ্য গাড়ি রয়েছে ‘চার’ ডিজিটের। ফিটনেটবিহীন কিংবা ‘চার’ ডিজিটের হলেও নগরী দাপিয়ে বেড়ায় এসব ট্রাক। ট্রাকগুলোর বড় অংশ বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত। আবার সাইলো ও সিএসডি থেকে খাদ্যপণ্য পরিবহন করে থাকে ফিটনেসবিহীন ট্রাক। সার্ভার থেকে মুছে যাওয়া ট্রাকের তালিকাতে রয়েছে এসব সংগঠনের বেশিরভাগ ট্রাক।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, ১৯৯১ সাল থেকে ‘ছয়’ ডিজিটের রেজিস্ট্রেশন নাম্বার শুরু হয়। তবে ‘চার’ ডিজিটের গাড়িগুলোকে সর্বশেষ ২০১৫ সাল পর্যন্ত নবায়ন করা হয়। মানে ‘চার’ ডিজিটের গাড়িগুলো ১৯৯১ সালের আগে নিবন্ধিত। এগুলো কমপক্ষে ৩০ বছরের পুরনো।
বিআরটিএ পরিচালক (অপারেশন) শীতাংশু শেখর বিশ্বাস বলেন, ‘গাড়ির ফিটনেস হালনাগাদ করার জন্য একাধিকবার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। জরিমানা ব্যতিরেখে ডকুমেন্ট হালনাগাদ করার জন্য সরকার সর্বশেষ গত ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে সময়টি বাড়িয়ে আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বেঁধে দেওয়া হয়। এখন মন্ত্রণালয় থেকে নতুন করে সময় বাড়ানোর কোন সিদ্ধান্ত আসেনি। এরমধ্যে হালনাগাদ করা না হলে পরবর্তীতে এসব যানবাহনের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তাছাড়া মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যেসব গাড়ি ১০ বছর ধরে ডকুমেন্ট নবায়ন করা হচ্ছে না সেগুলোর নিবন্ধন বাতিল করার পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
বিআরটিএ চট্টগ্রামের এক কর্মকর্তা দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘১০ বছর ধরে ডকুমেন্ট হালনাগাদ করা হয়নি চট্টগ্রামে নিবন্ধিত এমন ৫৫ হাজার যানবাহনের তথ্য ২০২০ সালের শুরুতে বিআরটিএ’র সার্ভার থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে বেশিরভাগ সরকারি যানবাহন। তাছাড়া বাস, ট্রাক, হিউম্যান হলার রয়েছে। তবে কোন মোটর সাইকেল নেই। সারাদেশে সবমিলিয়ে দুই লাখের অধিক হালনাগাদবিহীন যানবাহনের তথ্য মুছে ফেলা হয়। ওই কর্মকর্তা বলেন, সার্ভার থেকে ডিলিট করে দেওয়া যানবাহনের মধ্যে এখন যারা ডকুমেন্ট হালনাগাদ করতে আসবেন তারা সংশ্লিষ্ট বিআরটিএ অফিসে আবেদন করবেন। গ্রাহকের আবেদন প্রধান কার্যালয়ে পাঠানোর পর সংশ্লিষ্ট গাড়ির তথ্য সার্ভারে আপলোড দেওয়া হবে। তারপর নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে ডকুমেন্ট হালনাগাদ করা যাবে।
চট্টগ্রাম সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব গোলাম রসুল বাবুল বলেন, ‘করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে দেশের অর্থনীতি চরম ঝুঁকিতে পড়েছে। প্রথম পর্যায়ের সংক্রমণের পর এখন দ্বিতীয় পর্যায়ের সংক্রমন শুরু হয়েছে। সারা পৃথিবীতে নতুন করে লকডাউন শুরু হচ্ছে। করোনার কারণে আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ আর্থিকভাবে মন্দায় পড়েছেন। বিশেষ করে পরিবহন খাত খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারণ সরকারি নির্দেশনা মেনে দীর্ঘদিন যানবাহন বন্ধ ছিল। আবার গণপরিবহন চালু হলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালানো হচ্ছে। এতে গাড়ির আয় আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। করোনা সংক্রমণের ভয়ে সাধারণ মানুষের চলাফেলাও কমে গেছে। যার প্রভাব পড়েছে পরিবহন খাতে।’ তিনি বলেন, গাড়ির সাধারণ মালিকরা চরম আর্থিক সংকটে রয়েছে। জরিমানা বাদ দিয়েও গাড়ির ডকুমেন্ট হালনাগাদ করতে সামর্থ হারিয়েছেন বেশিরভাগ গাড়ির মালিক। কারণ অনেক গাড়ি আছে এক থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত সরকারি ফি বকেয়া পড়েছে। ব্যক্তিগত গাড়ির ডকুমেন্ট হালনাগাদ করতেও অনেকে ব্যর্থ হচ্ছেন। সময় বাড়ানোর জন্য আমরা ইতোমধ্যে যোগাযোগ মন্ত্রী ও সচিবকে পত্র দিয়েছি। আমাদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে।’
এ পরিবহন নেতা বলেন, ‘চট্টগ্রামে আমাদের গণপরিবহনের ডকুমেন্ট ১০ বছরের পুরোনো নবায়ন না হওয়া তেমন একটা গাড়ি নেই। তবে গণপরিবহন, পণ্য পরিবহন মিলে চট্টগ্রামে থ্রি হুইলার, টেম্পু, টেঙি, হিউম্যান হলার, বাস, মিনিবাস, ট্রাক মিলিয়ে আনুমানিক ৩৫ হাজারের উপরে ফিটনেসবিহীন গাড়ি রয়েছে। যেগুলো আগে নিবন্ধিত হয়েছিল। বেশিরভাগই তিন থেকে পাঁচ বছরের মেয়াদউত্তীর্ণ।’