চট্টগ্রামের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী শিবির ক্যাডার ও পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী ২২ মামলার আসামি নূর নবী ওরফে ম্যাক্সনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে কলকাতায়। কলকাতার ডানলপের নর্দার্ন পার্কে ম্যাক্সন যে বান্ধবীর সাথে অবস্থান করতেন সেই অর্পিতা পাল ম্যাক্সনের পরিবারকে জানিয়েছেন হতাশা থেকে ম্যাক্সন আত্মহত্যা করেছেন। অন্যদিকে পরিবারের সদস্যরা দাবি করছেন, তাকে খুন করা হয়েছে। গতকাল বুধবার সকাল ১০টার দিকে ভারতের দক্ষিণ কলকাতা পুলিশ স্টেশন থেকে এক কর্মকর্তা ফোন করে ম্যাক্সনের মৃত্যুর বিষয়টি জানিয়েছেন বলে জানান তার ভাই আবসার উদ্দিন। তার দাবি, ম্যাক্সনকে মদের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অজ্ঞান করে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। ম্যাক্সন নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি থানার জাহানপুর এলাকার আব্দুল লতিফের ছেলে।
জানতে চাইলে বায়েজিদ বোস্তামী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফেরদৌস জাহান বলেন, ম্যাক্সনের ভাই নুরুল আলম সকালে থানায় এসে বিষয়টি জানান। সরকারিভাবে তারা কিছুই জানেন না। তবে এক দশক আগে ম্যাক্সনসহ দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করে তোলপাড় সৃষ্টি করা নগর পুলিশের কর্মকর্তাদের কয়েকজন জানিয়েছেন, ব্যক্তিগতভাবে খোঁজ নিয়ে তারা ভারতে ম্যাক্সনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, কলকাতায় ম্যাক্সন তার কথিত বান্ধবী অর্পিতা পালের আশ্রয়ে থাকতেন তমাল চৌধুরী ছদ্মনামে। অর্পিতার বিষয়টি জানতেন ম্যাক্সনের স্ত্রী ফারজানা আক্তারও। যখনই কথা হতো ফারজানা বারবার ম্যাক্সনকে অনুরোধ করতেন অর্পিতার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে। উত্তরে ম্যাক্সন বলতেন, সরে গেলে কলকাতায় তাকে আশ্রয় দেওয়ার মতো কেউ নেই। আবার এটাও বলতেন যে, অর্পিতার ভাইয়েরা তাকে মেরে ফেলবে বলে তার ভয় হচ্ছে।
ফারজানা জানান, মঙ্গলবার শেষবার তার সাথে ম্যাক্সনের কথা হয়েছিল। ম্যাক্সন তাকে জানান, অর্পিতা টাকার জন্য বারেবারে প্রেশার দিচ্ছে। অর্পিতাকে দেওয়ার জন্য এর আগে দফায় দফায় অনেক টাকা পাঠিয়েছি, এমনকি জায়গাও বিক্রি করতে হয়েছে টাকা পাঠানোর জন্য। ফারজানা বলেন, এর কিছুক্ষণ পরই অর্পিতা কল করে জানায় টাকা না থাকার হতাশা থেকে ম্যাক্সন আত্মহত্যা করেছে। রাতে ম্যাক্সনের মোবাইলে একের পর এক ফোন করলেও কেউ রিসিভ করেনি। আজ (বুধবার) ম্যাক্সনের মোবাইলে পুনরায় ফোন করলে ওপ্রান্ত থেকে জানানো হয় তিনি কলকাতার এম আর বঙ্গুর হাসপাতালের চিকিৎসক। তার কাছ থেকেই আমরা জানতে পারি, অর্পিতা ম্যাক্সনকে হাসপাতালে রেখে পালিয়ে গেছে। হাসপাতাল থেকে অর্পিতার দেওয়া ঠিকানায় যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে দেখা যায় ঠিকানাটি ভুয়া। ফারজানা বলেন, এ থেকেই বুঝতে কষ্ট হয় না যে, ম্যাক্সন আত্মহত্যা করেনি, তাকে খুন করা হয়েছে।
গত ৭ ফেব্রুয়ারি কলকাতার ডানলপ এলাকার একটি ফ্ল্যাট থেকে ম্যাক্সনকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয়। তমাল চৌধুরী ছদ্মনামে তিনি বেশ কিছুদিন ধরেই ওই এলাকায় বসবাস করছেন। নিজেকে পরিচয় দিতেন মাছ ব্যবসায়ী হিসেবে। দালাল ধরে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে পরিচয়পত্র এবং পাসপোর্ট জোগাড় করেছেন। গ্রেপ্তারের সময় তার সঙ্গে অর্পিতা পালও ছিলেন। এ সময় ম্যাক্সনের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ বাংলাদেশি টাকা এবং মোবাইলের সিম কার্ড জব্দ করা হয়েছিল।
ম্যাক্সনের ভাই আবসার উদ্দিন জানিয়েছেন, দক্ষিণ কলকাতার এক নারীর (অর্পিতা পাল) সঙ্গে ম্যাক্সনের চুক্তিভিত্তিক বিয়ে হয়েছিল। ওই নারী বিয়ের প্রমাণপত্র আদালতে দাখিল করলে গ্রেপ্তারের তিনদিনের মধ্যেই তিনি জামিন পান। এরপর থেকে তারা একসাথে বসবাস করে আসছিলেন। সর্বশেষ মঙ্গলবার (২৯ নভেম্বর) বিকেল ৫টার দিকে ম্যাক্সন বাংলাদেশে তার ভাই আবসারকে ফোন করে জানান, তিনি ভারতের পাসপোর্ট পেলেও চুক্তিভিত্তিক বিয়ে করা অর্পিতা সেটা আটকে রেখেছে। তাকে চার লাখ টাকা দেয়ার পরও আরও আড়াই লাখ টাকার জন্য পাসপোর্ট দিচ্ছে না। সোমবার রাতে এ নিয়ে ঝগড়া হলে ম্যাক্সন অর্পিতাকে থাপ্পড় মারেন। তখন অর্পিতা বের হয়ে যায়। তিনি আরও জানান, সকাল ১০টার দিকে এক পুলিশ কর্মকর্তা আমার মোবাইলে ফোন করে বলেন, ম্যাক্সন আত্মহত্যা করেছে। তাকে বাসার ভেতর ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে। আমি ভিডিও কলে দেখি, ঝুলন্ত অবস্থায় থাকলেও পা মাটির সঙ্গে লাগানো। পুলিশ লাশ নামিয়ে অর্পিতাসহ হাসপাতালে নিয়ে যায়। তবে সে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যায়। লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়। বিকেলে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর পুলিশের পক্ষ থেকে আমাকে জানানো হয়েছে, ম্যাক্সনকে মদের সঙ্গে ১৫টি ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অজ্ঞান করে বালিশচাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে।
বায়েজিদ বোস্তামী থানাধীন জাহানপুর আলতাফ মিয়া বাড়ির আবদুল লতিফের ছেলে ম্যাক্সন। তার বিরুদ্ধে পাঁচটি অস্ত্র মামলা ও ১৭টি চাঁদাবাজির মামলা রয়েছে। ২০১১ সালে একটি ডাকাতির মামলায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ম্যাক্সনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয় আরেক শীর্স সন্ত্রাসী সারোয়ারকে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় একে–৪৭ সহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র। মূলত এরপরই আলোচনায় আসে এই সন্ত্রাসী জুটি। ওই মামলায় ২০১৭ সালে জামিন পেয়ে কাতারে পালিয়ে যান তারা। সেখানে বসেই চট্টগ্রামে চাঁদাবাজি করতেন দুজন। ২০১৯ সালেও অক্সিজেন নয়াহাট এলাকার একজন ব্যবসায়ীর থেকে চাঁদা দাবি ও হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগে ম্যাক্সনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। চাঁদার টাকার ভাগাভাগি নিয়ে সরোয়ারের সঙ্গে ম্যাক্সনের সংঘর্ষ হওয়ার পর কাতারের পুলিশ দুজনকে গ্রেপ্তার করে দেশে পাঠায়। ২০২০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সারোয়ারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তবে ম্যাক্সনের কোনো খোঁজ মেলেনি তখন। এ সময় ম্যাক্সন কাতার থেকে ভারতে পালিয়ে যান।