ইক্কিনি মনার গুরগুরি টেং,
কেনে মনা রেঙ্গুন গেল্
হাতর বাঁশি ফেলাই গেল্
মা–বাপ দুইজন কাঁদায় গেল্।
আসলেই তো! একটুখানি মনা, সে ছোট ছোট পা ফেলে কেমন করে রেঙ্গুন দেশে চলে গেল? ছোট্ট ময়না বাঁশী বাজাত, হাতের সেই বাঁশি ফেলে আদরের মা–বাবাকে কাঁদিয়ে মনা কেমনে রেঙ্গুন চলে গেল!
‘ইক্কিনি মনার গুরগুরি টেং’ এটি চট্টগ্রামের জনপ্রিয় একটি আঞ্চলিক ছড়া। এটি মেয়েলী গীত হিসাবেও বহুল শ্রুত। একসময় মা–দাদীরা এই ছড়া বা গান শুনিয়ে বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতেন। সে হিসাবে এটিকে ঘুম–পাড়ানী গানও বলা যায়। এই গানের পরের অংশে আছে বর্মী নারীর প্রেম–ছলনার কথা, আছে সন্তান হারানো মা–বাবার দীর্ঘশ্বাস ‘কার বুকের ধন কার কাছে গিয়ে মা–বাবাকে ভুলে গেল!’
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের প্রধানতম যে কয়েকটি ধারা তার মধ্যে একটি হলো ‘রেঙ্গুনের প্রতি আকর্ষণ ও পারস্পরিক সম্পর্ক’ নিয়ে গান (সূত্র : চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান–কল্যাণী ঘোষ)।
চট্টগ্রামের সাথে বার্মার আরকান রাজসভার সম্পর্ক ঐতিহাসিক। আরকান রাজসভায় বাঙালি লেখকদের হাতে রচিত হয়েছে অমর সাহিত্য। তারমধ্যে আলাওলের মহাকাব্য ‘পদ্মাবতী’ অন্যতম (আরকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য : আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ও ড. মুহাম্মদ এনামুল হক)। আরকান, রেঙ্গুনসহ বার্মার বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে চট্টগ্রামের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ঐতিহাসিক। এই সম্পর্ক বাংলাদেশ–বার্মার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে নুতন মাত্রা দিয়েছে। অবশ্য অন্তত চার যুগ আগে থেকে বার্মা–বাংলাদেশের সেই সোনালী সম্পর্ক আর নেই, বোধগম্য কারণে রেঙ্গুন–যাত্রায়ও বাঙালির আর মন নেই।
রেঙ্গুনের প্রতি চট্টগ্রামের মানুষের আকর্ষণ আবহমান কাল ধরে। এই আকর্ষণের প্রধান কারণ অবশ্যই অর্থনৈতিক। শতবর্ষ আগে থেকে চট্টগ্রামের সচ্ছল–অসচ্ছল–ধনী–নির্ধন লোকজন আয়–রোজগারের জন্যবার্মা–রেঙ্গুন যেত। চট্টগ্রামের অনেক বনেদি পরিবারের ব্যবসা–বাণিজ্য ছিল রেঙ্গুনে। তবে ‘অর্থ অনেক সময় অনর্থের মূল’ হয়েছে, আয়রোজগার করে পরিবারের অভাব মোচনের কথা ভুলে গিয়ে বর্মী সুন্দরীদের প্রেমে পড়তেন তারা। অনেকে সঙ্গে করে বর্মী বউ নিয়ে ঘরে ফিরতেন, কেউ কেউ সেখানে সংসার পেতে আর দেশে ফিরতেন না। যারা বিবাহিত, যারা ঘরে বউ রেখে রেঙ্গুন যেত তাদেরও কেউ কেউ রেঙ্গুইন্যা সুন্দরীর ফাঁদে পড়ে আর দেশে ফিরতেন না। ফলে দেশে থাকা স্ত্রী স্বামীর বিরহে দিনদিন নিঃশেষ হতেন। এ নিয়ে চট্টগ্রামের লোকশিল্পীরা গান বেঁধেছেন, গ্রাম্য মেয়েরা হঁলা (মেয়েলী গীত) গেয়েছেন। সেই গান–হঁলা শুনে এখনো আকুল হন বাংলার মানুষ।
ও শাম রেঙ্গুন নঅ যাইওরে…
ছোটবেলার একটা ঘটনা কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারেন না আবদুল গফুর হালী। এখন চট্টগ্রামের মানুষ দিনবদলের আশায় দুবাই–আমেরিকা–লন্ডন যান। তখন মানে চল্লিশ–পঞ্চাশের দশকে ভিনদেশে আয়–রোজগারের জন্য চট্টগ্রামবাসীর প্রথম পছন্দ ছিল বার্মা মুলুক অর্থাৎ বর্তমান মিয়ানমার। গফুর হালীর দাদা সলিম উদ্দিনও পাড়ি দিয়েছিলেন নাফ নদী, গিয়েছিলেন রেঙ্গুম রঙিলার দেশে।
অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন গফুর হালীর দাদী। সেই সুন্দরী বউকে বাড়িতে রেখে বার্মা গিয়েছিলেন তার দাদা সলিম উদ্দিন। দিন যায়, মাস যায়, বছর ফুরায়, কিন্তু দাদার খবর মেলে না। পাঁচ–সাত বছর পর একদিন শুনলেন রেঙ্গুন রঙিলার সনে তার মন মজেছে অর্থাৎ বার্মা মুলুকে আর একটা বিয়ে করেছেন সলিম সাহেব। আর এদিকে স্বামীর চিন্তায় দিন দিন ক্ষয়ে গেলেন সলিমের স্ত্রী, হালীর দাদী। স্বামীকে আর কখনোই ফিরে পাননি বিরহী ওই নারী।
পরিণত বয়সে দাদীর সেই দুঃখগাথা নিয়ে গান বাঁধেন সংগীতজ্ঞ গফুর হালী…
ও শ্যাম রেঙ্গুম নঅ যাইওরে
হনে হাইব রেঙ্গুমর হামাই–অরে শাম
রেঙ্গুম নঅ যাইওরে।
রেঙ্গুমের রেশমী শাড়ি
ন পিন্দিয়ম মুই অবল নারী রে।।
রেঙ্গুম যাইবা এক মাসর লাই
আর হনঅ দিন ফিরি ত ন আইবা রে।।
সত্তরের দশকে সেই গান গেয়েছিলেন শেফালী ঘোষ ও কল্যাণী ঘোষ। গ্রামোফোন রেকর্ডের সেই গান ঝড় তুলেছিল গোটা চট্টগ্রামে, এই গান এখনো কাঁদায় বিরহী নারীকে। এই গান এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
রেঙ্গুম রঙিলার সনে মজি রইল মন…
১৯৩২ সালে চট্টগ্রামের শিল্পী মোহাম্মদ নাসিরের কণ্ঠে কলকতার গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে বের হয়েছিল দুটি মাইজভাণ্ডারী গান। সেই গানের সংগীত পরিচালনায় ছিলেন বিখ্যাত জগন্ময় মিত্র। রেকর্ডের এক পিঠে ছিল…
বাঁশী বাজেরে হৃদ মন্দিরে কে বাঁশি ফুঁকে
এক বাজাবে গাউচুল আজম, আর বাজাবে কে?
অন্য পিঠে ছিল…
রসিক ভাণ্ডারি তোরে চিনব কেমনে
রসিক বিনে বেরসিকে জানবে কেমনে!
মূলত মোহাম্মদ নাসিরের কণ্ঠে এই গান দুটির মাধ্যমে চাটগাঁইয়া গানের বিশ্বায়ন ঘটে। কাছাকাছি সময়ে মোহাম্মদ হারুনের কণ্ঠে একটি আঞ্চলিক গান দুই বাংলায় ব্যাপক জনপ্রিয় হয়, সেটি ছিল…
রেঙ্গুম রঙিলার সনে মজি রইল মন
এই মত দিওয়াইল্যা হইয়া রইল কত জন রে
রেঙ্গুম রঙিলার রে।।
মায়ে হয়দে ওরে পুতরে রেঙ্গুম
ন যাইস তুই,
হালর গরু বেচি পুতরে
বিয়া গরাইম মুই।।
রেঙ্গুমর বার্মার মাইয়া
কত ঠমক জানে
ঝুড়ার আগাত ফুলর কলি
ইশারাতে টানে রে।।
শতবছর আগের এই গানটিতে প্রেমকাতুরে রেঙ্গুইন্যা নারীদের প্রতি বাঙালি মায়ের বিতশ্রদ্ধতা প্রকাশ পেয়েছে। কারণ ওই সময় মায়ের কাছে ছেলের রেঙ্গুন–যাত্রা ছিল চরম নিরাশার, তেমনি স্ত্রী বা প্রেমিকের কাছে ছিল চির বিরহের। ওই যে রেঙ্গুইন্যা সুন্দরীর প্রেমের ফাঁদ! তাই বিরহী নারীদের কণ্ঠে ঝরত সুরের বিলাপ, অনেকটা আসামের গোয়ালপাড়া অঞ্চলের ভাওয়াইয়া গানের মতোই, যেটা গাইতেন মাহুত বন্ধুর প্রেমে পড়া নারীরা…
তোমরা গেইলে কি আসিবেন মোর মাহুত বন্ধুরে।
হস্তির নড়ান হস্তির চরান হস্তির পায়ে বেড়ি…
ও রে সত্যি করিয়া কনরে মাহুত
কোন বা দেশে বাড়িরে..
আর গেইলে কি আসিবেন মোর মাহুত বন্ধুরে।
আবদুল গফুর হালীর ‘ও শাম রেঙ্গুমর যাইও’ গানেও প্রেমিকা তার প্রেমিককে রেঙ্গুন যেতে দিতে চান না, শীতল পাটিতে ঘুম পাড়িয়ে মশারি টাঙিয়ে সুখে রাখার লোভ দেখান। মোহাম্মদ হারুনের গানে মা রেঙ্গুন যাওয়া ঠেকাতে সন্তানকে হালের গরু বিক্রি করে বিয়া করানোর আশ্বাস দেন।
রেঙ্গুনের ‘ঠমকজানা, ছেলে–ধরা’ মেয়েদের নিয়ে বেশ রসাত্মক একটি পাল্টা (দ্বৈত) গান গেয়েছেন আঞ্চলিক গানের কালজয়ী জুটি শেফালী ঘোষ ও শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব। গানটির গীতিকার ও সুরকার শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব। গানটি এমন
চাটগাঁইয়া ছেলে :
রেঙ্গুইন্যা সুন্দরী পিচ্ছা ফিরি ফিরি
মিডা মিডা হাসি মারি যঅরগৈ হডে,
তোর পিছে ঘুরি, গেলগৈ আঁর চঅরি
দেবাইল্যা বানালি তুই চাটগাঁইয়া রে।।
রেঙ্গুনের মেয়ে :
চাটগাঁইয়া কারবারি ছাড়ি তুই ঘরবাড়ি
হন বেকবুর হত ধরি আলি এডে
আঁর পিছে ঘুরি গেলগৈ তোর চঅরি
এহন তুই কি হইতি চঅর হছো না রে।।
এটা তো গেল রেঙ্গুন তথা বার্মাইয়া নারীদের প্রতি চট্টগ্রামের ছেলে–মা বা স্ত্রীদের মনোভঙ্গি। চট্টগ্রামের প্রেমপিয়াসী তরুণদের প্রতি কেমন ছিল বার্মাইয়া নারীদের মনোভাব?
বলতে গেলে বর্মী নারীরা চট্টগ্রামের সত্যিকার প্রেমিক পুরুষদের জন্য দিওয়ানা ছিলেন। তারা একবার যাকে ভালোবেসেছেন, তাকে মনপ্রাণ উজাড় করে দিয়েছেন এবং তার জন্য দেশ–পরিবার ছাড়তেও দ্বিধা করতেন না। বছর চল্লিশ আগেও চট্টগ্রামী গৃহস্থের ঘরে বর্মী গৃহিনীদের দেখা মিলত, যাদের তখন গড় বয়স ছিল ৬০–৭০। আমার গ্রাম চকরিয়ার পহরচাঁদার কালামিয়া সর্দার পাড়ায় এরকম একজন নারী ছিলেন, যিনি আমাদের গ্রামের একজন মানুষের প্রেমে পড়ে বার্মা থেকে ঘর ছেড়েছিলেন। তাকে লোকে ডাকত ‘বউক্কার মা’। সম্ভবত বক্কর বা বাকেরের মা’ই হবেন। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় মানুষের নাম বিকৃত করা হয়। যেমন আবুল হাসেমকে ডাকা হয় আবুলআইস্যা, আকবরকে আব্বইত্যা, আমির হামজাকে আইনজা। সে হিসাবে বক্কর মা হয়ে গেছেন বউক্কার মা। তখন উনার বড় ছেলে বাদশা মিয়ার বয়সও ৫০ ছাড়িয়ে গিয়েছে। বাদশা বাজারে মাছ বিক্রি করতেন। অবশ্য আমরা কখনো ওই নারীর প্রেমিক ‘বউক্কার বাপ’কে দেখিনি, তিনি আমাদের বুদ্ধি হওয়ার আগেই প্রয়াত হয়েছেন।
আমি দাদীর কাছে শুনেছি, এই বউক্কার মা মগ ছিলেন। মগ রাজ্য ছেড়ে আমাদের গ্রামে এসে অনেক লাঞ্চনা, কষ্ট সহ্য করেছেন, মানুষের কটু কথা শুনেছেন, স্বামীর অভাবের সংসারে অনাহার–অর্ধাহারে দিন কাটিয়েছেন, কিন্তু কখনো বার্মা ফেরার চিন্তা করেননি, তার ভাগ্য নিয়ে হা–হুতাশ করেননি, আজীবন স্বামীকে মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবেসেছেন।
সাহিত্যিক আবুল ফজলের আত্মজীবনী ‘রেখাচিত্র’ গ্রন্থেও বর্মী নারীদের উথালপাতাল ভালোবাসার কথা আছে। তিনি নিজের দেখা এই রকম একজন বর্মী নারী যিনি প্রেমের জন্য দেশ ছেড়েছিলেন, তার কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন, ‘বর্মী নারী যারা একবার কাউকে ভালোবেসেছেন তার জন্য আত্মবিসর্জন দিতেও পিছপা হতেন না। তারা সব ছেড়েছুড়ে ভিনদেশে অচেনা অজানা পরিবেশে ভালোবাসার মানুষের কাছে চলে আসতেন, স্বামীর সাথে প্রেমময় সংসার করতেন’
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানে অবশ্য শুধু রেঙ্গুনের ঐতিহ্য নয়, দুবাই–লন্ডন প্রবাসী স্বামীকে নিয়েও অনেক গান রচিত হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, আবদুল গফুর হালী রচিত গানটি…
তোমার লাগি কান্দে আমার মন
স্বামী লন্ডন,
তোমার লাগি কান্দে আমার মন।
আবার খ্যাতিমান গীতিকার–সুরকার সঞ্জিত আচার্য্যের একটি গানে প্রবাসী স্বামীদের প্রতি চট্টগ্রামী নারীদের নেতিবাচক মনোভাব ফুটে উঠেছে। শেফালী ঘোষের কণ্ঠে জনপ্রিয় সেই গানটি এমন…
ন লইয়ুম ন লইয়ুম
ডুবাইঅলা জামাই আঁই,
বিয়া গরি দুইদিন পরে
যাইবগৈ ফেলাই
আঁর কি অইব উপায়।।
(সূত্র : অডিও ক্যাসেট–দুবাইওয়ালা জামাই, শাহ আলম মাইক সার্ভিস, নোয়াপাড়া, রাউজান)
আবদুল গফুর হালীর আঞ্চলিক নাটক ‘গুলবাহার’ এর কাহিনী বিস্তৃত হয়েছে চন্দনাইশের শঙ্খ খালের মাঝি সোনা মিয়া ও জেলে–কন্যা গুলবাহারকে নিয়ে। সোনাদিয়ায় মাছ মারতে গিয়ে সোনা মিয়া ঝড়ে পড়ে বার্মা উপকূলে ভেসে যান, গুরুত্বর অসুস্থতার জন্য তার অতীত স্মৃতি লোপ পায়। সেই সোনা মিয়াকে সৈকত থেকে অর্ধমৃত অবস্থায় উদ্ধার করেন বর্মী নারী মালাম্মি, পরম মমতায় সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলেন সোনা মিয়াকে। সেই সোনা মিয়ার প্রেমে পড়ে যান মালাম্মি। কিন্তু একসময় সোনা মিয়ার চেতনা ফিরে আসে, সে তার গুলবাহারের কাছে চলে আসতে চায়, গুলবাহারের জন্য মালাম্মি তার সাধের প্রেমকে বিসর্জন দেন।
এই নাটকে রেঙ্গুন তথা বর্মী নারীদের মমতাময়ী, প্রেমময়ী এবং ত্যাগী হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে।
আসলে রেঙ্গুইন্যা নারীরা অপরূপা চট্টগ্রামে কখনো কর্ণফুলী–শঙ্খ বা বাঁকখালী নদীর স্রোতধারা, কখনো সাগরের তীরহারা ঢেউ। ‘রেঙ্গুমের বর্মার মাইয়া’রা চট্টগ্রামী পুরুষদের কাছে প্রেমপুস্প, মালাম্মিদের কেউ কেউ ভালোবাসার সৌরভ ছড়িয়েছে, অনেকে ঝরে গেছে অকালে, ফুল ফোটার আগেই।
নাসির উদ্দিন হায়দার, চট্টগ্রামের লোকসংগীত গবেষক ও সাংবাদিক