চট্টগ্রামের লোকগান সমৃদ্ধি অর্জনের পথে লোককবিদের অবদান অনস্বীকার্য। মূলত এই অঞ্চলের লোককবিদের অপার সৃষ্টিকর্মই লোকগানের ভাণ্ডারকে পূর্ণতা দিয়েছে। আস্কর আলী পণ্ডিত ,সেকান্দার গাইন, খয়েরজ্জমা, রমেশ শীল ,আবদুল হাদী কাঞ্চনপুরী, আবদুল গণি কাঞ্চনপুরী, আবুল খায়ের, মুন্সী আমিন শরীফ, আবদুল জলিল সিকদার, আবদুল লতিফ শাহ, এয়াকুব আলী, ফণি বড়ুয়া, সরকার মণীন্দ্র দাস, করিম বখসু, মোহাম্মদ সৈয়দ, মকবুল আহমদ পণ্ডিত, আবদুল গফুর হালী প্রমুখ লোককবি চট্টগ্রামের লোকসংস্কৃতিকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত করেছেন। রমেশ শীল, আস্কর আলী পণ্ডিত, আবদুল গফুর হালী ও সিরাজুল ইসলাম আজাদ এই চার জন চট্টগ্রামের লোককবিদের এই আলোচনায় থাকবে না। কারণ পরবর্তী পরিচ্ছেদগুলোতে উল্লিখিত এই লোককবিদের সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করা হবে।
আলী রজা কানুফকির ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশে ১৮শ শতকের অন্যতম ইসলাম প্রচারক ও আধ্যাত্মিক সুফি কবি। ছত্রিশ বছর অরণ্য সাধনায় সিদ্ধ হবার কারণে হযরত শাহ সুফি আলী রজা সাধারণের নিকট কানুফকির হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার ওষখাইন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ১৩ বছর বয়সে পিতা মৃত্যুবরণ করেন। একসময় দীর্ঘ ৩৬ বছর অরণ্য সাধনা শেষে আলী রজা কানুফকির পুনরায় নিজ গ্রামে ফিরে আসেন। ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে আলী রজা কানুফকির মৃত্যুবরণ করেন।
আলী রজা একজন মুসলিম সাহিত্যিকও বটে। তাঁর রচিত অনেক আধ্যাত্মিক গ্রন্থ তাঁর উত্তরসূরিদের কাছে সংরক্ষিত আছে। তিনি তাসাউফের উপর দেবনগরী, বাংলা, ফার্সি, উর্দু, আরবি ভাষায় গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর রচিত মারফতি গানের সংখ্যা প্রায় সাত শত। ‘সিরাজ কুলুব’, ‘জ্ঞানসাগর’ ,‘আগম’ ,‘ধ্যানমালা’, ’যোগকালন্দর’ এবং ‘ষষ্টচক্রভেদ’ তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্য কর্ম। আলী রজা অনেক পদও রচনা করেছিলেন। ড. আহমদ শরীফ কর্তৃক সম্পাদিত মুসলিম কবির পদসাহিত্য গ্রন্থে তাঁর বত্রিশটি পদ সংকলিত হয়েছে।
বাংলাদেশের লোকসংগীত সাধারণত দু’ভাগে বিভক্ত:
১.লোকধর্মনির্ভর সাধনসংগীত
২.লৌকিক জীবননির্ভর সাধারণ সংগীত
আলী রজা কানুফকির লোকধর্মনির্ভর সাধনসংগীত রচনায় কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তাঁর রচিত প্রায় গানেই অধ্যাত্মবাদের প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। যেমন:
আলো ভবের মাঝেরে –
কানুর মন মজিলরে
চল কানু এবে দেশে যাই
কোথায় আছিলা মন,কোথায় তোমার সিংহাসন
কোথায় থাকি দিলা দরশন।
মুসলিম দরবেশ হলেও হিন্দু ধর্ম বা দর্শন সম্পর্কে তাঁর অগাধ জ্ঞান ছিল। হিন্দু –দর্শনের বিভিন্ন দিক তাঁর গানে পাওয়া যায়। আগম, নিগম, যোগ–দর্শন ইত্যাদি বিষয় গুলো গানে উল্লেখ দেখে বুঝা যায় পঠন–পাঠনে আলী রজা কানুফকির ছিলেন গভীর মনযোগী।
শূন্যেতে পরম হংস শূন্য ব্রর্ম্ম জ্ঞান
জতাতে পরম হংস তথা যোগ ধ্যান
যে জানে হংসের তর্ত সেই শ্বার যগী
সে সকল শুদ্ধ যুগী হয় শূন্য ভুগী
লোককবি খয়েরজ্জমা পণ্ডিত চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার কাঞ্চননগর ইউনিয়নের মুরাদাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর নাম মূলত খয়েরজ্জমা মাস্টার, কিন্তু লোকসমাজে তিনি খয়েরজ্জমা পণ্ডিত নামে পরিচিত। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করা উনিশ শতকের এই লোককবি মৃত্যুবরণ করেন ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে। পেশা জীবনে তিনি ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। খয়েরজ্জমা পণ্ডিত ‘উদাস সঙ্গীতমালা’ নামক একটি গানের বই প্রকাশ করেন। ‘প্রেমমালা’ ও ‘তৌহিদমালা’ নামে তাঁর আরো দুটি অপ্রকাশিত গ্রন্থ আছে। তিনি উনিশ শতকের সত্তরের দশকের লোককবি রমেশ শীলের সমসাময়িক।
খয়েরজ্জমা পণ্ডিতের বিখ্যাত অনেকগুলো লোকগান রয়েছে। এর মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় গানটি হলো ‘বানারসী গামছা গায়’। এটি ‘উদাস সঙ্গীতমালা’ গ্রন্থের ৫নং গান।
বানারসী গামছা গায়,ভগ্নীর বানারসী গামছা গায়
আনা ধরি সীতা করে ভগ্নির খিলকীর দরজায়।
ইংরেজরা এদেশ শাসনে ‘ভাগ কর,শাসন কর’ নীতি অবলম্বন করেছিল। এদেশের মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি। ইংরেজরা এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে কৌশলে বিনষ্ট করে এবং দীর্ঘদিন এই দেশ শাসন করে। লোককবি খয়েরজ্জমা সমাজ সচেতনতার দৃষ্টিতে তা প্রত্যক্ষ করেছেন। তাইতো তিনি বলেন:
হিন্দু মুসআঁলমান তোরা চলবে একদলে / এক হইলে কি করিব বিদেশ্যার / বল রে ভাই,বলে / সাত কোটি বঙ্গবাসী / অবহেলায় নাও নাশী / দেশের পইসা নেরগই শুষি / বিদেশ্যার ফাল রে ভাই।
আবুল খায়ের নক্সবন্দি ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানার পূর্ব বরৈয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। স্থানীয় মক্তবে পাঠ শেষে আনোয়ারা হাইস্কুলে এন্ট্রাস শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। ১৯২২ সালে পিতার মৃত্যুতে তাঁকে ইংরেজি শিক্ষা ত্যাগ করতে হয়। পরবর্তীতে তিনি চট্টগ্রাম দারুল উলুম হাই মাদ্রাসায় ভর্তি হন।সেখানে পাঁচ বছর অধ্যয়ন শেষে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে একবছরের মধ্যে চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৩১ সালে তিনি ভারত ভ্রমণে বের হন ফকির–দরবেশের সঙ্গ লাভের জন্য।
হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ইত্যাদি সকল ধর্মাবলম্বী সাধক সম্প্রদায়ের সাথে উঠাবসা ও ধর্মালোচনার ফলে আবুল খায়ের নক্সবন্দির মনে সাধনজগতের রহস্যলোকে প্রবেশের আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়। ফলে আত্মসাধনার দ্বারা তিনি আধ্যাত্মিক চেতনা লাভে সচেষ্ট হন। ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন স্কুল শিক্ষক। শিক্ষকতাকে সমাজসেবা ও জাতিগঠনের অংশ হিসেবে দেখতেন আবুল খায়ের নক্সবন্দি।
মাওলানা আবুল খায়ের জীবিত থাকাকালে ১৯৬১ সালে ‘ধগ্নিশিখা’ নামে তাঁর একটি গানের সংকলন প্রকাশিত হয়। এছাড়া ‘ভাবের বাঁশী’ নামে তাঁর আরেকটি গানের গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। মাওলানা আবুল খায়ের মৃত্যু অবধি অনেক মরমি গান রচনা করেন। তাঁর প্রথম প্রকাশিত ‘ধগ্নিশিখা’ গ্রন্থের প্রায় প্রতিটি গান নিবিড় আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ। আধ্যাত্মিক সাধনার নমুনা রয়েছে তাঁর নিম্নোক্ত গানটিতে:
শোন ভাবুকগন সদায় করে ভাবের আলাপন
ভাব আলাপে চিত্ত শুদ্ধি পাপের পলায়ন।
হৃদয় মূলে নয়ন খোলে এক ধ্যানের ভাবনায়
এক ভাবনে সংগোপনে বিশ্ব জগত দেখা যায়
ভাবলে বসি তত্ত্বজ্ঞান হবে আত দরশন।
মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু হচ্ছে রিপু তথা কামনা বাসনা। কামনা, লোভ, হিংসা ও ক্রোধ মানুষের জীবনের শুদ্ধতা অর্জনের পথে প্রধান অন্তরায়। এই অন্তরায় হতে মুক্তি লাভে ধরতে হয় সঠিক গুরুর চরণ। আবুল খায়ের নক্সবন্দি তাঁর গানে সেটাই বলছেন:
মরি হায়রে দুঃখ বলবো কারে,
মানব জনম হরিয়া নিল রিপু দুরাচারে।
কাম রিপু ক্রোধ রিপু লোভ রিপু তারা,
জীবন পথে লুণ্ঠন করি করে সর্ব্বহারা।
আধ্যাত্মিক সাধনার সংগীত রচনার পাশাপাশি আবুল খায়ের নক্সবন্দি লৌকিক জীবনের বিভিন্ন অনুষঙ্গ নিয়েও সংগীত রচনা করেছন। মানুষের ব্যক্তিক অনুভূতির অন্তরখোলা প্রকাশ ঘটেছে তাঁর গানে:
আমার পরাণ কাঁদে রাতিয়া, মন যে কাঁদে রাতিয়া
বিরহ কোকিলা ডাকে ডালে বসিয়া।
সরকার মণীন্দ্র দাস ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে চন্দনাইশ থানার বৈলতলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যুবরণ করেন ৬ই জুলাই ২০০০ সালে। তিনি মূলত ছিলেন কবিয়াল। চট্টগ্রামে রমেশ শীলের পরে সরকার মণীন্দ্র দাসের নাম কবিয়াল হিসেবে খ্যাত। অনেকগুলো গ্রন্থ রচনা করলেও ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে রচিত তাঁর ‘১৯৪৩ সনের কবিতা’ গ্রন্থটি বিখ্যাত। এটি একদিকে যেমন লোকসাহিত্য অন্যদিকে ঐতিহাসিক ঘটনার দলিল। তাছাড়া এই গ্রন্থটি তাকে লোককবি হিসেবে বোদ্ধাদের নিকট গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল মানবসভ্যতার জন্য লজ্জাজনক অধ্যায়। কোটি কোটি মানব হত্যা এই যুদ্ধকে করেছে মানুষের কাছে ঘৃণিত। ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে ভারতবর্ষও এই যুদ্ধের শিকার হয়েছে। মানুষের মানবিক বিপর্যয়ের সে সময়কার অবস্থা উঠে এসেছে মণীন্দ্র দাসের কবিতায়:
হায়রে বিধি হায় অঘটন ঘটালী কেন সোনার চাঁটীগায়
চাঁডগাঁইয়ার খুনেতে গাঙ্গের জল লাল হইয়া যায়॥
১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে যে মানবিক বিপর্যয় হয়েছিল তা কল্পনাতীত। খাদ্যের জন্য মানুষের হাহাকার ছিল। খাদ্যের জন্য নারীর সতীত্ব বিসর্জন, খ্যাদ্যের অভাবে নিজ সন্তানকে ফেলে মায়ের চলে যাওয়া এইসব ছিল মানবতার চরম অপমান। মণীন্দ্র দাসের কবিতায় এই প্রসঙ্গটি ভালভাবেই এসেছে:
১৯৪৩ সনে খাদ্য সঙ্কট হইল
চট্টগ্রামে নরনারী দুই লক্ষ লোক মইল॥
মকবুল আহমদ পণ্ডিত ছিলেন উনিশ শতকের বিখ্যাত লোককবি। চট্টগ্রামের রাউজানের নয়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর জন্মসাল সম্পর্কে সঠিকভাবে কিছু জানা যায় না তবে লোকসমাজের কাছে জানা যায় তিনি আস্কর আলী পণ্ডিতের(১৮৪৬–১৯২৭) সমসাময়িক ছিলেন এবং আস্কর আলী পণ্ডিতের কাছে তাঁর আসা–যাওয়া ছিল।
মকবুল আহমদ পণ্ডিত মানুষের কাছে ‘মকবুল পণ্ডিত’ নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি অজগ্র লোকসংগীত, পালাগান ও কবিগান রচনা করেন। বিশেষ করে পালাগান রচনা করে তিনি খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাঁর বিখ্যাত একটি পালাগান ‘হাতিখেদা’। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও আসামের গভীর জঙ্গলসমূহ হাতীর প্রধান আবাসস্থল ছিল একসময়। এই এলাকার লোকেরা হাতি ধরার বিভিন্ন কৌশল উদ্ভাবন করেন। আর এই হাতী ধরাকেই বলে ‘হাতিখেদা’। মকবুল আহমদের বিখ্যাত পালাগান ‘হাতিখেদা’র অংশ বিশেষ:
সপসপাসপ গুমগুমাগুম হাতীর আবাজ
দুনিয়াতে রোজ কেয়ামত হবে বুঝি আজ!
‘হাতিখেদা’ পালাগানটির মত মকবুল আহমদের আরেকটি বিখ্যাত পালাগান ‘দুই সতিনের ঝগড়া’। এটি তাঁর জীবদ্দশায় ৮ম সংস্করণ পর্যন্ত প্রাকাশিত হয়। এই পালাগানটি বাস্তব ঘটনানির্ভর বলে জানা যায়। বাস্তব সমাজচিত্র পাওয়া যাবে এই পালাগানটিতে:
মকবুল আহমেদের ভূনে দুই সতীনে কেমন করে ভাই।
দোন জনের ঝাপটাঝাপটি সভাকে জানাই॥
শুনতে বড় মজার কথা আমি হেথা লেখি সবার আছে।
কত মজা কেমন সাজা পায় অবশেষে॥
মকবুল আহমদ পণ্ডিতের লোকগান সংগ্রহের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ চোখে না পড়লেও স্যার আশুতোষ চৌধুরী ও পুঁথি সংগ্রাহক আবদুস সাত্তার চৌধুরী ব্যক্তিগতভাবে তাঁর একাধিক গান–পালাগান সংগ্রহ করেন। ১৯৭৬ সালে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘লোক–সাহিত্য’সংকলনে চতুর্দশ খণ্ডে(সম্পাদক:আলমগীর জলীল) আবদুস সাত্তার চৌধুরীর সংগৃহীত মকবুল আহমদের মাইজভাণ্ডারী গানটি সংকলিত হয়েছে:
গাউছে ধনের প্রেম সাগরে ইমান রত্ন ভেসে যায়
ধনী হতে সাধ থাকে যার হঠাৎ করে নিতে আয়,
করতে পাপী তরাইতে আসিল সে এভবেতে,
ভক্তি করি নাম নিলে দুকূলে সরিয়া যায়।
মরমি কবি সৈয়দ ছায়াদউল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন চট্টগ্রামের হাটহাজারীর মির্জাপুরের সৈয়দপাড়া গ্রামে। তিনি মাইজভাণ্ডার দরবারকে কেন্দ্র করে অসংখ্য মরমি লোকগান লিখেছেন। মাইজভাণ্ডারী দরবার শরীফের সাথে সৈয়দ ছায়াদউলাহ সরাসরি জড়িত ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন মাইজভাণ্ডারী দরবার শরীফের ‘আহমদিয়া মঞ্জিল’ এর তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া ১৯৪৯ সালে হযরত দেলওয়ার হোসাইন মাইজভাণ্ডারী(রহ.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘আঞ্জুমানে মোত্তাবীয়ানে গাউছে মাইজভাণ্ডারী ‘নামক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সাংগঠনিক দক্ষতার পাশাপাশি আধ্যাত্মিক সংগীত রচনায়ও তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। যা চট্টগ্রামের লোককবি হিসেবে তাঁকে বিখ্যাত করেছে। তাঁর একটি মাইজভাণ্ডারী গান:
আমার,মির্জাপুরী বড় মৌলবি প্রেমের গোলাপ ফুল,
প্রেমদান করেন সদা আশেক প্রেমিক কুল॥
ভাণ্ডারী গানের ধারায় একটি বিখ্যাত গান হলো ‘আমার পাপ তিমিরে নাইরে ভয়’ গানটি। যার রচয়িতা সৈয়দ ছায়াদউল্লাহ। গানটি মূলত আধ্যাত্মিক ধারার গান।
আমার পাপ তিমিরে নাইরে ভয়
ভাণ্ডারেতে প্রেম শশী উদয়॥
চট্টগ্রামের লোকগানের ধারায় সেকান্দার গাইন একটি পরিচিত নাম। তিনি চট্টগ্রামের পটিয়া থানার হাইদগাঁও এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ‘গাইন’ সাধারণ মানুষ কর্তৃক প্রদত্ত তাঁর উপাধি। সেকান্দার পণ্ডিত নামেও তিনি পরিচিত। সেকান্দার গাইন জন্মগ্রহণ করেন ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে আর মৃত্যুবরণ করেন ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কোনো শিক্ষা না থাকলেও তিনি ছিলেন গভীর জ্ঞানের অধিকারী। যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর গানগুলোতে।
মাদকদ্রব্যের ব্যবহার মানুষকে কলুষিত করে তা আমরা সবাই জানি। এর ফলে মানুষের ধর্মীয় এবং সামাজিক জীবন বিপন্ন হয়। পারিবারিক কলহ, চুরি, রাহাজানি সহ বিভিন্ন অপরাধ সংগঠিত হয় মাদকের কারণে। সেকান্দার গাইন তাঁর গানে বলেন:
যে খাইবো আফিং মদত
নিশার জোরে দিব ছাড়ি
খোদার এবাদত।
সমাজ মনস্কতার অপূর্ব উপস্থিতি লক্ষ করা যায় সেকান্দার গাইনের মাঝে। যা একজন লোককবির প্রধান বৈশিষ্ট্যও। তাঁর একটি গানে সামাজিক অপরাধ হিসেবে চুরিকে নিরুৎসাহিত করা হয়। তিনি বলেন:
চুরির মইধ্যে নাই মজা
লোকের কাছে অতি শরম
পৈশছাতে সাজা।
মুন্সী আমিন শরীফ ১৮৯৮ সালে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যুবরণ করেন ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে। পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন সরকারী সার্ভেয়ার ময়নামতি টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষক হিসেবে (৬ষ্ঠ পৃৃ. দ্র.)
নিয়োগ পাওয়ার কিছুকাল পরেই তিনি হঠাৎ করে সুফিতত্ত্ব, বাউলতত্ত্ব, যোগসাধনাসহ আধ্যাত্মিক আরো বিভিন্ন বিষয়ে জানা–সাধনার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হন। মুন্সী আমিন শরীফের ‘সাধনতত্ত্ব–প্রথম ভাগ’ নামে ১৯৫৭ সালে একটি গানের সংকলন প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটিতে গান ছিল ৪৮ টি। এছাড়া ‘তত্ত্ববিধি’ নামে তাঁর আরেকটি গানের সংকলন প্রকাশিত হয়।
আমিন শরীফ চট্টগ্রামের আধ্যাত্মিক সাধক ও লোককবি কানুফকির প্রবর্তিত রজয়ি তরিকায় দীক্ষিত হন তাঁর গুরু বা মুর্শিদ হাবিবর রহমানের হাত ধরে। তিনি তাঁর একটি গানে বলেন:
আমার গুরু মান্য মান,
শুদ্ধ পীর মতি ধীর হাবিবর রহমান,
মাতা পিতা জ্ঞানদাতা পদধূলি শিরেতে॥
মুন্সী আমিন শরীফ সুফিবাদের পাশাপাশি বাউলতত্ত্ব ও যোগসাধনার সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। তাঁর গানের মাঝে এইসবের সমন্বয় দেখতে পাই:
বিপাকে ঠেকিলে তরী
কোথায় রইলা ওষষাইনগিরি,
বিপদেতেও লও দয়া করি,
মন মাঝিরে……।
লোককবি আবদুল জলিল সিকদার মূলত উনিশ শতকের কবি। জন্মগ্রহণ করেন চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার মনেয়াবাদ গ্রামে। জন্মসাল অজ্ঞাত হলেও জানা যায় মাইজভাণ্ডারী তরিকার প্রবর্তক সৈয়দ আহমদ উল্লাহর সমসাময়িক তিনি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ, মধ্যযুগে রচিত বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন পুঁথি–গান প্রভৃতি পাঠ করার মাধ্যমে স্বশিক্ষিত মানুষে পরিণত হন। যৌবনেই তিনি গান রচনায় মনোনিবেশ করেন। গান রচনার প্রথম দিকে তিনি কিছুকাল লৌকিক জীবননির্ভর গান রচনা করেন এবং পরবর্তীতে মরমি গান রচনা শুরু করেন। জাহাঙ্গীরিয়া তরিকার প্রবর্তক মোখলেছুর রহমানের অনুপ্রেরণায় আবদুল জলিল অজগ্র গান রচনা করেন। জীবদ্দশায় তাঁর দুটি গানের সংকলন প্রকাশিত হয়। সংকলন দুটির নাম ‘প্রভু পরিচয়’ ও ‘জারী গান’। ‘জারী গান’ বর্তমানে দুষ্প্রাপ্য। ‘প্রভু পরিচয়’ প্রকাশিত হয় ১৯৩৩ সালে এবং এতে গান রয়েছে ১৭৩টি। গ্রন্থটির ভূমিকা থেকে জানা যায় শাহ আবদুল জলিল সিকদার তাঁর গুরু আবদুল হাই’র নির্দেশে ‘প্রভু পরিচয়’ গ্রন্থটি রচনা করেন।
শাহ আবদুল জলিল সিকদার গানের সংকলন ছাড়াও একাধিক পুঁথি রচনা করেন। তাঁর রচিত ‘মনেয়াবাদের ইতিবৃত্ত’,’জাঁহাগীর চরিত’ ও ‘বারমাসী’ নামক পুঁথি তিনটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের দুষ্প্রাপ শাখায় সংরক্ষিত আছে। এছাড়া তাঁর ‘জারী গান’ গ্রন্থটিও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের একই শাখায় সংরক্ষিত আছে। লোককবি শাহ আবদুল জলিল সিকদার জাহাঙ্গীরিয়া তরিকার অনুসারী ছিলেন। কারো কারো মতে তিনি ১৮৫৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৩৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
চঞ্চল চিত্ত সাধনায় মগ্ন হতে দেয় না। সাধনা লাভে প্রয়োজন স্থির চিত্ত। তাছাড়া লোক নিন্দাকে পরোয়া করলে সাধনায় কখনও সিদ্ধি লাভ হয় না। তাই শাহ আবদুল জলিল সিকদার তাঁর গানে বলেন:
বন্ধু শান্ত কর প্রাণ,
বসন ছাড়ি রস প্যারি যৌবন করি দান।
সাধনা ও ভক্তির মাধ্যমে জীবাত্মা পরমাত্মার নিকট বন্ধুর ন্যয় হয়ে যায়। ফলে তাদের মধ্যে যে সম্পর্কটি গড়ে ওঠে তা সম্পূর্ণই সরলরৈখিক ধারায় চলে। তাই কবি বলেন:
বন্ধু ধরি তোমার পায়।
গুপ্ত ব্যক্ত বাঞ্ছা পুরাও সরল বাসনায়॥
বিরহে মন পোড়ে আসি দেখিতে তোমায়।
উনিশ শতকের চট্টগ্রামের বিখ্যাত লোককবি কবিরঞ্জন ক্ষেমেশচন্দ্র রক্ষিত জন্মগ্রহণ করেন ১৮৪৭ সালে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার জোয়ারা গ্রামে। জনশ্্রুতি আছে তিনি জমিদার ছিলেন। জমিদারি করতে গিয়ে বিভিন্ন সামাজিক সেবামূলক কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িত করেও আত্মতৃপ্তি লাভ না হওয়ায় তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন।
ক্ষেমেশচন্দ্র রক্ষিত ১৩টি গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে কোনটি গদ্য, কোনটি পদ্য। গ্রন্থগুলো প্রকাশিত হলে তিনি সুধী মহলে প্রশংসিত হন এবং সুধী মহল কর্তৃক ‘কবিরঞ্জন’ উপাধিতে ভূষিত হন। তাঁর রচিত গ্রন্থ ১৩টি হলেও তাঁর মৌলিক ও উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘আমার খেয়াল’ ও ‘মানুষ কুসুম’। ক্ষেমেশচন্দ্র রক্ষিত মৃত্যুবরণ করেন ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে।
ক্ষেমেশচন্দ্র রক্ষিতের ‘আমার খেয়াল’ গ্রন্থটির রচনাকাল অজ্ঞাত। গ্রন্থটিতে কবিতা রয়েছে ৬৪টি। ‘আমার খেয়াল’ গ্রন্থের আত্মপরিচয় অংশে কবি জীবনের নানা দিক বর্ণনা করে বলছেন:
অভাগা ক্ষেমেশ মনে নাই মাতৃসুখ।
দু’মাস বয়সে মোর জননী বিমুখ॥
‘আমার খেয়াল’ গ্রন্থটির শেষাংশে কবি নিজের আত্মিক সাধনার স্বরূপ বর্ণনা করেছেন। পরমাত্মার খোঁজে নিজের সাধনার বিচলিত ভাবের কথাও উঠে এসেছে এখানে। যেমন:
কাহাকে বলয় আত্মা, কোথা আছে সে মহাত্মা,
কি দরকার বিচার তাঁহার।
আতর আলী নামে চট্টগ্রামের একজন লোককবির সন্ধান পাওয়া যায় তাঁরই রচিত গানের সংকলনের একটি খণ্ডিত অংশ উদ্ধারের মাধ্যমে। চট্টগ্রামের লোক গবেষক শামসুল আরেফীন চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার উত্তর গাছবাড়িয়ার বদুরপাড়া নিবাসী আবুল কাসেম নামক এক ভদ্রলোকের কাছ থেকে গ্রন্থটির খণ্ডিত কিছু অংশ উদ্ধার করেন। আতর আলীর জীবন–বৃত্তান্ত জানা না গেলেও তিনি যে চট্টগ্রামে অধিবাসী এবং মাইজভাণ্ডারী তরিকার অনুসারী ছিলেন তা তাঁর রচিত একটা গান থেকে জানা যায়। যেমন:
গাইচের পেয়ারা সুলতানপুরি,
প্রেম খেলার অধিকারি
গাউচল আজম মাইজভাণ্ডারী খেলার মধ্যেতে॥
লোককবি আতর আলী লৌকিক জীবনের রূপকের আড়ালে অধ্যাত্মবাদের প্রকাশ ঘটিয়েছেন তাঁর গানে। নিম্মোক্ত গানটিতে গ্রষ্টার স্মরণে মানবের অলসতার স্বরূপ তুলে ধরেছেন তিনি:
কেন মন ঘুমে রইছ নিশি হৈল অবসান,
কুহু শব্দ সুরে কুকিলা গাহিছে গান॥
আতর আলীর মত লোককবি মোরশেদ চাঁদ দরবেশ সম্পর্কেও বিস্তারিত জানা যায় না।লোক গবেষক শামসুল আরেফীন ২০০৩ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার অছিয়র রহমানের কাছ থেকে মোরশেদ চাঁদ নামক এক লোককবির দুটি গান উদ্ধার করেন। তবে অনুমান করা যায় তিনি চট্টগ্রামের লোককবি। কারণ গান দুটি চট্টগ্রামের স্থানীয় মানুষের কাছে পাওয়া গেছে।
চট্টগ্রামের অন্যান্য অধিকাংশ লোককবির মত মোরশেদ চাঁদ দরবেশের গানও লোকধর্ম সাধনানির্ভর। অধ্যাত্মবাদের গুপ্ত প্রকাশ লক্ষ করি তাঁর গানে। যেমন:
যারে নিয়া চলো ফেরো তাকে চেন নি।
ওরে মন তোর কিসে হবে কি॥
লোককবি করিম সাহা সম্পর্কেও কোনো কিছু জানা যায় না। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে লোক গবেষক শামসুল আরেফীন চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার অছিয়র রহমানের কাছ থেকে করিম শাহার দুটি গান উদ্ধার করেন।
করিম শাহা সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা না গেলেও তাঁর নিম্মোক্ত গান থেকে ধারণা করা যায় তিনি ‘নয়নপুর’ নামক কোন এলাকার ‘বাগরা’ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছেন।
এ দেশেতে আমার কে আছে,
ভাও করে দে দেহের মাজে।
করিম শাহার অপর একটি গান তাঁকে আমাদের মাঝে একজন ভাবসাধক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়। বাংলার ইতিহাসে উনিশ শতক ভাব এবং আধ্যাত্মিক সাধনার শতক হিসেবে খ্যাত। তাই তাঁর গানের ভাব দেখে ধারণা করা যায় তিনি উনিশ শতকের কবি।
মন রইলে কেন মায়াতে / পেয়েছ মানব জনম ছাড়রে ভ্রম, / মজিও না আর পাপেতে।
মাওলানা আবদুল লতিফ শাহ চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। অনুমান করা হয় ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯০০খ্রিস্টাব্দের মধ্যকার সময়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে আবদুল লতিফ ভর্তি হন চট্টগ্রামের দারুল উলুম মাদ্রাসায়। এরপর ভর্তি হন কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসায়। সেখান থেকে শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করে জন্মস্থান চন্দনাইশে ফিরে আসেন। শৈশব থেকে আবদুল লতিফ শরীয়তের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণে নামাজ–রোজা প্রভৃতি আদায়ে মনোযোগী ছিলেন।
১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে আবদুল লতিফ চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ির মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফে গমন করেন। তখন মাইজভাণ্ডারের পীর ছিলেন গোলামুর রহমান মাইজভাণ্ডারী। আবদুল লতিফ গোলামুর রহয়ানের থেকে মাইজভাণ্ডারী তরিকার খেলাফত প্রাপ্ত হন। খেলাফত প্রাপ্ত হয়ে তিনি জন্মস্থানে ফিরে মাইজভাণ্ডারী তরিকার প্রচার শুরু করেন। ফলে তাঁর অনেক শিষ্য তথা মুরিদ তৈরি হয়।
খেলাফত প্রাপ্তির পূর্বে আবদুল লতিফ গান শোনা, গান রচনা নাজায়েজ মনে করতেন। পরবর্তীতে তিনি নিজে গান রচনা, সুরারোপ ও শ্রবণ করতেন। কারণ সংগীত বাদ দিয়ে মাইজভাণ্ডারী তরিকার অনুসারীদের কল্পনা করা অসম্ভব।
আবদুল লতিফ অসংখ্য গান রচনা করলেও বর্তমানে তাঁর দেড়শত গান সংগ্রহে আছে। মাওলানা আবদুল লতিফের ‘মারফত তত্ত্ব’ নামে গানের একটা সংকলন ১৯৭৭ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। সংকলনটিতে গান ছিল ২৯টি। পরবর্তীতে ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে সংকলটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। আবদুল লতিফ ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
আবদুল লতিফের গান ছিল গভীর আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ। তাঁর গান গুলো শুনলে যে কেউ ভাবসাগরে ডুব দিতে বাধ্য হবে। তাঁর আধ্যাত্মিকতা প্রকাশের উজ্জ্বল নিদর্শন নিম্মোক্ত গানটি:
চলো যাই অমরপুরে যে দেশে মানুষ মরে না
সে দেশেতে বাস করিলে আজরাইলের ভয় থাকে না।
আবদুল লতিফ যেহেতু ভাণ্ডারী তরিকার খেলাফত প্রাপ্ত ব্যক্তি ছিলেন সেহেতু তিনি লৌকিক ধর্মসাধনা নির্ভর গান রচনা করেছেন বেশি। এর মধ্যে মাইজভাণ্ডারকে উপলক্ষ করে তিনি অনেক গান রচনা করেন। যেমন:
তোরা কে কে যাবি আয়,
প্রেমের বাজার বসাইছেন দয়াল মাওলানায়॥
চট্টগ্রামের একজন অখ্যাত লোককবি দলিলুর রহমান পণ্ডিত। যাঁর সকল সৃষ্টিকর্ম বিলুপ্ত। দলিলুর রহমান পণ্ডিত উনিশ শতকের লোককবি ছিলেন।তিনি আস্কর আলী পণ্ডিতের সমসাময়িক ছিলেন। দলিলুর রহমানের সংগ্রহে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে রচিত দুই শতাধিক পুঁথি ছিল। পুঁথি পাঠ করতে করতে একসময় স্বশিক্ষিত মানুষে পরিণত হন। একসময় তিনি সাহিত্য–সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগী হয়ে পড়েন। সাহিত্য–সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ থেকে দলিলুর রহমান গান–কবিতা রচনায় মনোনিবেশ করেন এবং লোককবিতে পরিণত হন। দলিলুর রহমান তাঁর সময়ে পণ্ডিত সমাজের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। যদিও সে সময়ে আস্কর আলী পণ্ডির বর্তমান ছিলেন। দলিলুর রহমান অনেকগুলো পুঁথি বা গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। কিন্তু তার কোনটিই আজ সংগ্রহে নেই। যার সবকিছুই আজ বিলুপ্ত। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
উল্লিখিত লোককবিগণ ছাড়াও চট্টগ্রামের নাম না জানা আরো অনেক লোককবি রয়েছেন। লেখার কলের বৃদ্ধির আশংকায় সবার সম্পর্কে আলোকপাত করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া, গানের পুরো অংশও জায়গা সংকুলানের কারণে রাখা হয়নি।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চটগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।