চট্টগ্রামেও প্রতিবাদ বিক্ষোভ

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ৬ অক্টোবর, ২০২০ at ৬:১৫ পূর্বাহ্ণ

দিন দিন বাড়ছে ধর্ষণ নামের নির্মমতা। ধর্ষণ কিংবা গণধর্ষণই শেষ নয়; অনেকক্ষেত্রে ধর্ষিতাকে খুন করা হচ্ছে নৃশংসভাবে। এসব ঘটনায় ক্ষোভ বিক্ষোভ বাড়ছে। মানববন্ধন হচ্ছে দেশের আনাচে কানাচে। অপরাধীদের ফাঁসির দাবি জোরালো হচ্ছে। আল্টিমেটাম দেওয়া হচ্ছে কখনো ৪৮ ঘণ্টার, কখনো আবার তিন দিন থেকে সাত দিন পর্যন্ত। পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, অন্য ঘটনার আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় পুরনো ঘটনা। নতুনটা নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে, পুরনোটা চাপা পড়ে যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিটি পরিবারে যেমন কন্যা সন্তান আছে, তেমনি ধর্ষকরাও কোনো না কোনো পরিবারের সন্তান। তাই ধর্ষণের মতো সামাজিক মরণব্যাধি নির্মূলে প্রত্যেকটি পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয়ভাবে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগের মধ্য দিয়ে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে হবে। দোষীদের উপযুক্ত বিচার হচ্ছে না বলেই এ ঘটনা বারবার ঘটছে জানিয়ে বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী এডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান বলেন, ধর্ষণ মামলাগুলো খুব স্পর্শকাতর মামলা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের পুরো সিস্টেমটা নারী ও শিশু বান্ধব না। মেডিকেলে গেলে কখনো বলে পুলিশ নেই, কখনো বলে ডাক্তার নেই। ধর্ষণের শিকার নারী ওসিসিতে যাওয়ার পর নানাভাবে হয়রানির শিকার হন। নির্যাতিতা যদি গরীব হন, তবেতো কথাই নেই। গাফিলতি কী ধরনের জানতে চাইলে তিনি বলেন, ধর্ষণের আলামতগুলো যথাযথ ভাবে সংরক্ষণ করা হয় না। রেপ কেইসের ক্ষেত্রে ভিকটিমের পরিধেয় কাপড় গুরুত্বপূর্ণ আলামত। অবিবাহিত হলে ভিকটিমের পরিধেয় কাপড় এক সপ্তাহের মধ্যেই পরীক্ষা করতে হয়। আর বিবাহিতের ক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টা পেরুলেই আলামত নষ্ট হয়ে যায়। অনেক সময় দেখা যায় সব কিছু শেষ, সার্টিফিকেট দিতে গড়িমসি করে। সার্টিফিকেট না পেলে মামলা হয় না। এজন্য এ ধরনের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে আলামত পরীক্ষা সংক্রান্ত জটিলতাগুলো দূর করা প্রয়োজন।
অবিলম্বে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে ধর্ষক ও নিপীড়কদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি উঠেছে চট্টগ্রামে সর্বস্তরের সচেতন নাগরিকের ব্যানারে। তাঁরা বলেছেন, দেশের নারী সমাজকে সুরক্ষিত করতে হলে অবিলম্বে বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান ঘটাতে হবে। গতকাল ৫ অক্টোবর সোমবার বিকেলে নগরীর চেরাগি পাহাড় মোড়ে আয়োজিত সমাবেশে বক্তারা এসব কথা বলেন। ‘শুধু গ্রেপ্তার নয়, দ্রুত বিচার নিশ্চিত কর’ স্লোগানে আয়োজিত সমাবেশ থেকে ধর্ষকদের পৃষ্ঠপোষকদের চিহ্নিত করে তাদের বিচার ও সামাজিকভাবে বয়কট করার দাবি জানানো হয়।
কবি কামরুল হাসান বাদল বলেন, দেশে যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে তাতে কেবল একজন মা বা একজন বোন ধর্ষিতা হচ্ছে তা কিন্তু নয়। ধর্ষিত হচ্ছে একজন মানুষ, ধর্ষিত হচ্ছে এই সমাজ। সাংস্কৃতিক চর্চার অনুপস্থিতি, রাজনীতির নামে দুর্বৃত্তদের পৃষ্ঠপোষকতা, নারী বিরোধী প্রচারণা এবং মিথ্যার প্রসার ঘটায় নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে গেছে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে অবশ্যই বিচার যে হয় সে সত্য প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। বিচার হয় না বলেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
গণজাগরণ মঞ্চের সমন্বয়ক শরীফ চৌহান বলেন, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন বন্ধ করতে হলে অবশ্যই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শুধু সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় বলে ছেড়ে দিলে হবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও সক্রিয় হতে হবে। যে ঘটনা নিয়ে আলোচনা হবে সেটার ক্ষেত্রেই কেবল সরকার সক্রিয়তা দেখালে হবে না। দীর্ঘসূত্রিতা পরিহার করে দ্রুত বিচার ও রায় কার্যকর করতে হবে।
আবৃত্তিশিল্পী রাশেদ হাসান বলেন, বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার করতে না পারলে এ ঘৃণ্য প্রবণতা রুখে দেওয়া যাবে না। সাংস্কৃতিক চর্চার অনুপস্থিতি, নানা রকম রাজনৈতিক অপশক্তির পৃষ্ঠপোষকতা ধর্ষকদের বেপরোয়া করে তুলেছে। বিচার ও শাস্তিতে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা গেলে নারী নিপীড়ন বন্ধ করা যাবে। সেজন্য আমাদের সবাইকে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখতে হবে।
সাংবাদিক প্রীতম দাশের সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সিতারা শামীম, সাংবাদিক আহমেদ মুনীর, সৌমেন ধর, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের প্রচার সম্পাদক মিন্টু চৌধুরী, আবৃত্তি শিল্পী প্রণব চৌধুরী, নারী শ্রমিক নেত্রী বাপ্পী দেব বর্মণ, সাবেক ছাত্রনেতা নাজিম উদ্দিন, সাংবাদিক মহররম হোসাইন, লতিফা আনসারী রুনা, হিউম্যানিটি ফার্স্ট মুভমেন্টের মিলন রায় প্রমুখ।
এছাড়া ‘সর্বস্তরের সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের’ ব্যানারে গতকাল মানববন্ধন হয়েছে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব চত্বরে। এরপর একটি মৌন মিছিল প্রেস ক্লাব থেকে শুরু হয়ে চেরাগী পাহাড় মোড় হয়ে পুনরায় প্রেস ক্লাব এসে শেষ হয়। মানববন্ধন ও মৌন মিছিলে বক্তারা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন।
মৌন মিছিলে একাত্মতা পোষণ করেন ন্যাশনাল পিপলস্‌ পার্টির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মুকতাদের আজাদ খান, চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্রের সভাপতি সোহেল মো. ফখরুদ্দিন, সাংবাদিক মো. কামাল হোসেন, আতাউল গণি, মাহবুবুল আলম বাপ্পী, রিয়াজুল করিম রিজভী, জাহিদ হোসাইন, মো. ইমন, রবিউল হাসান, নাজমুল হুদা, মো. হাসিব, দিপ্ত, নুসরাত মিফতা, মিলন হোসেন, আবদুর রহমান, প্রলয় দাশ প্রমুখ।
এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গাজীপুরে শিশু আয়েশাকে ধর্ষণের বিচার পাননি পিতা হায়দার আলী। না পেয়ে দরিদ্র পিতা হায়দার আলী মেয়েকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ দেন। ঘটনাটি সভ্য সমাজের মুখে যে কালিমা লেপন করেছে, তা আজো মুছে নি। কেননা প্রতিনিয়ত ধর্ষিত হচ্ছে, বাড়ছে ধর্ষণের পর হত্যা। একই সঙ্গে বাড়ছে নিষ্ঠুরতা। হায়দার আলীর মেয়েই শুধু নয়, এই দেশে এমন অনেক হায়দার আলী আছেন, যারা আলোচনায় আসেননি। নীরবে কত-শত হায়দার-আয়েশার প্রাণ প্রদীপ নিভছে, কে রাখে তার খবর। গণমাধ্যমে এলেই এসব নিয়ে হইচই শুরু হয়। কখনো বিউটি, কখনো সীমা কিংবা ইয়ানমিন, কখনো রূপা, তনু, আয়েশা- এদের অসময়ে চলে যাওয়ার কথা ছিল না, যে সময়টাতে তাদের স্বপ্ন দেখার, বাঁচতে শেখার কথা। এখন আর নীরব থাকার সময় নেই। দেশের প্রতিটি প্রান্তে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। এটা একদিনে হয়নি। কারা এই ধর্ষকদের আশ্রয়দাতা ‘বড় ভাই’ তাদের খুঁজে বের করে শাস্তি দিতে হবে। প্রশ্রয় না পেলে এমন সীমাহীন অপরাধ প্রবণতার সৃষ্টি হতো না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বাস্থ্য পরিচালক, সিভিল সার্জনসহ ১৫ হাসপাতাল ক্লিনিকে দুদকের চিঠি
পরবর্তী নিবন্ধসারা দেশে ক্ষোভ, ধিক্কার