চট্টগ্রামের লোকগান এবং মহি-আল-ভাণ্ডারী

শামসুল আরেফীন | শুক্রবার , ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৮:৪৯ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের লোকগানের খুবই প্রাচীন শাখা লুকিয়ে আছে চর্যাপদে। পণ্ডিতদের দাবি, চর্যাপদের কয়েকজন চর্যাকার চট্টগ্রামের অধিবাসী। ৫নং চর্যার চর্যাকার চাটিল্লপাদানং সমপর্কে ড. সত্যব্রত দে চর্যাগীতি পরিচয় গ্রন্থে বলেন, ‘চাটিল চট্টগ্রামবাসী হইতে পারেন’। দশম শতাব্দীতে চট্টগ্রামের পণ্ডিত বিহারে কাহ্নপাদানং, শবরপাদানং প্রমুখ চর্যাকার অধ্যাপনা করতেন বলে অনেক গবেষকের অনুমান। এ থেকে অনুমেয়, চর্যাপদে চাটিল্লপাদানং প্রমুখ রচিত চর্যা চট্টগ্রামের লোকগানের খুবই প্রাচীন শাখা। চট্টগ্রামের লোকগানের খুবই প্রাচীন শাখা হিসেবে বারমাসী, গীতিকা বা পালাগান বা গাজির গানও উল্লেখযোগ্য। বারমাসী সমপর্কে বলতে হয়, চর্যাপদের পরে কিংবা বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে চট্টগ্রামে তা অজস্র রচিত হয়েছে। বারমাসী গীতিকার চেয়ে প্রাচীন। উদ্ভবকালে তা গীতিকাহিনী হিসেবে লম্বা আকারে রচিত হতে শুরু করে বলে এখনও লম্বাগীতি নামেও পরিচিত। তাতে একটিমাত্র কাহিনী থাকে। বাংলা বারো মাসের নামের আশ্রয়ে কাহিনী বর্ণনা করা হয়। মধ্যযুগে ও পরবর্তীকালে চট্টগ্রামে রচিত হওয়া অধিকাংশ বারমাসীতে নারীর প্রেম-বিরহকাতরতা-সাংসারিক কারণে প্রাপ্ত বেদনা ও মানসিক দুর্দশা করুণ মধুর রূপে প্রকাশিত। নীলার বারমাসী, বদিউজ্জামালের বারমাসী (আলাওল), অথ সুশীলার বারমাস (দ্বিজ মাধব), নিমাইর বারমাসী (দ্বিজ মাধব), রামের বারমাসী (দ্বিজ মাধব), প্রবাসী যুবতীর বারমাসী, জৈগুনের বারমাসী, কামিনীর বারমাসী, রাধিকার বারমাসী, বিরহিনী যুবতীর বারমাসী, ছকিনার বারমাসী, সখীর বারমাসী, সন্তীর বারমাসী, সামারোকের বারমাসী, কলির বারমাসী, গোলবানু তথা আসরক মুন্সীর বারমাসী, কন্যার বারমাসী প্রভৃতি এক্ষেত্রে উল্লেখনীয়। আঠারো-উনিশ শতকে আলী রজা ওরফে কানুফকির (১৭৫৯-১৮৩৭), উনিশ-বিশ শতকে আস্কর আলী পণ্ডিত (১৮৪৬-১৯২৭), আবদুল জলিল সিকদার (১৮৫৭-১৯৩৪), সেকান্দর গাইন (১৮৬০-১৯৪২), খাদেম আলী, মোহাম্মদ নছিম, শোকর আলী প্রমুখ দরবেশি বা আধ্যাত্মিক বিষয়, কারবালার ঘটনা, পীরের মৃত্যু, পুত্রহারা পিতার বিলাপ, শিকারের কাহিনী প্রভৃতি নিয়ে বারমাসী রচনা করে তাতে বিষয়ের পরিবর্তনে ভূমিকা রাখেন।
বারমাসী, গীতিকা বা পালাগান বা গাজির গানের পথ ধরে পরবর্তীকালে চট্টগ্রামে আরও অনেক প্রকারের গান রচিত হয়েছে। যেমন, হঁঅলা, মাইজভাণ্ডারী গান, জাহাঁগিরি সঙ্গীত, জারি গান বা মর্সিয়া, কীর্তন, হাইল্যা সাইর, পাইন্যা সাইর, ফুলপাঠ গান, হালদাফাডা গান, গোরব পোয়ার গান, চাডগাঁইয়া গান, কবিগান প্রভৃতি।
আলোচ্য সৈয়দ মহিউদ্দিন, প্রকাশ মহি-আল-ভাণ্ডারী বিশেষ করে চাডগাঁইয়া গানের রচক। বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে গান রচনায় রত হয়ে আজ অব্দি অনেক চাডগাঁইয়া গান রচনা করেছেন। এসব গান রচনায় ও এসব গানে সুরারোপে তিনি বেশ আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছেন। চাডগাঁইয়া গান বহুকাল ধরে অবহেলিত ছিল। শিক্ষিত ও বোদ্ধা সমাজ মনে করতো তা শোনার উপযুক্ত নয়। চাডগাঁইয়া গান যারা শুনতো তাদেরকেও নিম্নশ্রেণির লোক বিবেচনা করা হতো। এর কারণও ছিল বৈকি। তখনকার চাডগাঁইয়া গানের অধিকাংশতেই ছিল বিকৃত রুচি ও অশ্লীলতা। এখনও কালে-ভদ্রে এ-ধরনের গানের দেখা মেলে। সাম্প্রতিককালে এরকম একটি গান শুনেছি, যেখানে দেবর কর্তৃক খুবই বিশ্রিভাবে ভাবিকে সরাসরি শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। গানটিতে এই কু-প্রস্তাব প্রদানের পূর্বে দেবরের বক্তব্য:
আজিয়াত ব’দ্দিন অর বদ্দা ঘরত নাই,
ক্যান গরি আছ ভাবি মনরে বুঝাই।

চাডগাঁইয়া গানকে বিকৃত রুচি ও অশ্লীলতা থেকে মুক্তি দিয়ে সর্বমহলের শ্রবণের উপযোগী করার জন্য একটা সময়ে এসে অনেক কণ্ঠশিল্পী ও গীতিকার কাজ করেছেন। কণ্ঠশিল্পীদের মধ্যে শেফালী ঘোষ ও শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব এবং গীতিকারদের মধ্যে মলয় ঘোষ দস্তিদার, অচিন্ত্যকুমার চক্রবর্তী, মোহনলাল দাস, এম এন আখতার, আবদুল গফুর হালীর নাম অগ্রে। সৈয়দ মহিউদ্দিন গান রচনা করতে এসে ১৯৮০-র দশকে এই কাজে যুক্ত হন। এখানে উল্লেখ্য, চাডগাঁইয়া গানকে বিকৃত রুচি ও অশ্লীলতা মুক্ত করে সর্বমহলের শোনার উপযোগী করতে এসব কণ্ঠশিল্পী ও গীতিকার মূল ভূমিকা পালন করলেও তাঁদের পূর্বে কবিয়াল রমেশ শীল-সহ কতিপয় কবিয়ালের রুচিশীল চাডগাঁইয়া গান রচনার কথা স্মরণযোগ্য। যা হোক, সৈয়দ মহিউদ্দিন গান রচনা করতে এসে চাডগাঁইয়া গানকে বিকৃত রুচি ও অশ্লীলতা মুক্ত করার কাজেই শুধু যুক্ত ছিলেন না, তিনি তাতে শব্দ-বাক্য-ছন্দ প্রয়োগে দারুণ সচেতনতা, দক্ষতা ও আধুনিক মন-মনস্কতার পরিচয় দিয়েছেন। এছাড়া সময় সম্পর্কে সচেতন থেকে চাডগাঁইয়া গানে সমকালীন প্রেক্ষাপট ও সামাজিক বাস্তবধর্মী ঘটনা উপস্থাপন করে তাতে বিষয় পরিবর্তনের চেষ্টাও করেছেন।
তাঁর পূর্বে কবিয়াল রমেশ শীল, ফণী বড়ুয়া, মনিন্দ্র দাস, এয়াকুব আলীরাও এই চেষ্টা কিছুটা করেছিলেন। তবে একথা না বললেই নয় যে, অতীত ও বর্তমানের চাডগাঁইয়া গানের অধিকাংশ গীতিকারের নজর এদিকে পড়েনি বললেই চলে। তাঁরা গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে নর-নারীর প্রেম ও অলৌকিকত্বকে উপজীব্য করেই এই গান রচনা করেছেন, এখনও করছেন। সৈয়দ মহিউদ্দিন দীর্ঘকাল ধরে পরিকল্পিতভাবে উল্লেখিত চেষ্টা চালিয়ে সফল হয়েছেন বলা যায়। ফলে এসব গীতিকার এবং সৈয়দ মহিউদ্দিনের মধ্যে এখানে বিশাল পার্থক্য ঘটে গেছে। এখানে সৈয়দ মহিউদ্দিন অভিনব, আলাদা বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল, নতুন ইতিহাসের নির্মাতা।

দুই.
সময়, সমকালীন প্রেক্ষাপট এবং সামাজিক বাস্তবধর্মী ঘটনা প্রভৃতি উপস্থাপন করার কারণে সৈয়দ মহিউদ্দিন রচিত অনেক চাডগাঁইয়া গান ব্যাপক জনপ্রিয় ও কালজয়ী। যেমন, অ জেডা ফইরার বাপ, আঁর বাপর বাড়ি কধুরখীল, আঁর বউয়রে আঁই হাসাইয়ম, আসকার ডিঁইর পূকপাড়ে আঁর ভাঙা ছোরা ঘর, পোয়ার মনত শান্তি নাই শান্তি নাই ভাত পানি ন খার, সাম্পান মাঝি সাম্পান বায় আগর মত পেসিঞ্জার ন পায়, মেজ্যান দিএ মেজ্যান দিএ ঐতারত, অউডা কঅছাই ভাইপুত ক্যেনে ম্যেট্টিক পাশ গল্লি, আঁরা এই সংসারত মিলিমিশি আছি দু’য়া জাল হায়রে প্রভৃতি। ‘অ জেডা ফইরার বাপ’ গানে একালের গ্রামীণ জনপদের এক লোভী, কপট, অত্যাচারি, জুলুমবাজ লোকের নিখুঁত চরিত্র অঙ্কন করা হয়েছে। এই লোক গাভী থেকে দুধ দোহনের সময় বালতিতে পানি রাখে; অন্যজনের খেতের উপর দিয়ে অনায়াসে হাঁটে, কিন্তু নিজের খেতের উপর দিয়ে কেউ হাঁটলে গালি দেয়; নিজের ক্ষেতে বেগুন-মরিচ-কধু ধরলেও অন্যজনের ক্ষেতের কধু চুরি করে।

অ জেডা ফইরার বাপ
অ জেডা ফইরার বাপ
একদিন বুঝিবা জেডা একদিন বুঝিবা।
ক্ষেতর উদ্ধি কোণা কুইন্যা আর কতদিন হাডিবা,
তোঁয়ার ক্ষেতদি কেয় হাডিলে হেঁত্তে ওয়া গাইল দিবা।

হারা বছর গরু ছঅল এদ্দি এদ্দি পালিলা,
বাঁধি বুল্যাই কইলে জেডা ভেটকাই ভেটকাই হাসিলা,
হাসি হাসি জোলম গরি বটতলে তুঁই কি নিবা?

বালতির ভুতুর পানি রাখি দুধ দোয়াইতা জঅ,
এক বালতি দুধ গাইএ দিএ মাইনচুরে বুঝঅ,
এই পাইন্যা দুধুর বেচা টেঁয়া কন সন্দুখুত রাখিবা?

তোঁয়ারঅ ক্ষেতত বাইউন মরিচ কধু ধরে জানি,
ঢাগর ক্ষেতর কধু কিল্যাই ঠেংগে ছিঁড় টানি,
হেই পরর জিনিস ভার পুরাই লই নিজুর উয়াইর পুরাইবা।

তোঁয়ার বাপ ভাই আইন-ত মাইনচে কয় বউত তরবিয়ত,
তুঁই কত্তুন পাইলা জেডা এইল্যা কু খাছিয়ত,
গোডা জীবন কাডাই দিলা হালাল কঁত্তে চিনিবা?

‘আঁর বাপর বাড়ি কধুরখীল’ গানে একালের গ্রামের এক গৃহবধূর দুঃখের কথা বর্ণিত। কধুরখীল গ্রামটি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলায় অবস্থিত। এই গৃহবধূর ‘জামাই’ (স্বামী) ‘কুজারা’ (ভীষণ অসৎ), তবে তার ‘হউরু (শ্বশুর) গোষ্ঠীর মানুষ ভালা’। জামাই এই গৃহবধূকে বলে ‘খাতুনগঞ্জত গরে বোখারি’ (খাতুনগঞ্জে ব্যবসায়ীদের সাথে মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে কাজ করে), কিন্তু আসলে সে ‘চোরাকারবারির পিছু দি পেতি কারবারি’ (চোরাকারবারিদের সহযোগী)। সে তেমন ঘরে থাকে না। মাঝে-মধ্যে এসে কয়টি টাকা দিয়ে গেলেও তাতে গৃহবধূর চলে না। ফলে সারা বছর তাকে ঋণগ্রস্ত থাকতে হয়। এর মধ্যে বড়ো ঝামেলা হলো ‘ঘন ঘন পুলিশ আইয়ে (আসে) তারে তোয়াইতু (জামাইকে খুঁজতে)’। গৃহবধূ ভাবে, তার জামাই-সহ চোরাকারবারিরা দেশ ও জাতির শত্রু, তারা ‘দেশর বুগুত (বুকে) কুরুইল (কুড়াল) মারে’।

আঁর বাপর বাড়ি কধুরখীল হউরু বাড়ি গুজারা,
হউরু গোষ্ঠীর মানুষ ভালা কেবল জামাই কুজারা।

মাসকাবারি তিন্নান দিনঅ ঘরত ন থাকে,
আথিক্যা আই টেঁয়া কউয়া দি যায় গই ফাঁকে,
তারপর খবর ন রাখে,
ঊনা ভাতে ডাইলুর পানি হাইঙ্গা বছর রাইখ্যে আঁরে ধারে কয্যে উধারা।

আঁরে কয়যে খাতুনগঞ্জত গরে বোখারি,
কেঅন এক্যান মিছা কথা বউল্যগে বাটপারি,
আসলে তে চোরাকারবারির পিছু দ পেতি কারবারি।

পুলিশ আইএ তারে তোয়াইতু,
শান্তি পাইতাম ধরি যদি বাঁধি লই যাইতু,
পিডি নলা ভাঁই দিতু,
চোরা কারবার যারা গরে দেশর বুগুত কুরুইল মারে
হক কথা কই মইত্যে রাজি জাতর দুশমন ইতারা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅনুসূর্যকে লেখা রূপকথারা
পরবর্তী নিবন্ধসুবিধাবঞ্চিত নারীদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে