দেখতে দেখতে অর্ধশত বছর পার হয়ে গেল বাংলাদেশের। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে এ পর্যন্ত ৫২ বছর কাটিয়ে ফেলেছে বাংলাদেশিরা। এ দীর্ঘ সময়টা কম কিছু নয়। এ সময়ে দেশের খেলাধুলাকে মূল্যায়ন করতে হলে অভিজ্ঞরা নিশ্চয়ই বলবেন দেশের খেলাধুলা আগের তুলনায় এগিয়েই গেছে। চট্টগ্রামের খেলাধুলাও একটা বড় সময় পার করে ফেলেছে। যার ফলে সময়টাকে ভাগ করা যায় দু’ভাগে। সেকাল আর একাল। চট্টগ্রামের খেলাধুলার অঙ্গনও স্বাধীনতার পর শুরুতে কেমন ছিল আর এখন কেমন তার একটা মূল্যায়ন করা যায়।
স্বাধীনতার পর থেকে দেশের খেলাধুলার মতো বন্দর নগরী খ্যাত চট্টগ্রামের খেলাধুলাও ক্রমে ক্রমে এগিয়েছে। তবে এটা ঠিক যে যতটুকু যাওয়ার কথা ছিল এ অঞ্চলের খেলাধুলা হয়তো ততটুকুতে পৌঁছতে পারেনি। তবে নিশ্চয়ই এগিয়েছে চট্টগ্রামের খেলাধুলাও। সেকালের চাইতে চট্টগ্রামে খেলাধুলার একাল আরো বেশি উজ্জ্বল আরো বেশি সম্ভাবনাময়। সাবেক পূর্ব পাকিস্তান আমলে ঢাকার মতো চট্টগ্রামের খেলাধুলাও ছিল আদতে অবহেলিত। তবে এর মধ্যেও চট্টগ্রাম অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো তার স্বভাবজাত লড়াই চালিয়ে গেছে খেলাধুলার অঙ্গনেও। সেকালে চট্টগ্রামে গ্রামীণ খেলাগুলো ছিল ব্যাপক প্রচলিত। এখনো ভালোভাবেই প্রচলিত আছে বলী খেলা,নৌকা বাইচ ইত্যাদি। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলী খেলা এখনো প্রচলিত আছে। প্রতিবছরই নিয়ম করে এ বলী খেলা অনুষ্ঠিত হয় বেশ জাঁকজমকভাবে। বলী খেলা যদিও হারিয়ে যায়নি তবে গ্রামীণ অনেক খেলা হারিয়ে গেছে আধুনিক খেলাধুলার দাপটে। আধুনিক খেলাধুলার মধ্যে চট্টগ্রামে বিশেষ করে ফুটবল, ক্রিকেটের চর্চা সব চাইতে বেশি। এর পাশাপাশি আছে অ্যাথলেটিক্স, দাবা, হকি,কারাতে,জুড়ো, ব্যাডমিন্টন, তায়কোয়ানডো, টেবিল টেনিস, ভলিবল, বাস্কেটবল, শ্যুটিং, সাঁতার, কাবাডি এবং হ্যান্ডবল ইত্যাদি খেলা। চুকবল,সেপাক টাকরোর মতো নতুন খেলার চর্চাও হচ্ছে চট্টগ্রামে। তবে চট্টগ্রামের প্রধান খেলা বললে বলতে হবে ফুটবল এবং ক্রিকেটকে। স্বাধীনতার পর পর ফুটবলটাই ছিল সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
চট্টগ্রামেও ফুটবল শুরু হয় লিগ আয়োজনের মাধ্যমে। তখনকার চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া পরিষদের ব্যবস্থাপনায় প্রথম বিভাগ লিগের আয়োজন হতো এখানে। বিভিন্ন অফিস দল এবং স্থানীয় ক্লাব দলগুলো এতে অংশ নিতে শুরু করে। এদের মাধ্যমেই আস্তে আস্তে ফুটবল জমে উঠতে শুরু করে চট্টগ্রামে। দলগুলোতে স্থানীয় খেলোয়াড় যেমন ছিলেন, তেমনি ঢাকা থেকে আগত খেলোয়াড়রাও বিভিন্ন দলে অংশ নিতেন। তাঁরা সবাই মিলে জমজমাট খেলাই উপহার দিতেন। তাদের খেলা দেখার জন্য চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামের গ্যালারী উপচে পড়তো দর্শকে। সে এক আকর্ষণীয় দৃশ্য ছিল খেলার মাঠে। কি উৎসাহ আর উদ্দীপনা। চট্টগ্রামেও ঢাকার মতো আবাহনী এবং ঐতিহ্যবাহী মোহামেডানের দ্বৈরথ ছিল সবার আকর্ষণের কেন্দ্রে। চট্টগ্রামের অনেক স্থানীয় খেলোয়াড়ও ভালো খেলার সুবাদে ঢাকার বিভিন্ন নামী দামী দলের সাথে যুক্ত হতেন। তাদের অনেকেই আবার জাতীয় দলের হয়ে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন সুনামের সাথে।
এক সময়ের জমজমাট চট্টগ্রাম ফুটবল লিগ কিন্তু পরবর্তীতে মুখ থুবড়ে পড়ে নানা অব্যবস্থাপনায়। জৌলুস কমতে থাকে ফুটবল লিগের। যার ফলে চট্টগ্রাম লিগ আকর্ষণ হারাতে থাকে দর্শকদের কাছ থেকে। একটা সময় ফুটবলের এই নিখাদ বিনোদন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় চট্টগ্রামের দর্শকবৃন্দ। এখন কোন ফুটবল ম্যাচ তা প্রিমিয়ার লিগের হলেও মাঠে দর্শক খরা দেখা দেয়। বিনা টিকিটেও দর্শক আসেন না মাঠে। দর্শকদের এ অনীহা মনোভাব খেলোয়াড়দেরও খুব বেশি উজ্জীবিত করতে পারেন না। তারাও উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। ফলে চট্টগ্রামের খেলোয়াড় সংখ্যাও দিনকে দিন কমছে। বোঝা যায় চট্টগ্রামের ফুটবল আগের তুলনায় তেমন আকর্ষণীয় নয়। এ অবস্থায় আগেকার মতো তারকা ফুটবলারও চট্টগ্রাম থেকে বের হয় না। সুতরাং বলা যেতে পারে চট্টগ্রাম ফুটবল সেকালের চাইতে একালে এসে আকর্ষণ হারিয়েছে। ফুটবলের আগেকার রমরমা ভাবটি এখন নেই। পিছিয়ে গেছে চট্টগ্রামের ফুটবল। কোন দল গঠন করতে হলে চট্টগ্রামের বাইরে অন্য জেলার খেলোয়াড়দের দিকে নজর দিতে হয়। তারাই এসে খেলে দেয় চট্টগ্রামের বিভিন্ন লিগ, টুর্নামেন্ট। চট্টগ্রাম ফুটবলের দৈন্য অবস্থা এ থেকেই বোঝা যায়।
একটা সময় ছিল যখন চট্টগ্রামের ক্রীড়াঙ্গনে খেলোয়াড় সৃষ্টির প্রতিযোগিতা হতো। এখন কাউন্সিলর সৃষ্টির প্রতিযোগিতা হয়। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের একটি কালো আইন যেটির ফলে একটির স্থলে তিনটি ক্লাব প্রতিনিধি প্রাপ্তির লড়াই করতে গিয়ে দিন দিন কমে যাচ্ছে খেলাধুলার প্রতিযোগিতা। এখন চলে কেবলই কাউন্সিলর সৃষ্টির প্রতিযোগিতা। কারন যত বেশি কাউন্সিলরের পদ সৃষ্টি হবে ততবেশি অর্থ আয় করা যাবে। তাই যেনতেনভাবে একটি দল মাঠে নামিয়ে দিলেই হলো। কে খেলল বা খেলল না সেদিকে যেন মাথা ব্যথা নেই কারোই। চট্টগ্রামের ক্রীড়াঙ্গনে সেরা খেলোয়াড়টিকে দলে ভেড়ানোর জন্য এক সময় মারমারিও হতো। খেলোয়াড়কে তুলে নিয়ে গিয়ে দল বদল পর্যন্ত লুকিয়ে রাখার নজিরও রয়েছে। কিন্তু এখন ক্লাবের যিনি কর্তা তিনিও জানেন না কারা খেলছে তার দলে। কন্ট্রান্টরই সব জানে। কিছু টাকা দিয়েই যেন দায়িত্ব সারা ক্লাব কর্তার। কর্মকর্তাদের পাশাপাশি খেলোয়াড়দের মানসিকতায়ও যেন এখন পরিবর্তন এসেছে। একটা সময় ছিল যখন আবাহনী–মোহামেডানে খেলার জন্য কত চেষ্টাই না করতো খেলোয়াড়রা। কিন্তু এখন তারা সে চেষ্টা করে না। তারা মনে করে খেলে আর কি হবে। তার চাইতে বরং এলাকায় যদি প্রভাব বিস্তার করা যায় তাহলে উপার্জনটা অনেক বেশি। তাই এখন ঐতিহ্যবাহি দলে খেলার চাইতে ভাইয়ের ক্লাবে খেলতে পারলেই যেন বেশি লাভ। তখন মাঠের বাইরে প্রভাবটা বেশি খাটানো যাবে।
গত দুই দশকেরও বেশি সময়ে ক্রমশ পিছিয়ে গেছে চট্টগ্রামের ক্রীড়াঙ্গন। বিশেষ করে যখন থেকে রাজনীবিদরা ক্রীড়াঙ্গনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে তখন থেকে সবকিছুতেই যেন পেছাতে শুরু করেছে। আগে ক্রীড়া সংগঠকরা স্টেডিয়ামে আসতো নিজের ক্লাবের স্বার্থ নিয়ে কথা বলতে। ঝগড়া করতে। দাবি তুলতে, দাবি আদায় করতে। আর এখন আসে অলস সময় কাটাতে। সারা দিনের রাজনৈতিক বা ব্যবসায়ীক কর্মকান্ড সেরে সন্ধ্যায় একটু আড্ডা দেওয়ার যেন উত্তম জায়গা এখন স্টেডিয়াম। এখন যারা নিজেদের ক্রীড়া সংগঠক দাবি করেন তারা ক্লাবে ঢুকার চাইতে স্টেডিয়ামে ঢুকতেই বেশি প্রতিযোগিতা করে। পোষাকে আশাকে, গাড়ি আর বাড়িতে এখন সবাই আধুনিকতার সাথে প্রতিযোগিতা করে। কিন্তু খেলার মাঠে কিভাবে এই আধুনিকতার সাথে প্রতিযোগিতা করতে হবে সেটা জানেনা তারা কেউই। আর জানলেও সেটা করতে চায়না। যার ফলে দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে চট্টগ্রাম।
চট্টগ্রামে তখন কোনো ক্রীড়াএকাডেমি ছিল না। ফলে যারা খেলাধুলায় সারা দেশে রাজ করেছে তারা নিজেরাই দল বেধে খেলে খেলে সেরা হয়েছিল। এলাকা ভিত্তিক ক্লাব ছিল। এলাকার মানষি ক্লাবের জন্য দল বেধে নেমে পড়তো। কারন তারা জানতো এই ক্লাবের সাথে তাদের পাড়ার সম্মান জড়িত। তাই প্রতিযোগিতা থাকতো কীভাবে ভালো দল গড়ে শিরোপা জেতা যায়। হার যেন মেনেই নেওয়া যাবে না। কিন্তু এখন দল হারল কি জিতল কর্মকর্তাদের তাতে যেন কিছু যায় আসে না। ভাবখানা এমন দলতো খেলছে। কিন্তু কী খেলছে সে খবর নেওয়ার আর সময় কই কর্তা বাবুদের। এখন চট্টগ্রামে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠেছে নানা ক্রীড়া একাডেমি। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, হ্যান্ডবল কত একাডেমি। কিন্তু এইসব একাডেমি থেকে কি বের হচ্ছে সেটা বোধহয় আর বুঝতে বাকি নেই কারো। চট্টগ্রামে এখন অর্ধ শতাধিক ইভেন্ট আয়োজিত হয়। কিন্তু কোনটিই মান সম্মত নয়। কেবল হওয়ার জন্য হওয়া। অনেক খেলা আয়োজন করে বাহবাটা বেশ ভালই কুড়ানো যায় কিন্তু খেলোয়াড় বের করা যায় না সেটা বুঝে না আমাদের কর্তা বাবুরা। আর তাতেই কেবলই পিছিয়ে পড়ছে চট্টগ্রাম খেলাধুলায়। তাইতো এখন চট্টগাম থেকে আর খেলোয়াড় বের হয় না। তাইতো অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করেই এখন দিন কাটে চট্টগ্রামের।
লেখক : সিনিয়র ক্রীড়া প্রতিবেদক, দৈনিক আজাদী।