চকরিয়া থানা হাজতে স্কুলের অফিস সহকারীর রহস্যজনক মৃত্যু

টাকা আত্মসাতের অভিযোগে রাতে পুলিশে সোপর্দ, সকালে মিলল মরদেহ

চকরিয়া প্রতিনিধি | শনিবার , ২৩ আগস্ট, ২০২৫ at ৬:০৯ পূর্বাহ্ণ

চকরিয়া থানা হাজতের একটি কক্ষে রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে চকরিয়া সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর দুর্জয় চৌধুরীর (২৫)। তিনি চকরিয়া পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ভরামুহুরী হিন্দু পাড়ার কমল চৌধুরীর পুত্র। পুলিশ এই ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে দাবি করলেও তা মানতে নারাজ পরিবার। তাদের দাবি, দুর্জয়কে থানার হাজতখানা থেকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনে হত্যা করা হয়েছে। এরপর অবস্থা বেগতিক দেখে তাকে ঝুলিয়ে রেখে আত্মহত্যা করেছে মর্মে প্রচার করা হয়েছে।

পুলিশ জানায়, চকরিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ফান্ডের ২ লাখ ৮৩ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রাবেয়া খানম বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে লিখিত অভিযোগসহ দুর্জয়কে থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করেন। এ সময় বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রূপায়ন দেবও থানা হাজতে দুর্জয়কে রাখার জন্য নির্দেশ দেন ওসিকে। এরপর যথারীতি জিডিমূলে দুর্জয়কে থানার হাজতের একটি কক্ষে রাখা হয় পরদিন আদালতে সোপর্দ করার জন্য। কিন্তু ভোররাতে নিজের পরনের শার্ট ব্যবহার করে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে সে। এর আগে প্যান্টের বেল্ট দিয়েও আত্মহত্যার চেষ্টা করে সে। যা হাজতখানার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে নিশ্চিত হয় পুলিশ।

এই ঘটনা নিয়ে চকরিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. শফিকুল ইসলাম জানান, সরকারি বিদ্যালয়ের টাকা আত্মসাতের ঘটনা নিয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক লিখিত অভিযোগসহ দুর্জয়কে থানায় নিয়ে আসেন বৃহস্পতিবার রাত ১১টার পর। এ সময় তাকে (ওসি) দুর্জয়ের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করে আদালতে চালান দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন প্রধান শিক্ষক। বিষয়টি বিদ্যালয়ের সভাপতি এসি ল্যান্ড রূপায়ন দেবকে জানালে তিনিও প্রধান শিক্ষকের মতো দুর্জয়ের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। তাই নিয়মানুযায়ী জিডিমূলে দুর্জয়কে থানার হাজতে রাখা হয়।

ওসি শফিকুল ইসলাম বলেন, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে ডাকাত ধরার অভিযানে যাই উপজেলার সাহারবিল ইউনিয়নের একটি দুর্গম এলাকায়। এতে নেতৃত্ব দেন কঙবাজার জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জসীম উদ্দিন। এ সময় সাথে ছিলেন চকরিয়া সার্কেলের এএসপি অভিজিত দাসসহ সঙ্গীয় পুলিশ। অভিযানে আটক করা কয়েকজন অপরাধীকে থানার হাজতকক্ষে রাখতে গিয়ে দেখতে পান সেখানে একটি কক্ষে দুর্জয় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে ঝুলে রয়েছে।

চকরিয়া থানা হাজতে দুর্জয় আত্মহত্যা করেছে বলে নিশ্চিত করেছেন কঙবাজার জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জসীম উদ্দিন। তিনি দৈনিক আজাদীকে বলেন, থানা হাজতের নিরাপত্তায় থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হওয়া যায় রাত ১টা ১২ মিনিট পর্যন্ত দুর্জয় ভেতরে পায়চারি করেছেন। এর আগে প্যান্টের বেল্ট দিয়েও আত্মহত্যার চেষ্টা করে সে। কিন্তু সেই চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় এবার পরনের ফুলহাতা শার্ট দিয়ে গলায় পেঁচিয়ে গ্রিলের লোহার সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করে দুর্জয়।

জেলা পুলিশের মুখপাত্র আরও বলেন, চকরিয়া থানার হাজতখানায় চারটি আলাদা কক্ষ রয়েছে। তদ্মধ্যে একটি কক্ষে রাখা হয়েছিল তাকে। তবে এই ঘটনার পেছনে থানার কারও গাফেলতি রয়েছে কী না তা তদন্ত করতে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটির প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাজতখানার দায়িত্বে নিয়োজিতদের ব্যাপারে পরবর্তী আরও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

এদিকে থানা হাজতখানার কক্ষে দুর্জয়কে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে দাবি করে জড়িত পুলিশ সদস্য এবং কথিত অভিযোগে পুলিশে সোপর্দকারী বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাবেয়া খানমসহ কয়েকজন শিক্ষককে গ্রেপ্তারসহ তাদের বিচার দাবিতে থানার সামনে বিক্ষোভ করেন স্বজন ও স্থানীয় জনতা। পরে বিকেল ৪টার দিকে চট্টগ্রামকঙবাজার মহাসড়কের চকরিয়া থানা রাস্তার মাথা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন তারা। এ সময় উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রূপায়ন দেব, চকরিয়া সার্কেলের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) অভিজিত দাসসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা ক্ষুব্ধ জনতার কাতারে গিয়ে বক্তব্য দেন।

পুলিশ কর্মকর্তা অভিজিত দাস বলেন, এই ঘটনায় ইতোমধ্যে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে থানার ডিউটি অফিসার ও হাজত খানার দুই সেন্ট্রিকে (কনস্টেবল)। তিনি আরও বলেন, বিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কারো বিরুদ্ধে যদি পরিবারের অভিযোগ থাকে তাহলে তাও তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

অবরোধস্থলে বক্তব্য দেন চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রূপায়ন দেব। পদাধিকারবলে তিনি চকরিয়া সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটিরও সভাপতি। এসি ল্যান্ড রূপায়ন দেব বলেন, দুর্জয়কে যদি পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়ে থাকে তাহলে তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে। প্রয়োজনে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করা হবে। তাই জনদুর্ভোগ এড়াতে যানবাহন চলাচলে স্বাভাবিকতা ফেরাতে আপনাদের প্রতি অনুরোধ করছি। এরপর ক্ষুব্ধ জনতা বিকেল ৫টার দিকে মহাসড়ক থেকে অবরোধ তুলে নিলে প্রায় একঘণ্টা পর যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়। এ সময় সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা সেখানে দায়িত্ব পালন করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঘুষ গ্রহণের ভিডিও ভাইরাল, জিআরওকে প্রত্যাহার
পরবর্তী নিবন্ধচোর সন্দেহে ‘মব’ করে তিন কিশোরকে বেঁধে মারধর, একজন নিহত