খুব সম্ভবত বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষাগুলোর মধ্যে চট্টগ্রামের ভাষার মত এমন বহুমাত্রিক ব্যবহার অন্য কোনো আঞ্চলিক ভাষায় পাওয়া যায় না।
গান, নাটক, পালাগান, পুঁথি, কী নেই এ ভাষায়। এ ভাষার গানসমূহ সহজেই চট্টগ্রামের মানুষের মন জুড়ায়। যেমন–
“বাঁশখালি মইষখালি, তোঁরা কনহ কনহ যাবি আঁর সাম্পানে”
“বাচুরে অ বাচু, আঁই যাইওম চাটগা
শহঅরত তোঁয়ালাই আইনুম কী”
“ও জেডা ফইরার বাপ, ও জেডা ফইরার বাপ,
একদিন বুঝিবা জেডা একদিন বুঝিবা”
চট্টগ্রামের ভাষায় এ ধরনের অসংখ্য গান রয়েছে এখনও চট্টগ্রামের মানুষের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়। হাসি কান্নার এসমস্ত গানের কথা যেমন জীবনমুখী, তেমনি প্রেরণাদায়ী। এ গানগুলোর সূরগুলোও মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
এর বাইরে চট্টগ্রামের ভাষার রয়েছে অসংখ্য নাটক এসব নাটকগুলো নিয়মিত বাংলাদেশ টেলিভিশন, চট্টগ্রাম থেকে প্রায় সময় প্রচারিত হয়।
বর্তমানে চট্টগ্রামের ভাষায় অসংখ্য ইউটিউবার চট্টগ্রামের ভাষাকে বাংলাদেশসহ পুরো পৃথিবীতে জনপ্রিয় করে তুলেছে। প্রকৃতপক্ষে চট্টগ্রামের ভাষা একটি সমৃদ্ধ ভাষা হলেও ইদানিং শহরে অবস্থানরত চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দাদের মধ্যে অনেককেই চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলতে দেখা যায় না। তারা ছোট বয়স থেকে চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলে আসলেও তাদের সন্তান–সন্ততিদের শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলতে শেখায় এতে করে তাদের সন্তান সন্ততি বড় হয়ে সহজে চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলতে পারে না এমন মন মানসিকতা থেকে আমাদের সবাইকে বের হয়ে আসতে হবে। প্রথমে সন্তানদের চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলা শেখানোর পর অন্যান্য ভাষার প্রতি দক্ষতা বাড়াতে হবে। গ্রামের মানুষদের মধ্যে এখনও চট্টগ্রামের ভাষায় হরদম কথা বলার বিষয়টি লক্ষ্য করা গেলেও চট্টগ্রাম শহরে এর ব্যাতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। শহরের মানুষকে পেশাগত কারণে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে হলেও অন্তত চট্টগ্রামের মানুষরা একসাথে হলে চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলা উচিত। বাসায়ও ছেলেদের সাথে চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলা উচিত এতে করে সন্তানরা চট্টগ্রামের ভাষার প্রতি যত্নবান হতে পারবে। প্রকৃতপক্ষে চট্টগ্রামের প্রাণময় এভাষাকে সবার কাছে জনপ্রিয় করে তুলতে হলে এ ভাষার সর্বাধিক ব্যবহার জরুরি। বর্তমান সময়ের চট্টগ্রামের অনেক ছেলে মেয়েই জানে না শেফালি ঘোষ, শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব, কল্যাণী ঘোষ,সনজিত আচার্য্য নামের বেশকিছু চট্টগ্রামের ভাষার কিংবদন্তি গায়ক গায়িকা ছিল এবং এখনও সময় পেলেই চট্টগ্রামের মানুষ তাদের গান শোনো। অনেকেই আবার খেত খামারে এসব গান গলা ছেড়ে গায়ও।
চট্টগ্রাম জেলার গ্রাম সমূহে অহরহ চট্টগ্রামের ভাষা চর্চিত হয় একথা শতভাগ সত্য কিন্তু শহরের বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে চট্টগ্রামের ভাষা কিছুটা কম চর্চিত হয়। আমরা সবাই মিলে সজাগ হলে শহরেও ঘরে ঘরে এ ভাষার চর্চা বাড়ানো তেমন কঠিন কাজ নয়। আপনার সন্তানদের সাথে আপনি যদি নিয়মিত চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলতে পারেন তাহলে শহরের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরাও চট্টগ্রামের ভাষায় পারদর্শি হয়ে ওঠবে। এক্ষেত্রে তাদেরকে লেখাপড়ার সময়টা বইয়ের ভাষা চর্চা করবে এটাই স্বাভাবিক। আমরা ইতিমধ্যে লক্ষ্য করেছি দূর অতীতে গ্রামে ঘরের ওঠোনে পাটিতে সবাই একসাথে বসে বয়োজ্যেষ্ঠ ঠাকুর মা কিংবা ঠাকুর দা’র কাছে চট্টগ্রামের ভাষা কিচ্ছা কিং সোল্লুক শোনার ব্যাপারটি তেমন একটা চোখে পড়ে না। গ্রামও এখন প্রায় শহরে পরিণত হয়েছে। খেলার মাঠ থাকলেও তেমন কাউকে মাঠে আর খেলতে দেখা যায় না। চি কুৎকুৎ, হাডুডু, মার্বেল, চাড়া খেলা এগুলো যেন হারাতে বসেছে। চট্টগ্রামের মানুষ দূরাতীতে মাঠে, ময়দানে, বিলে, খোলা জায়গায় যেভাবে খেলাধূলা করতো এখন গ্রামে ছেলেদের তেমন করে খেলতে দেখা যায় না। খেলার সাথে সাথে ছেলে মেয়েদের মুখ দিয়ে বের হতো অনর্গল চট্টগ্রামের ভাষা অনেক সময় চট্টগ্রামের ভাষায় গালিও দিতো।
মূলত চট্টগ্রামের ভাষা আন্তর্জাতিকীকরণ করতে হলে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে। সর্বপ্রথম এ ভাষার চর্চা বাড়াতে হবে। এ ভাষায় বিভিন্ন গান রচনা করে তা দেশ বিদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। নাটক, চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে আধুনিক চট্টগ্রামকে নিয়ে। এসব বিষয়ে বিত্তবানদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে। চলচ্চিত্র শিল্প হচ্ছে এমন একটা জনপ্রিয় মাধ্যম যে মাধ্যমে কোনো একবার জনপ্রিয়তা পেলে তা মানুষের মনে চিরদিন থেকে যায়। সুতরাং চট্টগ্রামের ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করা সময়ের দাবি।
একটা বিষয় সকলের মনে রাখতে হবে যে ভাষা বেঁচে থাকে অধিক মানুষের চর্চায় এবং এর লেখ্যরূপে। চট্টগ্রামের ভাষায় রয়েছে একাধিক অভিধা আমরা চাইলে এর লেখ্যরূপও প্রকাশ করতে পারি।
প্রকৃতপক্ষ অন্তর্গত তাৎপর্য হচ্ছে যুগযুগ ধরে মানুষ উক্ত ভাষায় কথা বলে যাওয়া তাহলে সে ভাষা আর কখনও পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে না। আর ভাষার বাহ্যিকরূপ হলো ভাষাকে চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়া এবং এ ভাষাকে পৃথিবীর মানুষ চেনা এবং প্রয়োজনে শেখার এবং বোঝার চেষ্টা করা। চট্টগ্রামের ভাষাকে জনপ্রিয় করতে চাইলে সকল মাধ্যমেই এর বহুমাত্রিক ব্যবহার খুবই জরুরি।
লেখক
কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক











