কোটা সংস্কারের দাবিতে চট্টগ্রাম নগরীতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ–যুবলীগের দফায় দফায় সংঘর্ষে দুই ছাত্রসহ তিনজন মারা গেছেন। নিহতদের মধ্যে দুজন গুলিবদ্ধ ছিলেন। পুলিশসহ আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। আহতদের মধ্যে ৭৮ জন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এছাড়া দেশ জুড়ে দিনভর সংঘর্ষের মাঝে ঢাকা ও রংপুরে মারা গেছেন আরো ৩ জন। এর মধ্যে ঢাকায় মারা যান দুজন। তাদের নাম–পরিচয় জানা যায়নি। দুজনের বয়স আনুমানিক ২৫ বছর। আর রংপুরে নিহত আবু সাঈদ (২৫) রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বাদশ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বাড়ি পীরগঞ্জ উপজেলার বাবুনপুর গ্রামে। তিনি রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা আন্দোলনকারীদের একজন সমন্বয়ক ছিলেন। গতকাল মঙ্গলবার বিকাল ৩টার দিকে নগরীর মুরাদপুরে সংঘর্ষ শুরু হয়; যা দুই নম্বর গেট থেকে শুলকবহর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যা প্রায় ৬টা পর্যন্ত থেমে থেমে চলে এ সংঘর্ষ। সংঘর্ষ চলাকালে দুই নম্বর গেট, মেয়র গলি, ষোলশহর, মুরাদপুর, মোহাম্মদপুর ও শুলকবহরসহ আশেপাশের এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ সময় ছাত্রলীগের কয়েকজনের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ও দা–ছুরি দেখা গেছে। আন্দোলনকারীদের দিকে লক্ষ্য করে গুলিও ছুড়ে তারা। এছাড়া বেশ কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। লাটিসোঁটাও ছিল ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে। আন্দোলনকারীদের হাতেও ছিল লাটিসোঁটা। কয়েকজনের হাতে চাইনিজ কুড়াল ও লোহার রড দেখা গেছে।
সংঘর্ষ চলাকালে উভয় পক্ষ পরস্পরের দিকে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল ছুড়ে মারে। এ সময় বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। আতংক ছড়িয়ে পরে জিইসি থেকে বহদ্দারহাটসহ আশেপাশের এলাকায়। যান চলাচল বন্ধ থাকায় ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ লোকজন। সন্ধ্যা ৬টার দিকে আন্দোলনকারীরা চলে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে শুরু হয় যান চলাচল। সংঘর্ষ চলাকালে ঘটনাস্থলে বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকলেও তাদের অনেকটা নিরপেক্ষ অবস্থানে দেখা গেছে। তিনজন নিহত হওয়ার পর নগরে ৩ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়।
নিহতদের পরিচয় : সংঘর্ষে নিহতরা হচ্ছেন ওমরগণি এমএইএস কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র ফয়সাল আহমেদ শান্ত (২০), চট্টগ্রাম কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ওয়াসিম আকরাম (২৪) এবং ষোলশহরের ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী মো. ফারুক (৩২)। ওয়াসিম ও ফয়সাল কোটা সংস্কার আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ওয়াসিম চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটিরও সদস্য। এদিকে আহতদের মধ্যে ৩০ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে একজনের চোখ উপড়ে ফেলা হয়। ২ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আহতদের মধ্যে ১০ জন নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন। তারা সবাই মাথায় আঘাত পেয়েছেন।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন বলেন, তিনজন মারা গেছে। এর মধ্যে দুজন ছাত্র এবং একজন পথচারী। বিকাল ৪টা থেকে সাড়ে ৪টার মধ্যে এই তিনজনের মৃতদেহ হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তাদের মৃত্যু হয়েছিল। তাদের মধ্যে দুজনের মৃত্যু হয়েছে বুলেট ইনজুরিতে। আরেকজনের শরীরে ফিজিকাল অ্যাসল্টের চিহ্ন ছিল।
চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের এক চিকিৎসক আজাদীকে জানান, ওয়াসিমকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে এবং ফারুককে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আনা হয়েছিল।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (জনসংযোগ) কাজী মো. তারেক আজিজ সাংবাদিকদের বলেন, তিনজনের মধ্যে দুজনকে মুরাদপুর ও ষোলশহর এলাকা থেকে আনা হয়েছে। নিহত পথচারীর শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
সংঘর্ষের শুরু যেভাবে : গতকাল বিকাল সাড়ে ৩টায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি ছিল ষোলশহর রেলস্টেশনে। সেখানে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে তাদের জমায়েত হওয়ার কথা ছিল। তবে দুপুর ১টা থেকে নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনির নেতৃত্বে ছাত্রলীগ–যুবলীগের নেতাকর্মীরা সেখানে অবস্থান নেন। ৩টার দিকে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ ২ নম্বর গেট থেকে এবং অপর গ্রুপ মুরাদপুর থেকে মিছিল নিয়ে ষোলশহরমুখী হয়। এর মধ্যে মুরাদপুর থেকে আসা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ষোলশহর স্টেশনে পূর্ব থেকে অবস্থানরত ছাত্রলীগ–যুবলীগ কর্মীদের সংঘর্ষ শুরু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ছাত্রলীগ কর্মীরা মিছিল নিয়ে এসে মুরাদপুরে অবস্থানরত আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দিয়ে প্রথমে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। কিছুক্ষণ পর আন্দোলনকারীরা আবার জড়ো হয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এ সময় দুই গ্রুপে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়েছে। সংঘর্ষ চলাকালে আন্দোলনকারীদের দিকে ছাত্রলীগের মিছিল থেকে গুলি করা হয়।
নুরুল আজিম রনি আজাদীকে বলেন, ওদের এই আন্দোলন এখন আর কোটাবিরোধী আন্দোলন নেই। এ আন্দোলন জামায়াত–শিবিরের আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছে। আমরা ১টা থেকে স্টেশনে ছিলাম।
এদিকে দুই নম্বর গেটে নগর ছাত্রলীগের আরেকটি গ্রুপের সঙ্গে সেখানে মিছিল নিয়ে আসা আন্দোলনকারীদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। সংঘর্ষ চলাকালে নগর আওয়ামী লীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবরকে মিছিল করতে দেখা গেছে। আন্দোলনকারীদের বড় অংশ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হলেও চট্টগ্রাম কলেজ, এমইএস কলেজসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও অংশ নেন। এছাড়া মুরাদপুরে জলিল নামে কোতোয়ালী থানা যুবদলের এক নেতাকেও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দেখা গেছে। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের অভিযোগ, শিবিরের কর্মীরাও এতে অংশ নেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ভুক্ত চট্টগ্রাম বিভাগের কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সমন্বয়কারী সৈয়দ হোসেন বলেন, পুলিশের ছত্রছায়ায় আমাদের ওপর হামলা করেছে ছাত্রলীগ। আমাদের তিনজনকে হত্যা করেছে।
আন্দোলনকারী চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থী মো. ইরফান বলেন, আমরা ষোলশহরে জড়ো হতে চাইলে ছাত্রলীগ আমাদেরকে ধাওয়া দেয়। পরে মুরাদপুর মোড়ে অবস্থান নিই। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করলেও ছাত্রলীগ অস্ত্র ও ইটপাটকেল নিয়ে আমাদের ওপর আক্রমণ চালায়। তবে দাবি আদায় না করে আমরা পিছু হটব না।
সিএমপির অতিরিক্ত উপকমিশনার আশরাফুল আলম বলেন, পুলিশের কয়েকজন সদস্য আহত হয়েছেন। ঘটনায় যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আটকে পড়া ছাত্রলীগ কর্মীদের মারধর : মুরাদপুরে সংঘর্ষ চলাকালে একপর্যায়ে ছাত্রলীগের কর্মীদের একটি অংশ পিছু হটে। এ সময় ১৫/১৬ জনের একটি গ্রুপ মুরাদপুর বেলাল মসজিদের পাশের একটি ভবনে আশ্রয় নেয়। আন্দোলনকারীরা মুরাদপুরে অবস্থান নিলে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন ছাত্রলীগের কর্মীরা। অবরুদ্ধ থাকা ছাত্রলীগ কর্মীরা ভবনটির ছাদ থেকে ইট নিক্ষেপ করলে ভবনটিতে ঢুকে পড়েন আন্দোলনকারীরা। এ সময় ছাদে আশ্রয় নেওয়া ছাত্রলীগ কর্মীদের এলোপাতাড়ি মারধর করেন আন্দোলনকারীরা। কয়েকজন ভবনের রেলিং দিয়ে নামার সময় পড়ে গিয়ে আহত হন। এছাড়া কয়েকজনকে ফেলে দেন আন্দোলনকারীরা। এর মধ্যে ৫ জন গুরুতর আহত হন। তাদেরকে কাতালগঞ্জে একটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে চারজনের নাম পাওয়া গেছে। তারা হচ্ছেন জোবায়ের, শ্রাবণ, মেহেদী ও সোহেল।
নুরুল আজিম রনি অভিযোগ করে বলেন, ভবনটিতে ছাত্রলীগ কর্মীরা দুই ঘণ্টা আটকে ছিল। পুলিশকে বলার পরও উদ্ধার করেনি।
ছয় ভবনে ভাঙচুর : মুরাদপুর সিএসটিসি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের পাশে ছয়টি ভবনে আন্দোলনকারীদের ভাঙচুর করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই এলাকায় রয়েছে ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতার বাসা। তার বাসা খুঁজতে গিয়ে ছয় ভবনে ঢুকে ভাঙচুর করার অভিযোগ করা হয়।
মোহাম্মদপুরও রণক্ষেত্র : বিকাল ৪টা ২৫ মিনিটে শুলকবহর বারকোড রেস্টুরেন্টের সামনে মিছিল নিয়ে জড়ো হন কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা। এ সময় মোহাম্মদপুর মাজার রোডের মুখে অবস্থানরত ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ কর্মীদের ধাওয়া দেন তারা। আন্দোলনকারীদের হাতে ছিল লাঠিসোটা ও ইট। এক পর্যায়ে তারা মাজার রোডে ঢুকে পড়েন এবং ইট ছুড়তে থাকেন। এতে পিছু হটেন ছাত্রলীগ–স্বেচ্ছাসেবক লীগ কর্মীরা। প্রায় ১০ মিনিট অবস্থান করে মুরাদপুরের দিকে চলে যান আন্দোলনকারীরা। ৫টার দিকে আবার আসেন তারা। মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে অবস্থানরত ছাত্রলীগ কর্মীদের সাথে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয় আন্দোলনকারীদের। এ সময় রণক্ষেত্রে পরিণত হয় মোহাম্মদপুর এলাকা।
বিজিবি মোতায়েন : তিনজনের প্রাণহানির পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে চট্টগ্রামে ৩ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। বিকাল থেকে নগরের বিভিন্ন সড়কে টহল দেয় বিজিবি।
বিজিবি চট্টগ্রাম–৮ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল শাহেদ মিনহাজ ছিদ্দিকী বলেন, চট্টগ্রামে ৩ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। মুরাদপুর, অঙিজেন ও পাহাড়তলী এলাকায় বিজিবি সদস্যরা গাড়ি নিয়ে টহল দিচ্ছে।