আজ চট্টগ্রামে গ্রুপ থিয়েটার চর্চার পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হলো। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম ক্লাব মিলনায়তনে ‘থিয়েটার–৭৩’ নাট্যদলের ‘ম্যসাকার’ ও ‘স্পার্টাকাস বিষয়ক জটিলতা’ নাটক দুটি মঞ্চায়নের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল এ–নগরীর আনুষ্ঠানিক গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন। উন্মেষকালে সম্পূর্ণ প্রতিকূল বাস্তবতায় যুদ্ধফেরত স্বপ্নতাড়িত তরুণরা গ্রুপ থিয়েটারের আশ্রয়ে উন্মোচন করেছিল নাটকের একখন্ড বন্ধুর ভূমি। কালের বর্তমান প্রান্তে এসে পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়– শস্যপূর্ণ বিস্তৃত এক নাটকের মাঠ। সহস্র নাট্যপ্রেমিকের অজস্র দিবসের অক্লান্ত শ্রমে–ঘামে, বিশুদ্ধ প্রেমে সেখানে বেড়ে উঠেছে কাঙ্ক্ষিত মহীরুহ।
সম্পূর্ণ বৈরী–পরিস্থিতিতে শুরু হয়েছিল গ্রুপ থিয়েটার চর্চা। সেন্সরের বাধা, প্রমোদ করের বোঝা– সেই সাথে নাট্যমঞ্চ, আলোক–সরঞ্জামসহ প্রযোজনা–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন উপকরণের ছিল তীব্র সংকট। সবচেয়ে বড় সংকট ছিল নাট্য–উপযোগী মিলনায়তনের। কিন্তু সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্তির আনন্দ ও নতুন ভাবনায় উজ্জীবিত তৎকালীন তরুণ নাট্যকর্মীরা বিরাজমান এ–সব অভাব বা সংকটে দমে যাননি বরং সৃষ্টির বেদনা ও আনন্দে আত্মহারা তরুণরা আবিষ্কার করেছে নতুন নাট্যসড়ক। চট্টগ্রাম ক্লাব, সেন্ট স্কলাসটিকা হল, সেন্ট মেরিস হল, সেন্ট প্ল্যাসিডস হল, চট্টগ্রাম আমেরিকান সেন্টার হল, সিঅ্যান্ডবি হল, বন্দর রিপাবলিক হল প্রভৃতি নাট্য অনুপযোগী মিলনায়তন এ সময়ে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে নাট্যকর্র্মীর কোলাহলে। সত্তরের দশকে চট্টগ্রামে শহরকেন্দ্রিক বিক্ষিপ্ত নাট্যচর্চায় স্থিতি আসে ‘চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তন’ প্রতিষ্ঠার পর। প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পর থেকেই মিলনায়তনটি চট্টগ্রামের গ্রুপ থিয়েটার চর্চার প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
গত পঞ্চাশ বছরে চট্টগ্রামের নাটক বিকশিত হয়েছে বহুমাত্রিক বিষয় ও আঙ্গিককে অবলম্বন করে। তবে, প্রধান বিষয় হিসাবে প্রতিবাদ–প্রতিরোধ চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গজনিত বেদনা, যুদ্ধের শত্রুমিত্র চিহ্নিতকরণ, সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার স্বরূপ, সেই সাথে সমসাময়িক সমাজজীবনের নানা সংকট, ব্যক্তির যাপিত জীবনের যন্ত্রণা, দ্বন্দ্ব–বিক্ষুদ্ধ সংগ্রামী মানুষের জীবন ও জীবন–সংগ্রাম প্রভৃতি বিষয় ঘুরে ফিরে এসেছে। দ্বন্দ্ব–বিক্ষুদ্ধ জীবনের জটিল জিজ্ঞাসাকে নাট্যকর্মীরা তুলে আনতে চেষ্টা করেছে মঞ্চের মুকুরে। গ্রুপ থিয়েটারভিত্তিক নাট্যান্দোলনের ফলে যেসব নাটক রচিত হয়েছে তার সবগুলোতেই সময়ের ক্ষত, ব্যক্তির স্খলন, মূল্যবোধের অবক্ষয়, সমাজের রূঢ় বাস্তবতার স্বরূপ প্রকাশিত হয়েছে। যে দ্বন্দ্ববিক্ষুব্ধ সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষ জীবন–যাপন করেছে, সে রূঢ়–বাস্তব জীবনের রূপ নাট্যকাররা ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন মঞ্চের ক্যানভাসে। কখনো মৌলিক সৃজনে, কখনো অনুবাদ রূপান্তরে, গল্পের নাট্যরূপ, লোককথার পুনর্নির্মাণ প্রভৃতি প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে সৃষ্ট চট্টগ্রামের গত পাঁচ দশকের নাট্যসাহিত্য আজ স্বতন্ত্র সাহিত্যশাখা হিসেবে চিহ্নিত হবার যোগ্য।
বিশ শতকের আশির দশকে স্বৈরাচার ও সামপ্রদায়িকতার তুমুল উত্থান, রাষ্ট্রের অব্যবস্থা, রাজনৈতিক অস্থিরতা আর স্বাধীনতার সপক্ষীয় শক্তির প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে বিস্তর ব্যবধানজনিত কারণে সমগ্রদেশের মতো চট্টগ্রামের নাট্যকর্মীরাও নতুন ভাবনায় উদ্দীপিত হন। রাজনৈতিক সংকট, নেতাকর্মীদের মিথ্যা আশ্বাস, রাষ্ট্রযন্ত্রের ঔদাসীন্য, মূল্যবোধের অবক্ষয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিকৃতি, মুক্তিযুদ্ধে বিপক্ষীয় শক্তি ও এ–দেশীয় দোসরদের আস্ফালন প্রভৃতি নেতিবাচক ঘটনা ও পরিস্থিতি চট্টগ্রামের নাট্যকর্মীদের মনে তুমুল ক্ষোভের সঞ্চার করে। বিরাজমান সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রতিবাদের ভাষা হিসাবে তরুণরা নাটককে অবলম্বন করেছেন। আশির দশক এবং এরপর চট্টগ্রামের নাট্যসাহিত্যে যুক্ত হয় প্রবল দ্রোহীচেতনা। আমাদের জাতীয় জীবন ও সমকালীন সমাজ বাস্তবতার অনুপুঙ্খ নাট্যভাষ্য হিসেবে নাটকগুলো বিশ্বস্ত শিল্পসাক্ষী।
চট্টগ্রামের নাট্যাঙ্গনের যাত্রাপথ কখনোই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। এখনও অজস্র প্রতিকূলতার মধ্যদিয়ে অতিক্রম করেছে চট্টগ্রামের নাট্যাঙ্গন। চট্টগ্রামের নাট্যচর্চাকে বলা যায় স্রোতের বিপরীতে নৌকা বেয়ে যাওয়া। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে– দর্শকস্বল্পতা। দর্শক দিন দিন কমতির দিকে। দর্শক স্বল্পতার কারণে অনেক ভালো প্রযোজনা এখানে অল্প কয়েকটি প্রদর্শনীর পরই বন্ধ হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যলয়ের সাথে নাট্যাঙ্গনের স্থানিক দূরত্বের কারণে বিপুল দর্শক এবং নাট্যকর্মী প্রাপ্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় নাট্যদলগুলো। দলের সদস্যদের পেশাসন্ধানে ঢাকামুখীনতার কারণে প্রতিটি নাট্যদলে অভিজ্ঞকর্মীর সংকট প্রতিনিয়ত লেগেই থাকে। বিদেশি আর্থিক আনুকূল্যে নাট্যান্দোলনের নামে উন্নয়নবাদী ইস্যুভিত্তিক প্রকল্প ও এজেন্ডা বাস্তবায়নের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নাট্যবিকাশে বড় অন্তরায় হয়ে উঠেছে। এসব সংস্থার ফরমায়েশি নাটক নির্মাণের সাথে আর্থিক যোগ থাকায় কমিটেড কর্মীরাও ক্রমশ সেদিকে ঝুঁকছে। ফলত, দল হারাচ্ছে শ্রমে ঘামে গড়ে ওঠা মুল্যবান নাট্যকর্মী। নাট্যসংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়, যেমন– পোশাক প্রস্তুতকারক, সেটনির্মাণ, অঙ্গরচনা, আলোক–আবহ সহ নাটকের কারিগরি কর্ম নির্বাহের জন্য লোকবলের তীব্র অভাব সুষম নাট্যবিকাশে অন্যতম অন্তরায়। এখানে নেই প্রচারের আনুকূল্য। চট্টগ্রামের প্রিন্টমিডিয়াগুলোতে নাটকের সংবাদ থাকে প্রায় উপেক্ষিত। চট্টগ্রামের নাটক নিয়ে স্থানীয় ও জাতীয় প্রচারমাধ্যমগুলোর উন্নাসিকতার কারণে চট্টগ্রামের নাট্যাঙ্গনের স্বাতন্ত্র্য, বহুমাত্রিকতা ও অর্জনগুলো রয়ে গেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। চট্টগ্রামের নাট্যাঙ্গনে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা যৎসামান্য। কিছু বাছাই করা নাট্যদল এবং ব্যক্তিগত পরিচয়ের মধ্যে সরকারি অনুদান সীমাবদ্ধ থাকে। এতে পুরো নাট্যাঙ্গন কোনোভাবেই উপকৃত হয় না। বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কিছুটা আর্থিক সহযোগিতা পাওয়া গেলেও সামপ্রতিক সময়ে অনেক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় ঢাকায় স্থানান্তরের কারণে সে–সহযোগিতাও কমতে শুরু করেছে চট্টগ্রামের নাট্যাঙ্গনে। মিলনায়তন মহড়াকক্ষ ও আলোক সরঞ্জাম বাবত অত্যধিক ব্যয়ের কারণে নাট্যদলগুলোর আর্থিক ঝুঁকিও ক্রমশ বাড়ছে। চট্টগ্রামের নাট্যচর্চার সংকটগুলি আলোচনা করলে দেখা যায়– মেধাবী নেতৃত্বের অভাব একটি বড় সংকট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। মেধাবী নেতৃত্বের সংকটের কারণে চট্টগ্রামের থিয়েটার অনেক সময় দাঁড়িয়ে যায় বিভ্রান্তি ও মালিন্যের মুখোমুখি।
সকল প্রকার প্রতিকূলতা বা নেতিবাচক পরিস্থিতিকে মেনে নিয়েও বলা যায়, নাট্যসংস্কৃতি বিকাশের জন্য চট্টগ্রাম শহর একটি আদর্শস্থান। সত্তর দশকে দশটি নাটকের দল নাট্যাঙ্গনের যে ভিত রচনা করেছিল তার উপর দাঁড়িয়ে গত পঞ্চাশ বছরে আশির অধিক নাট্যসংগঠন তাদের সৃজনশীলতার পরিচয় তুলে ধরেছে। এখনো সক্রিয়ভাবে সৃজন–চিন্তনে যুক্ত আছে পঁয়ত্রিশে অধিক নাট্যদল। এটা সম্ভব হয়েছে তারুণ্যের স্বপ্ন ও অনমনীয় চেতনার কারণে। চট্টগ্রামের নাট্যাঙ্গনের মূল শক্তি আর প্রধান বৈশিষ্ট্যই হল তারুণ্য। এখানকার প্রতিটি নাট্যকর্মী দ্রোহীসত্তার অধিকারী। প্রথাগত নাট্যচিন্তাকে উপেক্ষা করার মানসিকতাও তাঁদের প্রবল। এখানে প্রতিটি নাট্যকর্মী সম্পূর্ণ মঞ্চমুখী। রাজধানীর উচ্চকিত প্রচন্ডতা, লোভ–মোহ আর উত্তাপের বাইরে নিজস্ব এক মেজাজ নিয়ে নীরব তপস্যার মতো চলে চট্টগ্রামে থিয়েটার চর্চা। এখানে প্রচারের প্রবল আতিশয্য নেই, নেই ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দৌরাত্ম্য। ফলত, চট্টগ্রামের নাট্যকর্মীরা অনেকটা মোহমুক্ত, সুস্থির ও পরিপূর্ণ মঞ্চমুখী। নির্মোহ মানসিকতা আর থিয়েটারের প্রতি অপরিমেয় ভালোবাসায় এখানে প্রতিটি নাট্যকর্মী সমর্পিত হয়েছে নাট্যচর্চায়। সামাজিক দায়বদ্ধতা, শিল্পের প্রতি অঙ্গীকার আর মানসিক প্রশান্তি ছাড়া নগদ কিছু পাওয়ার সুযোগ নেই, তাই শীর্ষে যাবার ইঁদুরদৌড়ে নাম না লিখিয়ে থিয়েটারের প্রতি অপরিমেয় ভালোবাসায় চট্টগ্রামের নাট্যকর্মীরা মঞ্চচর্চায় নিবেদিত। প্রতিভাবান তরুণ নাট্যকর্মীরা নিষ্ঠা আর একাগ্রতায় আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এখানে একটি সমৃদ্ধ থিয়েটার সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য। চট্টগ্রামে নাট্যপ্রযোজনার ধরণ এখন অনেক বেশি শিল্পমানসমৃদ্ধ, আধুনিক ও গতিশীল। নাটকের সেট–আলো–আবহ–পোশাক এখন অনেক বেশি যৌক্তিক ও অর্থময়। চট্টগ্রামে নাট্যপ্রয়োগে পরীক্ষা–নিরীক্ষা ও সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে উন্মোচন করেছে নতুন সম্ভাবনা। খুব সূক্ষ্মভাবে দেখলে অনুধাবন করা যায়, চট্টগ্রামের নাট্যাঙ্গন জাতীয় গন্ডি পেরিয়ে ধীরে ধীরে গড়ে তুলছে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ। বিদেশি নাট্যদলের চট্টগ্রামে আগমন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের নাট্যদল ও নাট্যকর্মীদের অংশগ্রহণ ক্রমশ বাড়ছে। এটা আমাদের প্রবলভাবে আশান্বিত করে।
চট্টগ্রামে নাট্যচর্চার পঞ্চাশ বছরের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমাদের প্রত্যাশা– সকল প্রতিকূলতা ডিঙ্গিয়ে নাটক এগিয়ে যাবে। নাটক থাকবে সংঘবদ্ধ মানুষের সম্মিলিত চেতনায়– দ্রোহে, প্রতিবাদে, স্বতঃস্ফূর্ত যৌথ উচ্চারণে। নাটক থাকবে অনমনীয় তারুণ্যের অসংকোচ উচ্ছ্বাসে। আগামীর নাটক আরও বিপুল আয়তনে, অনিবার্য শিল্পশক্তি হিসাবে চর্চিত হবে বৃহত্তর পরিসরে– মিলনায়তনে, মঞ্চে ও ময়দানে।