‘দেখ চেয়ে ওই ঝর্ণা ধারা কেমন বয়ে যায়
ঝিকমিকিয়ে মাঠের পরে ছায়াপথের পায়
ঘুমিয়ে ছিল সে এতোদিন মেঘের স্বপনলোক
বনগিরির শীর্ষে গিয়ে খুললো তাহার চোখ ’
অথবা কবি নজরুল তাঁর গানে চঞ্চলা চপলা ঝর্ণাকে ডেকেছিলেন ‘ পাষাণ গিরির বাঁধন টুটে , নির্ঝরিনী আয় নেমে আয়, ডাকছে উদাস নীল পারাবার , আয় তটিনী আয় নেমে আয় ’
পাহাড়ের শীর্ষ চূড়া থেকে নেমে আসা ঝর্ণাধারার অপরূপ সৌন্দর্য কাছে থেকে অবলোকন করার মজাটাই আলাদা। পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দারবানের খাড়া উঁচু পাহাড় থেকে নেমে আসা অজস্র ঝর্ণধারা খলখল ছলছল গতিতে ছুটে এসে সাঙ্গু নদী হয়ে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। সাঙ্গুনদীপথে গিয়ে রেসাং ঝর্ণার অপার সৌন্দর্য খুব কাছে থেকে উপভোগ করেছি। কি প্রবল স্রোতে এই ঝর্ণা পাহাড়ের চূড়া থেকে নেমে এসেছে মিশেছে সাঙ্গুর শীতল জলে। তবে বান্দরবানের বিখ্যাত ঝর্ণা রেমাক্রি, অমিয়কুম এবং নাফাকুম যাবার সৌভাগ্য হয়নি। তাই রেমাক্রি জলপ্রপাত দেখার অদম্য বাসনায় নেমে পড়েছিলাম দুঃসাহসিক এক অভিযানে। আমি, সুমনা, ফরিদা আর শুভ্রা, সাথে মেয়ে বাবুই। এই পাঁচজন সাহসী মানবী বান্দরবান থেকে ছুটলাম থানছির উদ্দেশ্যে। থানছি বাজার হয়ে সাঙ্গুনদী পথে যাবো রেমাক্রি ঝর্ণায়। ভাগ্যিস সড়কপথে বিজিবি চেকপোস্টে এক চমৎকার জলপাই জুস পান করে প্রাণশক্তি সঞ্চয় করেছিলাম। না হলে এই দুর্গম গিরি কান্তার মরু পাড়ি দেয়া সত্যিই দুঃসাধ্যই হয়ে পড়তো। সেখান থেকে আবার যাত্রা থানছি বাজার। এবং সেখানেই সম্ভবতঃ সড়কপথের সমাপ্তি। এবার বিজিবি থেকে ছাড়পত্র নিয়ে সেই সুউচ্চ পথ থেকে নামতে হবে অনেক নীচে, সাঙ্গুনদীঘাটে। এই নৌপথ ছাড়া রেমাক্রি যাবার আর কোনো পথ নেই। আবার নৌকাগুলোও অদ্ভুত রকমের একবারে নীচু, বেশি বড় না, পেটের দিকে খানিকটা বড়, উচ্চতা বলতে কিছুই নেই। এই যে বিশাল বপু নিয়ে নৌকায় গিয়ে কোনোরকমে বসেছি তো, আর নড়াচড়ার জো নেই। তবে সঙ্গীরা আমার চেয়ে অপেক্ষাকৃত সরু, তাদের অত কষ্ট হয়নি, যে কষ্ট এই দীর্ঘ নৌ ভ্রমণে আমি পেয়েছি। আমাদের কারো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না, কারো কাছ থেকে কোনো ধারণা পেয়েছি এমনও না, একেবারে অজানা–অদেখা নিরিবিলি এই পাথুরে খরস্রোতা নদী পথেই তরতর করে এগিয়ে চলেছি রেমাক্রি জলপ্রপাতের কলধ্বনি শোনা আর তাঁর অসাধারণ সুন্দর দেখে তার সাথে মিতালী করার বাসনায়। সময়টি ছিল শীতকাল। একটি মাত্র আদিবাসী ছোকরা হাতে বৈঠা আর বাঁশ দিয়ে টেনে টেনে স্রোতের বিপরীতে নিয়ে যাচ্ছে এই নৌকাটিকে। নৌকা চলতে শুরু করলো সাঙ্গুর বুক চিরে। বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দে নদীর জল যেন মেতে উঠলো অন্যরকম এক সুন্দরের মূর্চ্ছনায়। দ’ুপাশে এখনো শস্যক্ষেত, কাছে ও দূরে আদিবাসীদের পাড়া আর ঘন সবুজ বনবনানী দেখতে দেখতেই আমরা ছুটেছি সাঙ্গুর পাথুরে জলের খলখল ছলছল ছন্দের ভেতর দিয়ে। যতোই এগুচ্ছি, যেন অদ্ভুত সুন্দরের হাতছানি। ভয় আর ক্লান্তি নিমিষেই উবে গিয়ে সুন্দরের আরাধনায় যেন তন্ময় হয়ে রইলাম। সাঙ্গুর দু’তীর ঘেঁষে বিশাল–বিশাল পাথুরে পাহাড়, পাহাড় বললে ভুল হবে পর্বত শৃঙ্গ বলতে হবে। কোনোটা একেবারেই খাড়া, কোনোটা ঢেউকাটা অথবা তৃণলতাগুল্মরাজির জৌলুসে সাঙ্গুতীরে অসামান্য বৈভব আমাদেরকে চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে যাচ্ছে সমুখের পানে। সাঙ্গুর স্বচ্ছ জল যেন কাঁচকাটা হীরে। জলের তলে সবুজ শ্যাওলা রেশমি গালিচা পেতে রেখেছে। নদীর জল যেন সবুজে সবুজ। কোথাও ঘোলা, কোথাও কাঁচের মতো স্বচ্ছ, কোথাও বা তীব্র খরস্রোতা পাথরে পাথরে ভরা। এই দৃশ্যপট দেখতে দেখতেই তরীখানি এসে ভিড়লো বিজিবির তিন্দু চেকপোস্টে। বালক মাঝি তরীকে বেঁধে চেকপোস্টে গিয়ে অনুমতিপত্র দেখালেই আমরা আরো গহীনে যাবার সুযোগ পাই। এখানে জল প্রচণ্ড স্রোতস্বিনী। কোথাও হাঁটু সমান জল, কোথাও আরেকটু বেশি। পাথর আর শ্যাওলার জটলা মাড়িয়ে আমরা এক নিঝুম নিরালা পথে চলছি তো চলছি। বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ আর জলের গান ছাড়া আর কোনো শব্দ এখানে নেই। পাখপাখালি তেমন নেই; তবে নানাবিধ ভেষজ লতাপাতা, ফুল, তৃণ এখানে রচনা করেছে অন্যরকম এক মোহনীয় ভুবন। আমরা নদীর জলে কাঠের সেঁওতিতে, মাথার উপরে নীল আকাশের চাঁদোয়া, দুপাশে বিশাল বিশাল পর্বতমালা স্থির, দাঁড়িয়ে রয়েছে ধ্যানী মুনি ঋষিদের মতো। কিছুদূর এগুলেই পেলাম বড় পাথর নামের এক জায়গা। সেখানে নদীতে ছড়িয়েছিটিয়ে দন্ডায়মান বিশাল বিশাল পাথরের খণ্ড। এসব বড় বড় পাথরখণ্ড একটি অপরটির এতো কাছে, মাঝে কেবল একটি নৌকা যাবার পথ খোলা। এই পথ কারো তৈরি না, প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই সাজানো। কোনোকালে, কোনো সময়ে পাথুরে পাহাড় ধসে নদীর জলে পড়ে এই পথের সূচনা করেছে। আর বড় বড় প্রস্তরখণ্ডগুলো যেন একএকটি কোন নিপুণ শিল্পীর বানানো অসাধারণ ভাস্কর্যস্বরূপ। একেবারেই প্রাকৃতিক পাহাড়ের প্রস্তরখণ্ডের রূপমাধুরী যে এতো সুন্দর হতে পারে, তা নিজ চোখে না দেখলেই অনুমান করা কঠিন। আর দুপাশের শৈলশ্রেণি যেনো অপূর্ব খাঁজে কাটা। পুরো পাহাড়জুড়ে নান্দনিক কারুকাজের ছড়াছড়ি। যতোই দেখছি, ততোই অবাক হচ্ছি। আর ভাবছি পাথুরে পাহাড়ের এতো বৈভব! এমন নান্দনিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে বড় পাথর, ছোট পাথর পেরিয়ে যতই এগুচ্ছি, রেমাক্রির জলনাদ একটু একটু যেনো কানে বাজছে। এদিকে ক্ষিধের জ্বালায় অস্থির, সাথে তেমন খাবার ছিল না। চলতে চলতে এমন এক জাগায় গেলাম, যেখানে সাঙ্গু একেবারে সরু হয়ে বাঁক নিয়েছে। আর জল এতই খরস্রোতা, নৌকা চড়ে এগুনো যাবে না। সে জায়গায় পাথরের তীরে নেমে বেশ কিছুদূর হেঁটে যেতে হবে। আমার সঙ্গীরা লাঠি হাতে পাথুরে পথ বেয়ে এগুচ্ছে। আমিই রয়ে গেলাম নৌকায়। মাঝি আমাকে একাই পাড়ি দিল প্রচণ্ড খরস্রোতা এই জলপথে। সঙ্গীদের এসে পৌঁছাতে বিলম্ব হলো। আমি আগেই এসে পড়লাম। সেই ছোট ঘাটে পাহাড়িরা পাকা কলা আর পাকা পেঁপের পসরা নিয়ে বসেছে। ক্ষিধের তাড়নায় ফটাফট কিনে খাওয়া শুরু করলাম। এরই মাঝে সঙ্গীরা এসে পড়লো। তারাও সেই ফল খেয়ে একটু চাঙ্গা হলো। আবার যাত্রা শুরু, সামান্য পথ গেলেই রেমাক্রির দেখা মিলবে, তা অবিরাম জলপতনের ছন্দে বুঝতে আর বাকি রইলো না। যখন কাছে এলাম, জলধারার সুন্দর দেখে অভিভূত হলাম। কি অপূর্ব এক জলরাজ্য। সাদা বকের মতো ধবল ফেনিল জলরাশি কত স্তরে কত ধাপে এখানে উপচে পড়ে এক স্বর্গীয় সোপান তৈরি করেছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি মৎস্যকুমারীর মতো কোনো এক রাজকন্যা এই জলের বুক চিড়ে ধেয়ে আসবে ধুলির ধরায়। এখানে অন্য কোনো শব্দ নেই, কেবল জলপতনেরই ছন্দ এলাকাজুড়ে। ঝপঝপ ছলছল খলখল জলবতীর নূপুরের নিক্কণ। স্বপ্নের মতো বিভোর ছিলাম জলকুমারীকে দেখার আশায়। এদিকে আমার ডানপিটে আর উচ্ছ্বল সঙ্গিনীরা রেমাক্রির থেকেও চঞ্চল হয়ে উঠেছে। ফটাফট জলে নেমে তারা রেমাক্রির জলতরঙ্গের সাথে মেতে উঠেছে। কেউবা বসে পড়েছে, কেউবা শুয়ে গেছে, কেউবা এই শীতল ঠাণ্ডা জলে যেন সাঁতার কাটছে। আর আমি অধম বসে রইলাম ‘তরীখানি যেই ঘাটে বাঁধা ছিল সেইখানে। অবশ্য আমাকে এক পা–ও ছেড়ে যায়নি বাবুই সোনা। অথচ তারই কথা জলের সাথে লম্ফঝম্ফ করার।
আমি অনেক বলে কয়েও তাকে বিন্দুমাত্র নড়াতে পারিনি। আমাকে নিরাপদ রাখা যেন সেদিন তার ব্রত ছিল। নৌকা থেকে নামতে না পারার কারণ, রেমাক্রির পাথরকণা বড়ই পিচ্ছিল। পাথরে শ্যাওলা। যদি হঠাৎ পা পিছলে পড়ি তো আর রক্ষা পাবো না। যে কঠিন পথ মাড়িয়ে এসেছি, সেই পথে ফিরতে নিজেকে সুস্থ রাখতে হবে। তাই জল উৎসবে মেতে ওঠার বাসনা ত্যাগ করলাম। কেবল নৌকায় বসে রেমাক্রির ধবল ফেনিল জলে পা ডুবিয়ে নিজেকে শীতল করলাম। তবে বন্ধুদের লাফালাফি আর দাপাদাপি দেখেই প্রাণ জুড়িয়ে গেল। সেই সাথে আমাদেরও রেমাক্রি থেকে বিদায় নেবার সময় হয়ে এলো। ফেরার পথে ভাবছিলাম, এই দুর্গম এবং নিঃসন্দেহে দুঃসাহসিক এই পথে হয়তোবা আর কোনোদিনও আসা হবে না। আসার সাহসও থাকবে না।