প্রতিবছরের ন্যায় এবারও কক্সবাজারের চকরিয়ায় বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। বর্তমানে মাঠে মাঠে চলছে বোরো ধান কর্তন। প্রান্তিক কৃষকেরা সেই ভোর থেকে রাতে চাঁদের আলোয়ও ক্ষেতের ফসল গোলায় তোলায় মহা ব্যস্ত সময় পার করছেন। কৃষকেরা বলছেন, নিরবচ্ছিন্ন সেচ সুবিধা, আবহাওয়াসহ সার্বিকভাবে পরিবেশ অনুকূলে থাকায় এবারও বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। উপজেলা কৃষি বিভাগ জানিয়েছে– উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার ১৭ হাজার ৬৭০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়। তম্মধ্যে ৫ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড ও ১২ হাজার ৭০ হেক্টর জমিতে উফসি প্রজাতির ধানের আবাদ করা হয়। হাইব্রিড প্রজাতির ধানের মধ্যে রয়েছে এস এল এইট এইচ, হিরা, জনকরাজ, আফতাব, ধানী গোল্ড, সিনজেনটা–এস–১২০৫। অপরদিকে উফসি প্রজাতির মধ্যে রয়েছে বঙ্গবন্ধু–১০০, ব্রি–ধান–৯২, ৮৮, ৮৪, ৭৪, ৬৭ উল্লেখযোগ্য।
চকরিয়া উপজেলা কৃষিবিভাগের উপ–সহকারী কৃষি কর্মকর্তা (উন্নয়ন) রাজীব দে দৈনিক আজাদীকে জানান, এবারও বোরো ধান উৎপাদনে বাম্পার ফলন হয়েছে। দিগন্তজোড়া মাঠে বাতাসে দুলছে পাকা সোনালী ধান। একসপ্তাহ আগে থেকে পাকা সোনালী ধান কর্তনের কাজও শুরু করে দিয়েছেন প্রান্তিক কৃষকেরা। ইতোমধ্যে প্রায় ৮ হাজার হেক্টর জমির পাকা ধান কর্তনের পর প্রক্রিয়া শেষে গোলায় তুলেছেন। বাকী ধানও গোলায় তুলতে দিন–রাত পরিশ্রম করছেন প্রায় ৬৫ হাজার কৃষক পরিবার। কৃষি বিভাগ জানিয়েছে– বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা যাতে অর্জিত হয় সেজন্য মাঠপর্যায়ে প্রতিটি ব্লকের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ–সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকদের নানা পরামর্শসহ সার্বিক সহায়তা দিয়েছেন। তালিকাভুক্ত প্রান্তিক কৃষকেরা প্রণোদনা হিসেবে আগে থেকেই পান সার, বীজসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী। এতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বোরো আবাদের ধানের চারা রোপণ কাজ সম্পন্ন হয় এই উপজেলার আবাদী জমিতে।
প্রান্তিক কৃষক এবং কৃষিবিভাগ জানায়–পার্বত্য অববাহিকার মাতামুহুরী নদীর বাঘগুজারা ও পালাকাটা–রামপুর পয়েন্টে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্মিত রাবার ড্যামের মাধ্যমে ধরে রাখা নদীর মিঠাপানির সরবরাহ দিয়েই বোরো আবাদসহ রকমারী সবজির চাষাবাদ করা হয়। মিঠাপানির প্রবাহ এবং আবহাওয়া অনুকূলে পাওয়ায় এবারও বোরো ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে বাম্পার ফলন হয়েছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, চকরিয়া পৌরসভা ও উপজেলার হারবাং, বরইতলী, কৈয়ারবিল, লক্ষ্যারচর, কাকারা, সুরাজপুর–মানিকপুর, বমু বিলছড়ি, ফাঁসিয়াখালী, ডুলাহাজারা, খুটাখালী, চিরিংগা, সাহারবিল, বিএমচর, পূর্ব বড় ভেওলা, পশ্চিম বড় ভেওলা, কোনাখালী, ঢেমুশিয়া, বদরখালী ইউনিয়নে বোরো ধানের সোনালী আভা বাতাসে দোল খাচ্ছে। পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধে এখন একাকার হয়ে পড়েছে প্রতিটি এলাকা। এসব মাঠে উফসি প্রজাতির ধানের ফলন হয়েছে বেশি।
ধান উৎপাদনে প্রতিবারই চমক দেখিয়ে আসছে চকরিয়ার হারবাং ও বরইতলী ইউনিয়নের মাঝখানের দিগন্তজোড়া মাঠ ঐতিহাসিক ‘বড়বিল’। এই ‘বড়বিল’ এর আয়তন ৩৬০ দ্রোনের। প্রতি দ্রোনে ১৬ কানি হিসেবে এই ‘বড়বিল’ এ এবারও ধানের আবাদ করা হয় ৫৭৬০ কানি জমিতে।
সরজমিন আরও দেখা গেছে– সেই ঐতিহাসিক ‘বড়বিল’ থেকে ধান কর্তন শুরু হয় অন্তত দশদিন আগে থেকে। সারিবদ্ধভাবে প্রান্তিক কৃষক ও শ্রমিক মাঠ থেকে ধান কর্তনের পর ভাড় করে স্তুপ করছেন ‘বড়বিল’ এর মাঝখান দিয়ে নির্মিত বানৌজা শেখ হাসিনা সাবমেরিন ঘাটি সড়কের দুই পাশে। সেখানেই প্রক্রিয়া করে ধান সরাসরি গোলায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
এ সময় কথা হয় হারবাং জমিদার পাড়ার প্রান্তিক কৃষক নুরুল আমিনের সঙ্গে। তিনি দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘এবারও বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। প্রয়োজনীয় সেচ সুবিধা প্রয়োগ করাসহ আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় আমার নিজের দুই দ্রোন জমিতে রোপিত উফসি প্রজাতির ধানের ভালো ফলন হয়েছে। পাকা ধানের থোড় দেখে মনে হচ্ছে প্রতি কানিতে ১৩০০ থেকে ১৪০০ কেজি ধান উৎপাদন হয়েছে। একই অবস্থা পুরো ‘বড়বিলের’।
সেই বড়বিলের আরও কয়েকজন প্রান্তিক কৃষক জানান, প্রতিদিন ভোরের আলো ফোটার সাথেই ধান কর্তন শুরু হয়ে চলে গভীর রাত পর্যন্ত। আবহাওয়া ভালো থাকায় চাঁদের আলোতেও ধান কর্তনের কাজ চলছে এখানে।
কোনাখালী ইউনিয়নের কৃষক দিদারুল ইসলাম বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুমে মাতামুহুরী নদীতে রাবার ড্যাম দিয়ে আটকানোর কারণে মিঠাপানির যথেষ্ট উপস্থিতি রয়েছে এখনো। এতে কৃষকেরা নির্বিঘ্নে বোরোর আবাদ সম্পন্ন করার পর বাম্পার ফলন হয়েছে।’
চকরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এস এম নাসিম হোসেন দৈনিক আজাদীকে বলেন, প্রতিবছরের মতো চকরিয়ার ১৮টি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভায় ১৭ হাজার ৬৭০ হেক্টর জমিতে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বোরো আবাদ সম্পন্ন করা হয়। কৃষি বিভাগের সার্বিক তদারকি ও প্রণোদনার মাধ্যমে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিতের পর বাম্পার ফলন হয়েছে।’
কৃষি কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘মাতামুহুরী নদীতে মিঠা পানির প্রবাহ বৃদ্ধি ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বোরো আবাদে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পাশাপাশি প্রান্তিক কৃষকও লাভবান হচ্ছেন।’