ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে স্থাপিত ওজন নিয়ন্ত্রণ স্কেল বন্ধের দাবি জানিয়েছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা। তাঁরা সীতাকুণ্ডের বড় দারোগাহাট এবং কুমিল্লার দাউদকান্দি টোলপ্লাজায় স্থাপিত ওজন নিয়ন্ত্রণ স্কেলের মাধ্যমে চট্টগ্রামের ব্যবসা বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন। তারা বলছেন, দেশের আর কোনো মহাসড়কে ওজন স্কেল নেই। মহাসড়কের সুরক্ষায় যদি ওজন স্কেল বসানো হয়, তাহলে বাকি মহাসড়কগুলোতে কেন বসানো হয়নি সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের কাছে সেই প্রশ্ন রাখছেন ব্যবসায়ীরা। ওজন নিয়ন্ত্রণ স্কেলের কারণে চট্টগ্রামের বৃহৎ পাইকারি বাজার চাক্তাই খাতুনগঞ্জের ব্যবসা বাণিজ্যও নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরে বিভিন্ন দেশ থেকে বাল্ক কেরিয়ারে আসা ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ পণ্য চট্টগ্রামে আনলোড না হয়ে সরাসরি নারায়ণগঞ্জে চলে যাচ্ছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের। আগে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আমদানিকৃত পণ্য সরাসরি চাক্তাই খাতুনগঞ্জ এবং আশপাশে গুদামে রাখা হতো। তারপর সেখান থেকে সড়ক পথে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ হতো এসব পণ্য। এখন পরিবহন ব্যয় কমানোর জন্য আমদানিকারকরা এখানে পণ্য আনলোড করছেন না।
ওভারলোডিংয়ের কারণে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নবনির্মিত ঢাকা-চট্টগ্রাম ফোর লেন মহাসড়কের মারাত্মক ক্ষতি হওয়ায় সমপ্রতি বাড়তি ওজনের পণ্যবাহী ট্রাক ও কন্টেইনারবাহী যানবাহন চলাচল বন্ধ করেছে কর্তৃপক্ষ। ওজন স্কেলের কারণে মহাসড়কে বাড়তি ওজনের পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল করতে পারছে না। দেশের মহাসড়কগুলোর স্থায়িত্ব বাড়ানোর লক্ষ্যে অতিরিক্ত ভারের যানবাহন চলাচল ঠেকাতে ২১টি স্থানে ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপন করার সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু দেশের আর কোনো মহাসড়কে ওজন স্কেল বসানো হয়নি বলে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন। তাঁরা বলেন, ওজন স্কেল যেহেতু নেই, তাই অন্য অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা অনায়াসে প্রতি ট্রাকে ২০ টন পর্যন্ত পণ্য আনা নেয়া করতে পারছেন। অথচ চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা ১৩ টনের বেশি পণ্য পরিবহন করতে পারছেন না। এতে ব্যবসায়ীদের পরিবহন খরচ বাড়ার পাশাপাশি অসম প্রতিযোগিতারও সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বর্তমানে মহাসড়কে ওজন নিয়ন্ত্রণের খড়গের কারণে ধীরে ধীরে চট্টগ্রাম থেকে ব্যবসা বাণিজ্য অন্য জায়গায় স্থানান্তর হয়ে যাচ্ছে। এক সময় চাক্তাই খাতুনগঞ্জ থেকে সারা দেশে ভোগ্যপণ্য সরবরাহ করা হতো। এখন মহাসড়কে শুধুমাত্র ওজন নিয়ন্ত্রণের কারণে বাল্ক কেরিয়ারে আসা বেশিরভাগ পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর থেকে লাইটারেজ জাহাজে করে নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জে চলে যাচ্ছে। তাঁরা বলেন, ওজন স্কেল স্থাপন করতে হলে দেশের সবগুলো মহাসড়কে স্থাপন করতে হবে। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা এই বৈষম্যের অবসান চান।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, কী ছিল না চট্টগ্রামে? বন্দর ঘিরে প্রাচীনকালে এখানে নোঙর করেছিল একের পর এক বিদেশি শক্তি। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল এ নগর। তারও পরে ষাট থেকে সত্তর বছর আগে চট্টগ্রাম থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল বহু হালকা, মাঝারি ও ভারী শিল্প খাতেরও। বাণিজ্যের প্রয়োজনে ছুটে এসেছিল বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও। তবে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সহায়ক অবকাঠামো ও নীতিগত অনুমোদনের সুবিধা ঢাকায় কেন্দ্রীভূত হওয়ায় এই স্রোতে ভাটা পড়তে থাকে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময়ে ঢাকার বাইরে অনেক সংস্থার প্রধান কার্যালয় নেওয়া হলেও পরে তা ফিরিয়ে নেওয়া হয়। চট্টগ্রামের যে কয়টি আছে, তা-ও ঢাকার মুখাপেক্ষী। মিরসরাই থেকে টেকনাফ পর্যন্ত যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে, তার গতি ত্বরান্বিত করতে হলে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। তাহলে সুফল পাবে পুরো বাংলাদেশ।
ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সরকার চট্টগ্রামে অর্থনৈতিক অঞ্চল, টানেল, বিদ্যুৎকেন্দ্র গভীর সমুদ্রবন্দরসহ বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে হলে চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নয়ন করতে হবে, দূর করতে হবে সকল রকমের প্রতিবন্ধকতা। চট্টগ্রামের সঙ্গে সারা দেশের নৌ, আকাশ, সড়ক ও রেলপথের সংযোগ আরও উন্নত করতে হবে। আর আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা প্রদান করতে হবে।
দেশের অন্য মহাসড়কগুলোতে যদি ওজন স্কেল স্থাপন করা হতো, তাহলে হয়তো বৈষম্যের অভিযোগ আসতো না। ফলে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত বলে আমরা মনে করি।