আমি মানুষ ছোট, বয়স ছাড়া জ্ঞান বুদ্ধি সব কিছুতেই ছোট অর্থাৎ সব কিছু বিচারে অতি সাধারণ একজন মানুষ, কিন্তু একটি বড় বিষয়ে লিখতে বসলাম।
আমি চট্টগ্রাম মুসলিম হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করি ১৯৫৯ সালে। মেট্রিক অর্থাৎ বর্তমানে এস.এস.সি এস.এস.সি. পাস ছিল সে সময়ের জন্য একটি জটিল সমস্যা। কারণ মেট্রিকের আগে পর্যন্ত অত্যন্ত মেধাবী কিছু ছাত্র ছাড়া কারো কোন মানসিক প্রস্তুতি থাকতো না, মেট্রিকের পরে কি পড়বে? অথচ এ সিদ্ধান্তের উপরে নির্ভর করতঃ সে ছাত্রটির বাকী জীবনের ভালো মন্দ।
যাই হোক, মেট্রিকের ফল বের হবার কয়েকদিন পরে মুসলিম হাই স্কুলের পার্শ্বে পশু চিকিৎসালয়ের সামনে আমার সাথে একজন বয়স্ক ব্যক্তির দেখা হয়, তার নাম ছিল জনাব নুরুল ইসলাম। মুসলিম হাইস্কুলের প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে তার সাথে আমার পরিচয় ছিল। তিনি ছিলেন সে সময়ের দৈনিক ‘আজাদ’ পত্রিকার চট্টগ্রামের প্রতিনিধি। দেখা হওয়ার সাথে সাথে সোজা প্রশ্ন করলেন- কি পড়বে? আমি তখনও কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাইনি কি পড়বো? আন্দাজী একটি জওয়াব দিলাম-কমার্স পড়বো। কি কমার্স পড়বে! তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন! যাদের লেখাপড়া শেষ করে তাড়াতাড়ি চাকরি নিয়ে ঘরে টাকা দিতে হয় তাদের কমার্স পড়তে হয়, তোমার তো ঐ তাড়া নেই, তুমি কমার্স পড়বে কেন?
শোন, শীঘ্রই চট্টগ্রামে ‘আজাদ’ পত্রিকার সমমানের একটি পত্রিকা বের হবে, তুমি আর্টস পড়, সাংবাদিক হও। ঐ কাজের জন্য ঢাকা যেতে হবে না, এখানেই যথেষ্ট কর্মসংস্থান হবে। এ কাজ খুবই সম্মানজনক পেশা। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, একাউনটেন্ট অনেক আছে, চাটগাঁয় কয়জন ভালো সাংবাদিক আছে?
উক্ত বড়জনটির কথাটিকে সেদিন কোন গুরুত্ব দিই নাই, আজ জীবনের সায়াহ্নে এসে অনুশোচনা করছি তাঁর উপদেশটিকে যদি সত্যিকারে গুরুত্ব দিতাম তাহলে হয়তো জীবনে কিছু সার্থকতার সন্ধান পেতাম যা থেকে বঞ্চিত হয়েছি।
যা হোক তার কথা সত্যে পরিণত হলো, সে বছরই দৈনিক আজাদী প্রকাশিত হলো। তবে প্রথম পর্যায়ে দৈনিক আজাদের সমমানের নয়। আসলে কোন কিছুই প্রথম পর্যায়ে তার চরম পরিপূর্ণতায় পৌঁছাতে পারে না, এটাই স্বাভাবিক।
যখন ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক সাহেবের প্রচেষ্টায় দৈনিক আজাদী প্রকাশিত হয়, তখন চট্টগ্রামের পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশনার অবস্থা মোটামুটি নাজুক।
আমার জ্ঞাতসারে চট্টগ্রামে এর আগের পত্রিকা সম্ভবত দৈনিক সৈনিক পত্রিকা। দৈনিক নাম থাকলেও পত্রিকাটি দৈনিক প্রকাশিত হতো না। প্রকাশিত হতো কালে ভদ্রে, বিশেষ প্রয়োজনে। যেমন মেট্রিকের ফল জানানোর জন্য, চট্টগ্রামে কোন ঘটনা ঘটলে। ১৯৬৫ সালে পাক ভারত যুদ্ধের সময় কতদিন প্রতিদিন বের হতো।
এরপর বিশিষ্ট সাহিত্যিক জনাব মাহবুবউল আলম সাহেব একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন, নাম- জমানা। ঐ পত্রিকা তার পরিচিতজনদের মাঝে তিনি নিজে বিলি করতেন। সদাহাস্য এ মানুষটি পরিণত বয়সেও হেঁটে হেঁটে তাঁর পত্রিকাটি তাঁর পরিচিতজনদের কাছে বিলি করতে আমরা দেখেছি।
আর চট্টগ্রামে দুইটি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশিত হতো, একটি Unity অন্যটি Eastern Examiner শেষের পত্রিকাটির কিছু কাটতি ছিল। আসলে এসব পত্রিকাগুলোর মধ্যে সত্যিকারের পত্র-পত্রিকার কোন কর্মকাণ্ড ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল পত্রিকাটির নামটি ব্যবহার করে অন্য উপায়ে কিছু আয়-উপার্জনের ব্যবস্থা করা। ইংরেজি পত্রিকাগুলোর মালিক ছিল অবাঙালি। তাদের পক্ষে বিভিন্ন সরকারি মাধ্যম থেকে পত্রিকার নামে অর্থোপার্জন ছিল সহজতর।
বর্তমানে চট্টগ্রাম শহরের আয়তন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে যদিও দৈনিক পত্রিকা সমূহের প্রচার প্রসার বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মরহুম ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক সাহেবের সাহসী পদক্ষেপকে চট্টগ্রাম শহরের প্রকৃত সাংবাদিকতার প্রথম অরুণোদয় বলা যেতে পারে। যদিও প্রাথমিক পর্যায়ে এর আকার প্রকার বর্তমানের তুলনায় কিছুটা নিষ্প্রভ ছিল। আসলে কোন বৃহৎ কর্মকাণ্ডই প্রথম পর্যায়ে অমন সমারোহপূর্ণ মনে হয় না। লক্ষ্যস্থলে পৌঁছাতে কিছু দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়। দৈনিক আজাদীর লক্ষ্যস্থলে পৌঁছার ব্যাপারে অন্যতম দৃশ্যমান সারথী ছিলেন এর এককালীন সম্পাদক প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ। প্রতিষ্ঠাতা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক সাহেবের সাথে পরিচিতির কোন সুযোগ বা সৌভাগ্য না হলেও প্রফেসর সাহেবের সাথে পরিচিত হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তিনি অত্যন্ত মিষ্টিভাষী বিনয়ী মানুষ ছিলেন। তার পিতা মৌলানা আবদুল হাই সাহেব ছিলেন, বৃটিশ যুগের বাংলা বিহার উড়িষ্যার গভর্নরের একান্ত সচিব বা প্রাইভেট সেক্রেটারী, সেই যুগের একজন বাঙালি মুসলমানের জন্য এমন পদ অলংকৃত করার সুযোগ ছিল বিরল। এমন একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সন্তান হয়ে এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করার পরে এবং পরবর্তীতে আজাদীতে সম্পাদক হিসাবে অসাধারণ প্রজ্ঞা, প্রশাসনিক মেধা ও যোগ্যতা প্রদর্শন করার পরেও ঐ সবের কিছুই তার আচার ব্যবহারে প্রতিফলিত হতো না। আচার ব্যবহারে পোশাক পরিচ্ছদে এবং চালচলনে তিনি ছিলেন দশ জনের একজন। তিনি আত্মীয়তার দিক থেকে আজাদীর প্রতিষ্ঠাতার জামাই ছিলেন। কিছুদিন কোন কলেজ অধ্যাপনা করেছিলেন বলে প্রফেসর নামে পরিচিতি হন। তার ছোট ভাই রাশেদ সাহেবের কাছে শুনেছি এক সময়ে নাকি তিনি পোশাকে পরিচ্ছদে এবং আচার ব্যবহারে বেশ সৌখিন এবং স্মার্ট ছিলেন, পরে তার পরিবর্তন হয়। দৈনিক আজাদী প্রকাশনা যদি চট্টগ্রামের পত্রিকা প্রকাশনার ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিবস হয় তবে দ্বিতীয় স্মরণীয় দিবস প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ সাহেবের “আজাদী”র সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণের দিন। এ পত্রিকাটি শুধু যে চট্টগ্রামবাসীর দুয়ারে প্রতিদিনের সংবাদ সরবরাহ করেছে তা নয়, তা চট্টগ্রামে অনেক তরুণ ও বয়স্ক লেখক সৃষ্টিতেও ভূমিকা পালন করেছে। সময়ের অমোঘ বিধানে এর প্রতিষ্ঠাতা ও অন্যতম প্রধান রূপকার দুজনই আজ পৃথিবীতে নেই। কিন্তু এখনও প্রতিদিন সারাদেশে বিশেষ করে চট্টগ্রামের শহরে-গ্রামে পাঠকদের ঘরে ‘আজাদী’ পৌঁছার সাথে সাথে তাদের স্মৃতি বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। কারণ সাফল্যের সেই উচ্চতায় তাদের সৃষ্টি এখনও অবস্থান করছে। ‘আজাদী’ তার জনপ্রিয়তার সাথে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে দুইজন মহৎ মানুষের স্মৃতি যাদেরকে এ বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিতে ‘যুগশ্রেষ্ঠ’ আখ্যায়িত করা যেতে পারে। সেই দৈনিক আজাদীকে রূপে রসে পত্র পল্লবে প্রস্ফূটিত করে চলেছেন বর্তমান সম্পাদক এম এ মালেক। তাঁর নেতৃত্বে একদল সৃজনশীল মেধাবী সাংবাদিক কাজ করে যাচ্ছেন। আমি আজাদীর জয়যাত্রার সঙ্গে নিজেকেও এগিয়ে নিতে চাই।
লেখক : প্রাবন্ধিক