‘নিম্নবঙ্গের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা চাটগাঁ। নিচু টিলা, চুড়োয় বাড়ি, পাকদণ্ডী (ঘুরপথ) বেয়ে উঠতে হয়। কোনো কোনো পাহাড়ে চমৎকার সব দৃশ্য চোখে পড়ে। দূরে দিগন্তে কর্ণফুলী গিয়ে মিশেছে সমুদ্রে, চারপাশে ছড়ানো–ছিটানো পাহাড়ের চুড়োয় বিন্দুর মতো সাদা বাংলো, মাঝে মাঝে বৃক্ষের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে মন্দির বা মসজিদ। পাহাড়ের ওপর থেকে নিচে তাকালে চোখে পড়ে সরু রাস্তা, উপত্যকা।’ ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রাম নগরের বর্ণনা এভাবে উঠে আসে তৎকালীন কালেক্টর এ এল ক্লে–এর আত্মজীবনীমূলক বই ‘ফ্রম আ ডায়েরি ইন লোয়ার বেঙ্গল’–এ।
বলতে গেলে পাহাড়ের সেই আকার ও বাহার আজ আর নেই। চট্টগ্রামকে ক্লে সাহেবের বর্ণনায় দেখতে গেলে তা কেবল অচেনাই মনে হবে। ইংরেজ শাসনের পর পাকিস্তানের ২৪ বছরে কমেছে পাহাড়ের সংখ্যা। স্বাধীনতার পর পাহাড় কাটার পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার নিয়েছে।
চট্টগ্রামের পাহাড় কাটা নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক এস এম সিরাজুল হক একটি বেসরকারি সংস্থার হয়ে ২০১১ সালে ‘হিল কাটিং ইন অ্যান্ড অ্যারাউন্ড চিটাগং সিটি’ শীর্ষক এক গবেষণা করেন। এতে বলা হয়, বেশির ভাগ পাহাড় কাটা হয় পাহাড়তলী, খুলশী, বায়েজিদ, লালখান বাজার মতিঝরনা, ষোলশহর এবং ফয়’স লেকে। ১৯৭৬ থেকে ৩২ বছরে চট্টগ্রাম নগর ও আশপাশের ৮৮টি পাহাড় সম্পূর্ণ এবং ৯৫টি আংশিক কেটে ফেলা হয় বলে গবেষণায় উল্লেখ করেন। ১৯৭৬ সালে নগরের পাঁচ থানা এলাকায় মোট পাহাড় ছিল ৩২ দশমিক ৩৭ বর্গকিলোমিটার। ২০০৮ সালে তা কমে হয় ১৪ দশমিক ০২ বর্গকিলোমিটার। এ সময়ে ১৮ দশমিক ৩৪৪ বর্গকিলোমিটার পাহাড় কাটা হয়। এটা মোট পাহাড়ের প্রায় ৫৭ শতাংশ। নগরের বায়েজিদ, খুলশী, পাঁচলাইশ, কোতোয়ালি ও পাহাড়তলী থানা এলাকায় এসব পাহাড় কাটা হয়। সবচেয়ে বেশি ৭৪ শতাংশ কাটা পড়ে পাঁচলাইশে।
এদিকে ২০১৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ন্যাচারাল অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেসে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপর এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ‘এনভায়রনমেন্টাল ডিগরিডেশান থ্রো হিল কাটিং ইন চিটাগং ডিসট্রিক্ট অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণাকর্মটি হয় ২০০৫ সালে। এর নেতৃত্বে ছিলেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক এম এ সাত্তার। এই প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রাম নগরের খুলশীতে সর্বোচ্চ ৬৩ দশমিক ৬ শতাংশ এবং শহরতলির চৌধুরীহাট এলাকায় সর্বনিম্ন ২০ শতাংশ পাহাড় কাটা হয়। ৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে এসব পাহাড় কাটা হয়। নগর ও আশপাশের ২০০ পাহাড়ের মধ্যে প্রায় ১০০টি কেটে বিভিন্ন আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে বলে গবেষণায় বলা হয়।
গত ২২ এপ্রিল দৈনিক আজাদীর এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, নগরীর আসকার দীঘির পাড় এলাকায় পাহাড় কেটে গড়ে উঠছে বহুতল ভবন। সেখানে সিডিএ অভিযান চালালো সোমবার। প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাহাড় কেটে বহুতল ভবন নির্মাণের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে নগরীর আসকার দীঘির পাড় এলাকায় একটি ভবন ভাঙা শুরু করেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। সিডিএ’র নোটিশের বিরুদ্ধে আদালতে গিয়ে স্থগিতাদেশ আনেন ভবন মালিকেরা। ওই আদেশের বিরুদ্ধে আদালতে যায় সিডিএ। আদালত উক্ত স্থগিতাদেশ বাতিল করার একদিনের মধ্যেই ভবনটি ভাঙার অভিযান পরিচালনা করে সিডিএ। সিডিএ চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার নুরুল করিমের উপস্থিতিতে ভবনটি ভাঙার কাজ শুরু হয়। এই সময় সিডিএ চেয়ারম্যান বলেন, ভবিষ্যতে এভাবে যেন পাহাড় কাটার সুযোগ কেউ না নিতে পারে সে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। চট্টগ্রাম মহানগরীর পাহাড়গুলো রক্ষা করার প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগই নেয়া হবে বলেও তিনি জানান। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে পাহাড়ে আঁচড় দিতে কেউ যাতে দুইবার ভাবে আমরা সেই ব্যবস্থা করে যাবো।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘চট্টগ্রাম নগরের মধ্যে এত দিনে যে কয়েকটি পাহাড় সাবাড় করে দেওয়া হলো, তার দায় প্রধানত সিডিএ এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের ওপর পড়ে। অন্য ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, পরিবেশ ঠিক রেখে উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য যে সংস্থা নিয়োজিত, তারাই পাহাড় সাবাড় করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। উন্নয়নশীল দেশের রূঢ় বাস্তবতার কারণে কারখানা, রাস্তাঘাট দরকার। কিন্তু তা গড়তে গিয়ে পরিবেশ ধ্বংস করলে চলে না। যে পাহাড়গুলো ধ্বংস করা হচ্ছে তার ক্ষতি জরিমানা দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়। স্বীকার্য যে প্রগতির রথ দ্রুত ধাবমান। কিন্তু তারও আগে স্বীকার করতে হবে, প্রকৃতিকে ভুলে উন্নয়ন হয় না।’ তাই সবার আগে পাহাড়খাদক লোভী ও পরিবেশের সেই সব শত্রুর শিকড় উৎপাটন করা জরুরি। চট্টগ্রাম মহানগরীর অবশিষ্ট পাহাড়গুলো রক্ষা করা দরকার।