চট্টগ্রামে এক মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত বেড়েছে ৫ গুণ

জুলাইয়ের দুদিনেই আক্রান্ত ৯১ জন২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৫৫ রোগী শনাক্ত চমেক হাসপাতালে আলাদা ওয়ার্ডে চিকিৎসা দরকার, স্থান সংকটে হচ্ছে না

রতন বড়ুয়া | সোমবার , ৩ জুলাই, ২০২৩ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

এবার একটু আগেই ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয়েছে চট্টগ্রামে। গত বছর মধ্য আগস্টে প্রকোপ দেখা দিলেও এবার তা শুরু হয়েছে জুনের আগে। দিন দিন ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েই চলেছে। এক মাসের ব্যবধানে চট্টগ্রামে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে পাঁচ গুণেরও বেশি। গত মে মাসে মহানগরসহ চট্টগ্রাম জেলায় ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫৩ জন। জুন মাসে আক্রান্তের এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৮২ জনে। হিসেবে এক মাসের ব্যবধানে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে ৫ গুণের বেশি। সবচেয়ে বেশি মৃত্যুও হয়েছে জুন মাসে। চলতি বছর এ পর্যন্ত মোট ১০ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে চট্টগ্রামে। এর মাঝে জুনেই মৃত্যু হয়েছে ৬ জনের। তিনজনের মৃত্যু হয় জানুয়ারিতে। চলতি মাসের প্রথম দিনে মৃত্যু হয়েছে একজনের। চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে (জানুয়ারি থেকে ২ জুলাই) মহানগরসহ চট্টগ্রাম জেলায় মোট ৫৫৫ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৭৭ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২২ জন, মার্চ মাসে ১২ জন, এপ্রিলে ১৮ জন এবং মে মাসে ৫৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। সদ্য সমাপ্ত জুন মাসে সর্বোচ্চ ২৮২ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে; যা এখন পর্যন্ত এক মাসে সর্বোচ্চ।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, জুন মাসে আগের ৫ মাসের তুলনায় দেড় গুণের বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। আগের ৫ মাসে (জানুয়ারি থেকে মে) আক্রান্তের সংখ্যা ১৮২ জন। জুনে আক্রান্ত ২৮২ জন।

চলতি বছর প্রথম ৫ মাসে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দশ গুণের বেশি। গত বছর প্রথম ৫ মাসে মহানগরসহ চট্টগ্রাম জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৭ জন। আর চলতি বছর প্রথম ৫ মাসে শনাক্ত রোগীর এ সংখ্যা ১৮২ জন। গত বছরের জানুয়ারিতে ৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪ জন, মার্চে ১ জন, এপ্রিলে ৩ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছিল। আর মে মাসে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল শূন্য।

জুলাইয়ে আরো আগ্রাসী রূপে: চলতি মৌসুমে মাত্র শুরু হওয়া জুলাই মাসে আরো আগ্রাসী রূপের আভাস দিচ্ছে ডেঙ্গু। প্রথম দুদিনেই ৯১ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে চট্টগ্রামে। এর মাঝে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়েছে ৫৫ জন; যা চলতি মৌসুমে একদিনে সর্বোচ্চ। এছাড়া আগের দিন শনাক্ত হয় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩৬ জন। সর্বোচ্চ রোগী শনাক্তের পাশাপাশি জুলাইয়ের প্রথম দিনেই মৃত্যু হয়েছে আক্রান্ত একজনের।

সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য বলছে, বর্তমানে (গতকাল পর্যন্ত) মোট ৭৩ জন রোগী হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এর মাঝে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালেই ভর্তি আছেন ৩৪ জন। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ৩ জন এবং অন্যান্য হাসপাতালগুলোতে আরো ৩৬ জন রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের জেলা স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক সুজন বড়ুয়া এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

চলতি জুলাইয়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরো আগ্রাসী রূপে দেখা দিতে পারে বলে অভিমত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য বিভাগ সংশ্লিষ্টদের। অবস্থাদৃষ্টে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ২০১৯ সালের মতো হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যায়। কিন্তু এবার পুরোদমে বর্ষা নামার আগেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে শুরু করে। যা দিন দিন বাড়ছে। বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত স্বাস্থ্য বিভাগ। থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে বলে মনে করেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী। তিনি বলেন, কিছুদিন বেশ গরম পড়লেও ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে চট্টগ্রামে। থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন পাত্রে (জায়গায়) পানি জমে মশার লার্ভার সৃষ্টি হচ্ছে। যেখানে এডিশ মশার প্রজনন (বংশ বিস্তার) ঘটছে। মূলত এ কারণেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে শুরু করেছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধের অন্যতম উপায় হচ্ছে মশার লার্ভা ধ্বংস করা, এডিস মশার বংশ বিস্তার রোধ করা। মোট কথা মশা নিধন কার্যক্রম ত্বরান্বিত করা। আর মশা নিধনের এ কাজ স্বাস্থ্য বিভাগের নয়। সিটি কর্পোরেশন বিষয়টি দেখবে। স্বাস্থ্য বিভাগ মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারে।

অভিন্ন মত পোষণ করে ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশক নিধন কার্যক্রমে জোর দিতে বলেছেন চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সিটি কর্পোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রম আরো গতিশীল করতে হবে। নয়তো ঢাকা ও কঙবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মতো চট্টগ্রামেও ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

মশক নিধনে একশ দিনের ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নেয়ার কথা জানিয়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। ২২ জুন চমেক হাসপাতাল এলাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রাশ প্রোগ্রামের উদ্বোধন করেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী।

চিকিৎসা : আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়লেও ডেঙ্গুর চিকিৎসায় সার্বিক প্রস্তুতি রয়েছে জানিয়ে চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান বলেন, আমাদের চিকিৎসকনার্সরা আগে থেকেই ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছেন। তাই রোগী বাড়লেও পরিস্থিতি মোকাবেলায় শতভাগ প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে।

তিনি বলেন, আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় মেডিসিনের তিনটি ওয়ার্ডে ডেঙ্গু কর্নার করা হয়েছে। এছাড়া শিশু রোগীদের শিশু ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

এদিকে, ডেঙ্গু কর্নার করে ওয়ার্ডের এক পাশে চিকিৎসা দিলেও একই ওয়ার্ডের ভেতর হওয়ায় সাধারণ রোগীরাও থাকছেন পাশাপাশি। আর ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের সার্বক্ষণিক মশারির ভিতর থাকার কথা বলা হলেও তারা মশারির ভিতর থাকতে চান না। হাসপাতাল থেকেই মশারি সরবরাহ করা হয় ডেঙ্গু রোগীদের।

গরমসহ নানা অজুহাতে ডেঙ্গু রোগীরা মশারি তুলে রাখেন এবং বেশিরভাগ সময় মশারির বাইরে থাকেন বলে জানান চমেক হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. রাজিব পালিত। তিনি বলেন, রোগীরা সচেতন নয়। যার কারণে বারবার বললেও তারা মশারির ভিতর থাকতে চান না। এতে করে ডেঙ্গু আক্রান্তদের পাশাপাশি থাকা সাধারণ রোগীরা ডেঙ্গুতে আক্রান্তের ঝুঁকিতে পড়ছেন।

ঝুঁকির কথা স্বীকার করে চমেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুর সাত্তার আজাদীকে বলেন, ঝুঁকি তো অবশ্যই আছে। কারণ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর অবশ্যই মশারির ভিতর থাকা উচিত। শুধু হাসপাতালে নয়, ঘরে থাকলেও। নয়তো ঘরের অন্য সদস্যরাও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারেন। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে কামড়ানো কোনো মশা যাতে অন্য কাউকে কামড়াতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক থাকার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের আলাদা করে চিকিৎসা দিতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়। কিন্তু সংকটের কারণে এখানে (হাসপাতালে) তো সে সুযোগ হচ্ছে না। তাই ওয়ার্ডের ভিতর হলেও যতটুক সম্ভব ডেঙ্গু রোগীদের এক পাশে রেখে চিকিৎসা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।

আলাদা ওয়ার্ড করে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করেছেন চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসানও। কিন্তু জায়গা সংকটের কারণে হাসপাতালে আলাদা ডেঙ্গু ওয়ার্ড করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান তিনি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতেল খালাসের সর্বাধুনিক যুগে বাংলাদেশ
পরবর্তী নিবন্ধকক্সবাজারে লাখো পর্যটকের ঢল