চট্টগ্রামের সিনেমা হলে একসময় ঘণ্টা ধরে লাইন, টিকিটের জন্য কাড়াকাড়ি, মঞ্চ–পর্দার আলোতে হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা–সব মিলিয়ে সে ছিল আমাদের যৌবনের এক উন্মাদ উৎসব। শহরের নামী হলগুলো–জলসা, নূপুর, লায়ন, বনানী, খুরশীদ মহল, গুলজার, রঙ্গম–এসব নাম শুনলেই ফিরে আসে কালো–সাদা পোস্টারের ধুলো, ট্রেলার দেখে অপেক্ষার কাতরতা, আড্ডা থেকে ঝুলে থাকা গান। তখন চট্টগ্রাম শুধুই বন্দরনগরী ছিল না–সে ছিল আমাদের চলচ্চিত্রীয় স্মৃতিপুঞ্জের আবাসভূমি।
এমনি এক স্মৃতিস্রোতে ভাসিয়ে দিলে ফুটে ওঠে বেদনাদায়ক পরিসংখ্যান। এক সময়ে শহরে ২৭ বা ৩৯টি সিনেমা হল ছিল–বিভিন্ন সূত্রে বলা হয় ১৯৯০–এর দশকের দিকে এ সংখ্যা ৫০–এর গণ্ডি ছুঁয়েছিল। আজ সেই পটভূমিতে দাঁড়িয়ে দেখা যায় মাত্র ২ বা ৪টি হলে আলো জ্বলছে–এ যেন এক নিপীড়নের অ্যালবাম, যেখানে প্রতিটি পতনের পর এক টুকরো করে শহরের সাংস্কৃতিক আত্মা ক্ষয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ, যেখানে ৫০টি হলে থেকে আজ ৪টিতে নামতে সময় লেগেছে ত্রিশ বছরের কম–সেই পতন হার ৯২ শতাংশেরও বেশি। আর জাতীয় হিসাব নিলে ১২০০ হলে থেকে ২০০–র আশেপাশে নামা–এটি ৮৩ শতাংশের পতন নির্দেশ করে। এমনকি, নগরীর ২৯ কিংবা ৩৯ হল থেকে ২–৩টিতে নামা মানেই ৯৫ শতাংশ বিচ্যুতি। পরিসংখ্যানগুলো আমাদের মাথায় শুধুই সংখ্যার অভিঘাত ফেলে না–এগুলো স্মৃতি–সিঁথিয়ে আমাদের চোখ ভিজিয়ে তোলে। কারণ, হারিয়ে যাওয়া প্রতিটি হল ছিল হাজারো মানুষের প্রথম সিনেমা দেখা, প্রেমে পড়া, কিংবা পরিবার নিয়ে একসাথে সময় কাটানোর অমলিন স্মৃতি।
তাহলে কেন এ পতন? প্রশ্নটির জবাব সহজ নয়। এর পেছনে রয়েছে চলচ্চিত্র শিল্পের ভেতরের অবক্ষয়–যেখানে ‘এক টিকিটে দুই ছবি’ুর মতো অনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে অশ্লীলতার সয়লাব, মানহীন কাহিনির প্রয়োগ, নির্মাণে অনভিজ্ঞতার আধিক্য–এসব ব্যাপারে দর্শকের ভরসা হারানোর বিষয়টি অনিবার্য হয়ে ওঠে। তার ওপর যুক্ত হয় টিভি চ্যানেলের আগমন, পরবর্তী পর্যায়ে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের দাপট, স্মার্টফোনে কয়েক টাচেই সিনেমা দেখা–এ সব মিলিয়ে মানুষ আর হলে ছুটতে চায়নি। পাইরেসির ভয়াল আঙুল তো ছিলই–যেখানে মুক্তির পরদিনই সিনেমা পৌঁছে যায় ফেসবুকের অজ্ঞাত পোস্টে বা টেলিগ্রাম চ্যানেলে।
কিন্তু এ গল্পের মধ্যে সবচেয়ে মানবিক আর নির্মম দিকটি ছিল–হলের পরিবেশগত অবক্ষয়। অবহেলা, অস্বাস্থ্যকর অবস্থা, ভাঙা চেয়ার, পচা গন্ধ, বখাটে আড্ডার অনভিপ্রেত অনুপ্রবেশ–এসব মিলিয়ে পরিবারগুলো হলমুখী হতে ভয় পেত। এমনকি সবচেয়ে স্মৃতিকাতর দর্শকরাও হয়ত ভেবেছেন-“একটু আরাম হলে, হয়ত বাচ্চাকে নিয়ে আসা যেত…”। আর প্রেক্ষাগৃহ মালিকদের কাছে যখন মাসে লাখ লাখ টাকা লোকসানের ঝড় উঠতে থাকে–তখন রক্ষার চেয়ে স্বপ্ন ভেঙে ফেলার পথ হয় সহজ।
তবুও চট্টগ্রামে আলমাস, দিনার, সিনেমা প্যালেস ও পূরবী এখনো আলো জ্বালিয়ে রেখেছে। এ প্রতিটি হল যেন দাঁড়িয়ে আছে দর্শকের নস্টালজিয়া আর মালিকের অদম্য সাহসের উপর ভর করে। ঈদের মৌসুমে, কোনো ব্যতিক্রমী ছবির মুক্তিতে এই হলগুলো এখনো হাসে–কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। এক মাসে পুরো হল চালাতে খরচ হয় কয়েক লাখ টাকা–যখন প্রতিদিন মাত্র ৮০০–১০০০ টাকার টিকিট বিক্রি হয়, তখন তা শ্বাসরুদ্ধতায় টিকে থাকা বলে মনে হয় বেশি।
যেন এক প্রহরী দাঁড়িয়ে আছে এই হলগুলো–চট্টগ্রাম শহরের গল্প বলে। এরাই প্রমাণ দিয়েছে, বাকি কিছু ছবির জন্য হলেও, দর্শক এখনো হলে ফিরতে চায়। সাম্প্রতিক সময়ে ‘হাওয়া’, ‘পরাণ’, ‘দেবী’, এবং আঞ্চলিক রসে ভরপুর ‘মেইড ইন চিটাগং’–এসব ছবি আবারও মানুষকে চুম্বকের মতো টেনেছে হলে। কেউ বন্ধুদের নিয়ে এসেছে, কেউ পরিবারসমেত, কেউ এসেছে শুধু সেই নরম আলোয় কিছুক্ষণের জন্য ‘নিঃশব্দ দর্শক’ হতে। এই প্রত্যাবর্তন নগরবাসীকে মনে করিয়ে দিয়েছে–সিনেমা আসলে এখনো জীবিত, তার শেকড় এখনো মানুষের মনে জীবনের সঙ্গে গেঁথে আছে।
তাই বলা যায়, চট্টগ্রামের সিনেমা হলগুলোকে পুনর্জন্ম দিতে হলে চাই নতুন চিন্তা, বিকল্প পথ। বর্তমান সময়ের দর্শকসংস্কৃতি আয়তনে ছোট হলেও প্রয়োজনের দিক থেকে আরও বাছাই করা, আরামপ্রদ, সামাজিক ও শিল্পসম্মত পরিবেশ চায়–যেখানে সিনেমা দেখা শুধু নিছক পর্দার সামনে বসা নয়, তা হয়ে উঠবে এক সমষ্টিগত অভিজ্ঞতা, যা বন্ধুদের আড্ডার, পরিবারের মিলনমেলার কিংবা প্রেমিক–প্রেমিকার নির্জন মুহূর্তের উপলক্ষ হতে পারে। হয়ত এখন ‘বড় হল’ নয়, বরং ছোট কিন্তু আরামদায়ক বহুমুখী স্ক্রিনের আয়োজন–যেখানে পরিবার এসে একসাথে সিনেমা দেখবে, পাশেই থাকবে খাবারের দোকান, থাকবে শিশুদের খেলার ছোট জায়গা বা বই পড়ার নৈশব্দ কোণা; শহরের ব্যস্ততার ভিড়ে এ যেন এক বিশ্রামের বাতায়নও হতে পারে।
এই ধরণের মাল্টিপ্লেক্স–যেমন ঢাকার বসুন্ধরা সিটি বা যমুনা ফিউচার পার্কে দেখা যাচ্ছে, কিংবা যেমন কলকাতা, মুম্বাই বা ব্যাংককের মতো নগরীতে দিনকে দিন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে–তেমন মডেল চট্টগ্রামেও আনা যায় বেসরকারি বা সরকারি উদ্যোগে। শহরের বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলোর মাঝেই ফাঁকা জমি কিংবা পুরনো পরিত্যক্ত ভবনগুলিকে ভিত্তি করে গড়ে তোলা যেতে পারে এমন সমন্বিত বিনোদন কেন্দ্র, যার মাধ্যমে সিনেমা আবার ফিরে আসবে জীবনের কেন্দ্রে, সংস্কৃতির প্রাণে।
চলচ্চিত্র শিল্পকেও একই সঙ্গে প্রয়োজন মানসম্পন্ন রক্ষণশীল বিনিয়োগ, প্রযুক্তি হালনাগাদ, এবং গল্পের বৈচিত্র্য। আজকের প্রেক্ষিতে মনে রাখা জরুরি, বড় পর্দার যাদু কেবল রিল নয়, তা অডিও–ভিজ্যুয়াল ভাষার সৃজনশীলতার সমন্বয়; একে আধুনিক করতে হলে উচ্চ মানের সাউন্ড সিস্টেম, ডিজিটাল প্রজেকশন, নিরাপদ সিটিং, এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের খরচ স্বীকার করতে হবে। এর জন্য চাই স্থায়ী বিনিয়োগ, প্রযোজকদের মনে আত্মবিশ্বাস, আর দর্শকের আস্থা। সরকারি প্রণোদনা বা কর ছাড়, নীতিমালা সংস্কার, পাইরেসি দমন–এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা গেলে শিল্পের ভরসা ফিরবে, নির্মাতারা আবার বড় পর্দায় গল্প বুনতে সাহসী হবে, আর মানুষেরও হলে ফেরার কারণ তৈরি হবে।
একই সঙ্গে প্রয়োজন আছে বৈচিত্র্যপূর্ণ কন্টেন্টের–যেখানে থাকবে স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষার সিনেমা থেকে শুরু করে জীবনের নানা সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক, বা সামাজিক গল্প–যা মানুষকে ভাবাবে, হাসাবে, কাঁদাবে। দেশের ভিন্ন প্রান্তের অভিজ্ঞতা, প্রেম–বন্ধুত্ব–সংগ্রামের কাহিনি, কিংবা প্রযুক্তিনির্ভর এক্সপেরিমেন্টাল কাজ–সবই বড় পর্দার আবরণের তলে এক অভিনব অভিজ্ঞতা হতে পারে। ফলে প্রেক্ষাগৃহের জন্য গল্প তৈরি হবে, দর্শক তার সঙ্গে একাত্ম হবে, আর শিল্পী–নির্মাতাদের স্বপ্নও পাবে নতুন ডানা।
স্মৃতিগুলো টিকে থাকে, কারণ আমরা তাদের রাখি। টিকিটের সেই নীল পাতার স্তুপ, মিষ্টি বাক্স হাতে ‘ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো’ দেখার সেই হৃদকম্পন, হাতের ভাঁজে লুকিয়ে পোস্টারের রং মুছে যাওয়ার গন্ধ–এই আঁচলে আমরা আপন মনে বেঁচে থাকি, আমাদের শহরের সঙ্গে মিশে থাকা জীবনচর্চার শিকড় ধরে রাখি। জীবনের ধুলোমাখা সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সেই ক্ষুদ্র স্মৃতিগুলোই বড় হয়ে ওঠে, কারণ সেগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকে প্রথম প্রেম, প্রথম কান্না, প্রতিবেশীর সঙ্গে আড্ডা, কিংবা হারানো দিনের সঙ্গে পুনঃসাক্ষাৎ।
চট্টগ্রামের সিনেমা হলগুলোর জীবনী এসব আবেগের সূত্রেই গ্রথিত। জলসার সিঁড়ি বেয়ে শিউরে ওঠা উত্তেজনা, খুরশীদ মহলের লাল মেঝেতে ঠাণ্ডা বাতাসের স্পর্শ, কিংবা গুলজারের গ্যালারিতে বসে অচেনা মানুষের সঙ্গে গানের মুগ্ধতা ভাগ করে নেওয়া–এসব শুধু হল নয়, একেকটি দিনলিপি, যার পাতায় আমরা লিখেছি আমাদের শহরের জীবনঘন আবেগ। তাই তাদের বাঁচানোর প্রশ্নটি কেবল অর্থনীতি নয়–এটি একটি শহরের সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের প্রশ্ন, একটি প্রজন্মের শিকড় রক্ষার প্রশ্ন, এবং ভবিষ্যৎকে তার নিজস্ব আলোকময়তার দিকে ধাবিত করার আহ্বান।
পুনর্জন্মের আহ্বানেই যেন থামে আমাদের প্রার্থনা। চট্টগ্রামের সিনেমা হলগুলো যদি সূর্যের মতো আলো ছড়াতে চায় নতুন করে–তাহলে তার জন্য আমাদেরই হাত বাড়িয়ে দিতে হবে, আমাদেরই চাইবে শহরের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে সময়ের দাগ মুছে উজ্জ্বল রাখতে। শুধু মনে রাখলে হবে না–এই শহরের হৃদস্পন্দনে যে চলচ্চিত্র ছিল, সেই স্পন্দনকে জীবন্ত রাখার দায়িত্ব আমাদেরই। হয়ত পরের প্রজন্ম বলবে-“মা, তুমি তো জলসায় সিনেমা দেখেছিলে, তাই না?” আর মা বলে ওঠবেন, “হ্যাঁ, মুরুব্বিরা দেখেছিলেন সেই গল্প–এখন আমরাও দেখছি। কারণ, স্বপ্ন কখনো মরে না, তা শুধু নতুন আলোয় ফিরে আসে।” একদিন হয়ত কোনো নতুন মাল্টিপ্লেক্সে ‘চট্টগ্রামের গল্প’–এর প্রিমিয়ার হলে হবে–তখন তালে তাল মিলিয়ে সেই পুরনো সিনেমা হলের প্রেতাত্মারা যেন হাসবে প্রশান্ত এক হাসি, বলবে-“তোমরা ঠিকই করেছ, গল্পগুলোকে মুছে যেতে দাওনি।”









